কচি কলাপাতা রঙের লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে বিধায়ক গাড়ি থেকে নামতেই সাড়া পরে গেল সমর্থক আর কর্মীদের মধ্যে। এতক্ষণ ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা ভিড়টা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করল। বেশির ভাগেরই হাতে বাঁশের কঞ্চির আগায় দলীয় পতাকা। কেউ কেউ আবার হাতে করে শোলার তৈরি দলীয় প্রতীক এনেছেন। ভিড়ের মধ্যে থাকা ধামসা মাদলের দলটাকে সবাই মিছিলের সামনে জায়গা করে দিল।
মিছিলটা সবাই মিলে একটু গুছিয়ে নেওয়ার ফাঁকেই হাতে টানা একটা রিকশার উপর বসা এক যুবক ব্যাঞ্জোয় চটুল সুর ধরল। সেই আওয়াজে ভিড়টা এ বার যেন বেশ নড়েচড়ে উঠল। ব্যাঞ্জোর আওয়াজে ভিড়ের জড়তা এ বার যেন কিছুটা কেটে গেল। মিছিলের সামনে থাকা ধামসা মাদলের দলটাও এ বার আওয়াজ তুলতে শুরু করল। হরিপালের প্রত্যন্ত গ্রাম দ্বারহাট্টা পঞ্চায়েত এলাকায় এগিয়ে চলল মিছিল। সকালে ঘুমের রেশ কাটতেই ধামসা মাদলের আওয়াজে গোটা গ্রামটাই এখন যেন রাস্তায় নেমে এল। কেউ কেউ উৎসাহে হাত নাড়ছেন। সেই দেখে আহ্লাটে আটখানা রাজ্যের বিদায়ী কৃষিপ্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না হাসিমুখে নমস্কার বিলোচ্ছেন ভিড়ের উদ্দেশে।
এই তল্লাটে এ বার নিয়ে দ্বিতীয় বার ভোটে লড়তে আসা সিঙ্গুর আন্দোলনের অন্যতম মুখ বেচারাম মান্নার। এক সময় লালদুর্গ হিসেবেই পরিচিতি ছিল হরিপালের। কিন্তু গত বার ঘাসফুলের ঝোড়ো হাওয়ায় হুগলির বহু এলাকাতেই ঝাঁপ খুলতে পারেনি বামেরা। গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে পঞ্চায়েত বা লোকসভা নির্বাচনে সেই ভাবে মাথা তুলতে পারেনি বামেরা। এ বার হরিপালে বামেদের নতুন মুখ যুবনেতা যোগীয়ানন্দ মিশ্র। কিন্তু তাই বলে গোঁফে তা দিয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে রাজি নন গত বারের বিজয়ী বেচারাম।
মিছিলে হাঁটতে হাঁটতেই কথা হচ্ছিল: ‘‘এই চড়া রোদে কষ্ট তো কিছুটা হয়ই। কিন্তু ভোটটা আবার মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের একটা বড় সুযোগ। তাই আমি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে এই ভাবেই প্রতি বার জনসংযোগ করি।’’ প্রতি দিন প্রতি বেলায় গড়ে ২০ কিলোমিটার করে মিছিলে হাঁটছেন তাঁরা। এক একটি এলাকা ধরে অন্তত পাঁচশো লোকের মিছিল প্রতি দিন থাকে তাঁর সঙ্গে। একেবারে রোড ম্যাপ তৈরি করে প্রতি দিন পঞ্চায়েত ধরে ধরে হাঁটা। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর দেড়টা। মাঝে সাময়িক বিশ্রাম।
এখন সূর্য একেবারে গনগনে। মাথার উপর। মিছিলের সবাই ঘেমে-নেয়ে স্নান করে গেছেন। দ্বারহাট্টার দীপের মাঠের কাছে মিছিলটা আসতেই দলনেতা বিধায়ক দুপুরের বিশ্রামের কথা বললেন। মিছিলের ভিড়টা যেন সেই অপেক্ষাতেই ছিল। বাঁচলো তারা। দীপের মাঠ লাগোয়া গাছঘেরা একটা পুকুরের পাড়ে সাময়িক আস্তানা। তারই একপাশে সবার জন্য দুপুরের খাওয়ার আয়োজন। সেই পুকুরের পাড় ধরে আরও খানিক হেঁটে পৌঁছনো গেল বাগানঘেরা একটা বাড়িতে। সেটাই আপাতত বিধায়কের দুপুরের বিশ্রাম আর খাওয়ার সাময়িক ডেরা।
শুকনো তোয়ালে দিয়ে বিধায়ক বেচারাম ঘাম মোছার ফাঁকেই এল লেবুর জল। তার পিছনে এল গামলা ভর্তি গরম জল। প্রশ্ন করার আগেই উত্তর ভেসে এল, ‘‘যা হাঁটা। দুটি বেলা পায়ে এই গরম জলের সেঁক না নিলে হাঁটা মুশকিল। তার উপর যতই নরম জুতো পরি, এত হাঁটায় ফোস্কা ঠেকানো যাচ্ছে না।’’ এর পর দুপুরের খাওয়া। ভাত, সুক্তো, ডাল, মাছের ঝালের ছিমছাম খাওয়া। শেষ পাতে দই। বেচা বলছিলেন, ‘‘আমি একেবারে বাড়ির খাবার পছন্দ করি। তারপর এই গরম। একটু উল্টোপাল্টা হলেই সব মাটি।’’
ঘড়ি ধরে দুপুর আড়াইটের মধ্যে খাওয়া শেষ। তারপর সহকর্মীদের সঙ্গে বিকেলের রুটটা খানিক ছকে নিয়েই বিশ্রাম। সেটাও কিন্তু ঘড়ি মেপেই। দুপুর ঠিক সাড়ে তিনটেয় ফের তৈরি হরিপালের বিধায়ক। তিনি ঘর ছেড়ে বের হতেই তখন দেখা গেল, পুকুর পাড়ে ঠান্ডায় গাছের তলায় ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশ্রামে তাঁর কর্মীরা। কারও আবার দুপুরের খাওয়ার পর চোখটা কিছুটা লেগে গিয়েছে। কিন্তু সকালের মতোই ধামসা-মাদল আওয়াজ তুলতেই যেন সবার চটকা ভেঙে গেল। আবারও অহল্যাবাঈ রোড ধরে ধুলো উড়িয়ে চলল সেই মিছিল। কচি-কাঁচা আর বড়দের ভিড় আছড়ে পড়ল সেই মিছিলে। চৈত্রের তীব্র গরম উপেক্ষা করে এগিয়ে চলল সেই মিছিল। ভোট বড় বালাই যে!