Advertisement
১৮ মে ২০২৪

রণক্ষেত্র পাড়ুই, গুলি-বোমায় নিহত ৩

পাড়ুইয়ের গ্রামে এ বার নন্দীগ্রাম ও কেশপুরের ছায়া! টানা দু’ঘণ্টা গুলি চালিয়ে, বোমা মেরে, পিটিয়ে মারা হল তিন জনকে। গ্রাম জুড়ে চলল দুষ্কৃতী তাণ্ডব। গুরুতর আহত আরও কয়েক জন। গোটা ঘটনায় অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের দিকে। অভিযোগ উঠেছে মাস্কেট বাহিনীর অবাধ লুঠতরাজ ও তাণ্ডব চলাকালীন আগাগোড়াই পুলিশ ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। ঘটনাস্থল পাড়ুইয়ের চৌমণ্ডলপুর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরের মাকড়া গ্রাম। এ দিন সকাল থেকে সেখানে নির্বিচার তাণ্ডব চালায় সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনী।

মৃত শেখ মোজাম্মেল। পাশেই আহত শেখ এনামুল (সাদা জামা)। সোমবার সিউড়ি সদর হাসপাতালে।

মৃত শেখ মোজাম্মেল। পাশেই আহত শেখ এনামুল (সাদা জামা)। সোমবার সিউড়ি সদর হাসপাতালে।

মহেন্দ্র জেনা ও দয়াল সেনগুপ্ত
পাড়ুই ও সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ২০:৪০
Share: Save:

পাড়ুইয়ের গ্রামে এ বার নন্দীগ্রাম ও কেশপুরের ছায়া!

টানা দু’ঘণ্টা গুলি চালিয়ে, বোমা মেরে, পিটিয়ে মারা হল তিন জনকে। গ্রাম জুড়ে চলল দুষ্কৃতী তাণ্ডব। গুরুতর আহত আরও কয়েক জন। গোটা ঘটনায় অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের দিকে। অভিযোগ উঠেছে মাস্কেট বাহিনীর অবাধ লুঠতরাজ ও তাণ্ডব চলাকালীন আগাগোড়াই পুলিশ ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। ঘটনাস্থল পাড়ুইয়ের চৌমণ্ডলপুর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরের মাখড়া গ্রাম। এ দিন সকাল থেকে সেখানে নির্বিচার তাণ্ডব চালায় সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনী। গত শুক্রবার পাড়ুইয়ের মঙ্গলডিহি ও বাতিকার গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় গণ্ডগোলের জেরে গোটা অঞ্চলে জারি হয়েছিল ১৪৪ ধারা। মাখড়া গ্রাম পড়ে বাতিকার পঞ্চায়েত এলাকায়। ১৪৪ ধারা তার মধ্যেই এলোপাথাড়ি গুলি চলে, বোমাও পড়ে। একের পর এক বাড়িতে ভাঙচুর ও লুঠতরাজের অভিযোগ ওঠে। বোমার আগুনে কয়েকটি বাড়ি পুড়ে যায়। অভিযোগ উঠেছে, বিজেপি প্রভাবিত মাখড়া গ্রাম দখল করতে গিয়ে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। পাল্টা প্রতিরোধের পথে যায় বিজেপি-ও। প্রশ্ন উঠেছে, পাড়ুইয়ের এ দিনের ঘটনা কি ২০০৭-এর নন্দীগ্রামের ‘অপারেশন সূর্যোদয়’-এর পুনর্নির্মাণ? এরই পাশাপাশি কেউ কেউ মনে করছেন, কেশপুরের ঢঙেই পাড়ুই পুনর্দখলের জন্য ‘হার্মাদ’ বাহিনীকে নামানো হয়েছে।

যদিও দলের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর কথায়, “এই কাণ্ডটা বিজেপি ঘটাল। পাড়ুইয়ের ওসি-কে মারল কে? মাখড়ায় আমাদের দু’জনকে ওরা গুলি করেছে। গ্রাম দখলের জন্যই এই ঘটনা। কিছু হার্মাদ, তারা সিপিএম থেকে বিজেপিতে গিয়েছে শেখ সদাইয়ের নেতৃত্বে। তারাই এর সঙ্গে জড়িত।” কিন্তু অনুব্রতর এই দাবি উড়িয়ে দিয়ে বিজেপি-র জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল বলেন, “এটা ওদের স্বভাবসিদ্ধ কথাবার্তা। তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলে লোক মারা যাচ্ছে, ওরা দোষ দিচ্ছে আমাদের।”

বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “চৌমণ্ডলপুর বা মাখড়া— কোনও গ্রামেই কোনও তৃণমূল নেই। গ্রামবাসীরা আগেই বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। তাই তৃণমূল হতাশাগ্রস্ত হয়ে গ্রামগুলি পুনর্দখলের জন্য বাইরের দুষ্কৃতীদের নিয়ে আক্রমণ করেছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকেছে।” এ দিন বিজেপি-র রাজ্য প্রতিনিধি দলের চৌমণ্ডলপুর গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। তাঁদের আটকাতেই চক্রান্ত করে চৌমণ্ডলপুরের পাশে মাখড়া গ্রামে আক্রমণ করা হয়েছে বলে রাহুলবাবুর দাবি।

পুলিশ কেন কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকায় রইল?

জেলা ও রাজ্যের পুলিশকর্তাদের কাছে থেকে এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর মেলেনি। ডিআইজি (বর্ধমান রেঞ্জ) ত্রিপুরারি বলেন, “আমি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না। পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলুন।” পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া ফোন ধরেননি। পারিবারিক কারণে তিনি ছুটিতে রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে।

এ দিন মাখড়ায় নিহতদের মধ্যে ১৯ বছরের এক কিশোরও আছে। তার নাম শেখ তৌসিফ। তার পেটে গুলি লাগে। নিহত ওই কিশোর বিজেপি কর্মী মণ্টু শেখের ছেলে বলে রাহুলবাবু এ দিন দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, “মাখড়া গ্রামের পুরো ঘটনা আমরা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানাব। আর রাজ্য পুলিশের উপর আমাদের আস্থা নেই। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি, সিবিআই বা এনআইএ-কে দিয়ে মাখড়া কাণ্ডের তদন্ত করান।” পুলিশের ভূমিকা নিয়েও কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তের দাবি তুলেছেন রাহুলবাবু। এসইউসিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসু বলেন, “রাজ্য সরকারের কাছে এলাকা দখলের নামে সাধারণ গরিব মানুষের উপর শাসক দলের আক্রমণ বন্ধ করার ও দোষীদের গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি। বিজেপি এবং তৃণমূলের ক্ষমতার লড়াইয়ের জন্যই সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।”

তৌসিফের পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছে শেখ জালানের ছেলে মাখড়ারই বাসিন্দা বছর চল্লিশের শেখ মোজাম্মেলের। তাঁর মাথায় গভীর ক্ষত রয়েছে। সারা দেহেও আছে আঘাতের চিহ্ন। এ ছাড়া মারা গিয়েছেন দুবরাজপুরের সালুঞ্চি গ্রামের বাসিন্দা শেখ সুলেমান (৪৫)। তাঁর বুকে গুলি লাগে। সিউড়ি সদর হাসপাতালে আনা হলে তিন জনকেই মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। গুরুতর আহত হয়েছেন মোজাম্মেলের ভাই শেখ এনামুল।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মাখড়া গ্রামের কয়েক জন তৃণমূল সমর্থক বেশ কয়েক দিন এলাকা ছাড়া ছিল।

ঠিক কী হয়েছিল এ দিন?

সোমবার বেলা ১১টা নাগাদ চৌমণ্ডলপুরে যাওয়ার কথা ছিল রাজ্য বিজেপি-র চার সদস্যের প্রতিনিধিদলের। বীরভূম জেলা বিজেপি-র সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের দাবি, তিনি এ দিন সকালে খবর পান, ইলামবাজার ব্লক তৃণমূল সভাপতি জাফারুল ইসলামের নেতৃত্বে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা শাল নদী পেরিয়ে কানপুর গ্রাম হয়ে মাখড়ায় ঢুকবে গ্রাম দখলের লক্ষ্যে। দিলীপবাবু বলেন, “আমি সঙ্গে সঙ্গে সে কথা বোলপুরের এসডিপিও সূর্যপ্রতাপ যাদব এবং পাড়ুইয়ের সিআই-কে জানাই। তবু পুলিশ কিছু করল না!”

সকাল ১০টা নাগাদ কিছু পুলিশকর্মী মাখড়া গ্রামে গিয়ে পুরুষদের ধরপাকড় শুরু করে। দুই গ্রামবাসীকে পুলিশ আটক করে। এর প্রতিবাদে ফেটে পড়েন গ্রামবাসীরা। পুলিশকর্মীদের সঙ্গে তাঁদের বচসা বাধে। হাবুল ও শেখ প্রহ্লাদ নামে ওই দু’জনকে পুলিশ অবশ্য তুলে নিয়ে যায়। তখন থেকেই গ্রামবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মাচ্ছিল। বেলা ১১টা নাগাদ শাল নদী পেরিয়ে কানপুরের দিক থেকে তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী প্রথমে হামলা চালায় মাখড়ার দক্ষিণপাড়ায়। জনা পঞ্চাশেকের আর একটি দল মোটরবাইকে চেপে দু’দলে ভাগ হয়ে জাহানাবাদ-মোল্লাপাড়ার দিক থেকে গ্রামে ঢোকে।

গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এলোপাথাড়ি বোমা ছুড়তে ছুড়তে দুষ্কৃতীরা প্রথমেই বিজেপি সমর্থক শেখ জিয়া আলির বাড়িতে হামলা চালায়। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। বাড়িতে ভাঙচুর, লুঠপাট চালিয়ে দুষ্কৃতীরা পাশের বাড়িগুলিতে ভাঙচুর শুরু করে। মারধরের হাত থেকে রেহাই পাননি মহিলারাও। বিজেপি সমর্থক পরিবারের মেয়েদের শ্লীলতাহানি করা হয় বলেও অভিযোগ। গ্রামের একাধিক তরুণী এ দিন বলেন, “তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী আমাদের মাথায় বন্দুক ধরে। ভোজালি দেখায়। শ্লীলতাহানি করে রেপ করার হুমকিও দেয়!” হামলার কয়েক ঘণ্টা পরেও আতঙ্ক যায়নি বাসিন্দাদের। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা শেখ আসগর আলি, শেখ আক্কেল আলির কথায়, “এত বয়স হয়ে গেল। আমাদের এলাকায় এমন গুন্ডামি আর লুঠতরাজ জীবনে দেখিনি! তৃণমূলের গুন্ডারা মুহূর্তের মধ্যে গোটা গ্রাম তছনছ করে দেয়। পুলিশ প্রথম দিকে গ্রামে ছিল। তবু হাত গুটিয়ে বসে রইল।” আক্রান্ত পরিবারের মহিলারা জানালেন, গুলি চলা শুরু হতেই পুলিশ গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।

দক্ষিণপাড়াতেই মঙ্গলবার বিয়ে হওয়ার কথা শেখ সুজলের। সেই উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয়েরা এসেছিলেন। প্যান্ডেল খাটানো হয়ে গিয়েছিল। রান্নারও তোড়জোড় চলছিল। সুজলের ভাই শেখ উজ্জ্বল বলেন, “আগে তৃণমূল করতাম। এখন গ্রাম বাঁচাতে আমরা বিজেপি করি। সেই রাগেই তৃণমূলের বাহিনী আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়। প্যান্ডেল ছিঁড়ে ফেলে বাড়িতে লুঠ চালায়। মেয়েদের শাড়ি ধরে টানাটানি করে। দাদার বিয়ে কী ভাবে হবে, জানি না।” উজ্জ্বলদের পাশেই শেখ তৌসিফের বাড়ি। নিহত এই তরুণের বাবা, গ্রামের বিজেপি কর্মী শওকত আলি বলেন, “বাড়িতে ছিলাম না। ছেলে রাস্তার কাজ করতে গিয়েছিল। তৃণমূল গুলি করে ওকে মেরে দিল! ওর তো কোনও দোষ নেই!”

টানা ঘণ্টা আড়াই তাণ্ডব চালানোর সময় পুলিশ গ্রামে ঢুকতে পারেনি। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, তাণ্ডব চালিয়ে দুষ্কৃতীরা গ্রাম ছাড়ার পরে পরিস্থিতি খানিকটা শান্ত হলে পুলিশ গ্রামে ঢোকে।

২০০৭-এর ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে এলাকা দখল করতে গিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে ‘ডাকাবুকো’ ক্যাডার জড়ো করেছিল তৎকালীন শাসক দল সিপিএম। অভিযোগ উঠেছিল, নির্বিচার গুলি-বোমার ঘায়ে ও দুষ্কৃতীদের অবাধ তাণ্ডবে মৃত্যু হয় ১৪ জনের। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিপিএমের বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলে তৃণমূল। সরব হন বিদ্বজ্জনেরা। শহর কলকাতার বুকে গর্জে ওঠে অরাজনৈতিক মৌন মিছিল।

সোমবার মাখড়া গ্রামের সংঘর্ষে নিহত শেখ সুলেমানের বাড়ি দুবরাজপুরে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, দুবরাজপুর থেকে মাখড়ায় এসে তিনি কী করছিলেন? বিভিন্ন মহলের সন্দেহ, এলাকা পুনর্দখলের জন্যই কি বহিরাগত হিসেবে তাঁকে আনা হয়েছিল?

গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে, এই পাড়ুইতেই খুন হয়েছিলেন সাগর ঘোষ। তিনি ওই নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা। সাগরবাবু খুন হওয়ার কয়েক দিন আগেই নির্দল প্রার্থীদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। সম্প্রতি সাগর ঘোষ হত্যাকাণ্ডে কলকাতা হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এর পর বারে বারেই খবরে উঠে এসেছে বীরভূমের পাড়ুই। গত শুক্রবারও এখানে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ার অভিযোগ ওঠে। ঘটনায় গুরুতর আহত হন পাড়ুই থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত। সেই কারণে পাড়ুই থানার বেশ কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এ দিন তার মধ্যেই ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠল পাড়ুই।

সোমবার তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

makra death parui tmc bjp clash
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE