E-Paper

বস্তি ছাড়তে নারাজ বাসিন্দারা, ভোটের কেন্দ্রে ধারাভি

লোকসভা ভোটের মুখে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়ানো এশিয়ার দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ বস্তি ধারাভিতে এসে পৌঁছেছি। যেখানে একরাশ পাঁপড় বেলে সদ্য কাঠফাটা রোদে রেখেছেন বিনোদ কুমারি জয়সওয়াল।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২৪ ০৮:২৭
মুম্বইয়ের ধারাবী বস্তি।

মুম্বইয়ের ধারাবী বস্তি। —ফাইল চিত্র।

গলির পর গলি টপকাচ্ছি। এখানে মোবিল, চামড়া, গঁদের আঠা, কাবাব, কর্পূরের মিশ্র গন্ধের সহাবস্থান। এখানে এক বালতি জলের জন্য পড়শিদের মধ্যে চুলোচুলি নিত্যকর্ম। এখানে জীবনযুদ্ধকে ঘিরে জটিল এক সমাজ-জ্যামিতি, গলি-রেলিং-সিঁড়ি-উঠোন-রান্না ঘর-দোকানপাটের। সব কিছুর মধ্যে চলছে যেন পুতুলের সংসার, পুতুলের রান্নাবাটি, পুতুলের বাণিজ্য, চামড়ার মিনি উৎপাদন কেন্দ্র, পাঁপড় বানানোর উঠোন, অন্ধকার ঘরের মধ্যে কাপড়ে চুমকি বসানোর রোশনাই।

লোকসভা ভোটের মুখে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়ানো এশিয়ার দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ বস্তি ধারাভিতে এসে পৌঁছেছি। যেখানে একরাশ পাঁপড় বেলে সদ্য কাঠফাটা রোদে রেখেছেন বিনোদ কুমারি জয়সওয়াল। নালার এ-পাশে ও-পাশে ছটাক জায়গা বার করে। ‘ডেলিভারি’ দেওয়ার তাড়া রয়েছে তাঁর। প্রশ্নের মুখ ভাল করে খোলার আগেই বললেন, “লিখে দেবেন আমরা এখানেই থাকব। এটাই আমাদের দেশ। ফ্ল্যাট হলে এখানেই যদি জায়গা দেয় ভাল, না হলে আগুন জ্বলবে। এ ব্যাপারে আমরা এককাট্টা।”

ভিড় বেড়েছে ওই ছোট্ট গলির পরিসর জুড়ে। সাবিত্রি কাক্কি বলছেন, ‘‘এই জায়গাটা মুম্বইয়ের দিল। বর্ষাকালে পায়ের তলায় দিয়ে নোংরা জল, প্রস্রাব সব বয়ে গিয়েছে, আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’মুঠো খেয়েছি। দশ বাই দশ ফুটে জীবন কাটিয়েছি। বাচ্চারা খেলার মাঠ পায়নি। আজও গোটা বছর দাঁড়িয়ে বা গলিতে এসে খেতে হয়, বসার জায়গা নেই ঘরে সবার। অথচ এখন যেই বড় বিল্ডিং হবে, আমাদের এখান থেকে তাড়াতে চাইছে। কেন যাব আমরা?’’ বিনোদ কুমারীর কথায়, ‘‘এত বছর কষ্ট করে আবর্জনার মধ্যে থেকেছি, এখন অন্য কোথাও যাব না আমরা। বিজেপি এসে বলেছিল কালো টাকা ফেরত এনে গরিবদের ১৫ লাখ করে টাকা দেবে, বদলে নোটবাতিলের যন্ত্রণা দিয়েছে। ২ কোটি লোককে চাকরি দেবে বলেছিল, গোটা দেশ, এমনকি আমাদের ধারাভিও আদানিকে বেচে দিচ্ছে। মুসলিমদের তো আরওই কোনও চাকরি নেই। সঙ্ঘ আগে ইংরেজদের ‘খবরি’ ছিল, এখন দেশকেই আদানির গোলাম বানাচ্ছে।’’

ধারাভির মানুষদের পুর্নবাসনের জন্য গত বিশ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে মহারাষ্ট্রের প্রাচীনতম বামপন্থী রাজনৈতিক দল ‘ভারতীয় সেতকরি কামগর পক্ষ’ (পেজেন্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি অব ইন্ডিয়া)। তার কর্ণধার রাজু কোরাডের বক্তব্য, ‘‘এই ধারাভির পুর্নবাসন প্রকল্পের একটিই উদ্দেশ্য। মুম্বইয়ের আবাসন শিল্পে নতুন সম্রাট তৈরি করা।’’

অঙ্কটা খুব জটিল নয়, দেখলাম ধারাভিবাসীর অনেকেরই তা ঠোঁটস্থ। এসআরএ অর্থাৎ ‘স্লাম রিহ্যাবিলিটেশন অথরটি’-র অধীনে কোনও প্রকল্পের প্রাথমিক আইন হল, কোনও ব্যক্তিকে তার জায়গা থেকে উৎখাত করা যাবে না, নতুন আবাসন হলে তাদের আগে জায়গা দিয়ে তারপর নির্মাণ সংস্থা বাকিটা বিক্রি করে তার লাভ তুলবে। ধারাভির জমি ৬০০ একর এবং তার জনসংখ্যা ৮০ হাজারের মতো। এই বিশাল পুনর্বাসনের বরাত দেওয়া হয়েছে আদানির নতুন সংস্থা ডিআরপিপিএল (ধারাভি রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম প্রাইভেট লিমিটেড)-কে, যারা রেলওয়ের কাছ থেকে এবং মুলুন্দের আবর্জনা ফেলার জমি ছাড়াও বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ১২১৫ একর জমি ‘জলের দরে’ অধিগ্রহণ করেছে বলেই অভিযোগ। আর তারা মুম্বইয়ের প্রান্তে ওয়াডলায় লবণ অঞ্চলে ধারাভিবাসীদের জন্য সাড়ে তিনশো বর্গফুট (পরিবার প্রতি) করে জমি দিতে চাইছে। ফলে অভিযোগ উঠেছে যে প্রাপ্যের অনেক কম এবং প্রান্তিক, বসবাসঅযোগ্য জমি দিয়ে, দাদার বান্দ্রা-কুরলা অঞ্চলের (যেখানে এখন ধারাভি) জমি বিশাল দামে বিক্রি করে মুনাফার পাহাড়ে চড়তে চায় ওই সংস্থা।

লোকসভার মুখে বিক্ষোভের গন্ধ পেয়ে ঝাঁপিয়েছে বিজেপি বিরোধী মহাবিকাশ আগাড়ির নেতারা। উদ্ধব ঠাকরে দাবি করছেন, ভোটে জিতে এলে ধারাভিবাসীকে তাঁদের নিজের জায়গাতেই ৫৫০ বর্গ ফুট করে জমি দেবেন। উদ্ধবপন্থী শিবসেনার অনিল দেশাইয়ের এ বারের প্রচারের একটি দিক আদানি-বিরোধিতা হলে, অন্য দিক বস্তিবাসীর পুনর্বাসন। যেখানে মুসলিম ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষই শতকরা আশি ভাগ। দক্ষিণ-মধ্য মুম্বইয়ের ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের (যার মধ্যে রয়েছে মাহিম দাদার চেম্বুরও) মধ্যে এই ধারাভি অঞ্চল এমনিতেই বিজেপি-বিরোধী। বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে।

এলাকায় প্রবল গুঞ্জন, পরিস্থিতি সামলাতে, বস্তির নেতাদের জন্য জলের মতো টাকা খরচ করছেন শিন্দেপন্থী শিবসেনার প্রার্থী রাহুল শিবানী।

পাঁচ বছর আগে লোকসভা নির্বাচনের আগে ধারাভিতে এসে দেখা করেছিলাম এক সেলাইকলের দোকানের মালিকের সঙ্গে। এ বারেও খুঁজে খুঁজে গেলাম সেখানে। একটি মানুষের বেশি আঁটে না সেই দোকানে। বিশ বছর নাগাড়ে এখানেই সেলাইকল চালাচ্ছেন সাবিত্রী বড়েগড়ি। বছর পঁয়তাল্লিশের মহিলার কথায়, “আমার বাবা যখন আমার বয়সি ছিল, তখন থেকে ফাইলবন্দি করে রেখেছে রেশন কার্ড, বিজলির বিল, আরও সব কাগজ। সেই থেকে শুনছি এখানে নাকি বস্তি ভেঙে বড় বিল্ডিং হবে। আমাদের ফ্ল্যাট দেবে।”

প্রাণ খুলে হাসছেন সাবিত্রী। এই পরিবেশে তাঁর হাসিটা শোনাচ্ছে ‘নিয়তি’র কণ্ঠস্বরের মতো।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 Mumbai Spot Reporting Dharavi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy