Advertisement
E-Paper

আধপেটা খাবার বলতে সাদা ভাত আর লবন, এ ভাবেই বেঁচে আছে চা-বাগান

তখন সূর্য ঠিক মাথার উপরে। প্রচণ্ড দাবদাহের আঁচ এসে পড়েছে এই চা-বাগানগুলিতেও। ঢেকলাপাড়া, ডিমডিমা, বীরপাড়া, হান্টাপাড়া, গ্যারগ্যন্ডা, লঙ্কাপাড়া, জয়বীরপাড়া। সবুজ হারিয়ে যেন পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে চার দিকে। তবুও বিশ্রাম নেওয়ার জো নেই এদের! কত দিনের পুরনো কে জানে, জামাকাপড় শরীরে। এতটাই নোংরা জমেছে, যে গায়ের কালো রং আর জামার কালো রং এক হয়ে গিয়েছে। মাথা থেকে পিঠে ঝুলানো ব্যাগে চা পাতা ঠেসে ঠেসে ভরছে ওঁরা।

নমিতেশ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৫৩

তখন সূর্য ঠিক মাথার উপরে। প্রচণ্ড দাবদাহের আঁচ এসে পড়েছে এই চা-বাগানগুলিতেও। ঢেকলাপাড়া, ডিমডিমা, বীরপাড়া, হান্টাপাড়া, গ্যারগ্যন্ডা, লঙ্কাপাড়া, জয়বীরপাড়া। সবুজ হারিয়ে যেন পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে চার দিকে। তবুও বিশ্রাম নেওয়ার জো নেই এদের! কত দিনের পুরনো কে জানে, জামাকাপড় শরীরে। এতটাই নোংরা জমেছে, যে গায়ের কালো রং আর জামার কালো রং এক হয়ে গিয়েছে। মাথা থেকে পিঠে ঝুলানো ব্যাগে চা পাতা ঠেসে ঠেসে ভরছে ওঁরা।

‘দিদি একটু কথা বলব’। বাগানের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েই ইশারা করলাম এক প্রৌঢ়াকে। আমার দিকে তাকিয়েই যেন চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আবার, এ বার হিন্দিতে, ‘থোড়া সা বাত করনা হ্যায়… দিদি’— একটু চেঁচিয়ে বললাম। হাত দিয়ে ইশারা করে এ বার আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। কিছু ক্ষণ পরেই দলবেঁধে বাগান থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করলেন তাঁরা। যে মহিলাকে আমি ডেকেছিলাম, তিনি ছিলেন সবার আগেই। বুধমতি ওঁরাও। রমন লাইনের বাসিন্দা। নিজের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে একটু কথা বলতে চাইলাম। সম্মতি দিলেন বুধমতি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই বাগান কি এখন ঠিকঠাক চলছে?’ আমার দিকে বিস্ময়ের ভঙ্গিতে তাকালেন বুধমতী। তাঁর পিছনে তখন ভিড় জমে গিয়েছে। অঞ্জলি ওঁরাও, রুপেন ধাওয়ান-সহ আরও অনেকে। বুধমতী ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললেন, “বাগান তো আভি বন্ধ হ্যায়। হামলোক পাত্তে লেকর দুসরা বাগানমে বিকতে হ্যায়। অ্যাইসে চল র‍্যাহা হ্যায়।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “না জানে কব তক অ্যায়সে চলনা পড়েগা?” ডানকান গোষ্ঠীর সাতটি বাগানের একটি বীরপাড়া চা বাগান। ওই বাগানেরই শ্রমিক হিসেবে বহু বছর ধরে কাজ করে এসেছেন বুধমতীরা। বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তাঁরা অথৈ জলে পড়েছেন। বুধমতী বলেন, “প্রতি দিন এ ভাবে চলে না। কোনও দিন পাতা বিক্রি হয়। কোনও দিন হয় না। সে দিন তো ঘরে ভাত থাকে না।” জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভোট দেবেন?’ কেউ কিছু বলল না। আবারও জিজ্ঞেস করলাম। সবাই আমাকে পাশ কাটিয়ে রওনা হলেন বস্তির দিকে। বুধমতী কিন্তু দাঁড়িয়েই ছিলেন আমার সামনে। বললেন, ‘‘কি আর বলি। সবাই আসে। ভোট চায়। ভোট তো দিই। কিন্তু দিন তো পাল্টায় না।’’

বাইকে চেপে সেখান থেকে এগোতে শুরু করলাম। ফালাকাটা থেকে বীরপাড়া যাওয়ার রাস্তায়। দু’পাশেই চায়ের বাগান। বুধমতীর কথা কানে বাজতে লাগল। শুনতে শুনতে সেই বাগানের দিকেই তাকিয়ে দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল, এই বাগানই কাউকে কর্মসংস্থানের জায়গা করে দিয়েছে। এই বাগানেই কত নিরন্ন মানুষ অভুক্ত থাকতে থাকতে মৃতপ্রায় হয়ে রয়েছে। কত জন যে অনাহারে মারা গিয়েছে তারও ঠিকমতো হিসেব নেই। সত্যি তো বুধমতী বলেছেন— ‘‘সব পাল্টাচ্ছে। চা বাগানের মানুষের জীবনযাপন তো পাল্টাচ্ছে না।’’

কিছুটা দূরে গিয়েই বাঁক নিলাম। দীর্ঘ দিন সংস্কার না হতে হতে পাকা রাস্তা ক্ষয়ে গিয়েছে। বালু-পাথর ছড়িয়ে রয়েছে রাস্তা জুড়ে। বস্তি লাইন। ছোট ছোট সব ঘর। কবে যে ঘরগুলি তৈরি হয়েছে ঠিকমতো কেউই বলতে পারে না। জীর্ণ হয়ে গিয়েছে। শ্যাওলা বাসা বেঁধেছে পাঁচিল জুড়ে। কারও বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। পানীয় জল নেই। একখানা টিউবওয়েলই ভরসা সবার। সেখানেই স্নান, সেখান থেকেই পানীয় জলের ব্যবস্থা। ঘরের ভিতর একটু উঁকি দিলাম। দেখলাম এক জন খেতে বসেছেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কি চাই।’’ ‘‘দিদি একটু কথা বলব’’— ভয় ভয় মন নিয়েই বললাম। অন্যের ঘরে উঁকি দেওয়া তো ঠিক নয়। ‘‘বলুন’’। সম্মতি পেয়ে, ‘‘কি খাচ্ছেন?’’ জানতে চাইলাম। সামনে থাকা ছোট্ট একটি আধভাঙা থালা তুলে ধরে আমাকে দেখালেন। “সাদা ভাত আর লবন।” বললেন, “কোনওদিন একটু কিছু কচু, শাক পেলে সেদ্ধ দিই। না হলে এই তো খাবার।” একটু চুপ থেকে বললেন, “তাও তো ভরপেট খেতে পারি না। বাগান বন্ধ হয়ে রয়েছে। টাকা নেই। কী আর করব বলুন।” ‘‘ভোট দেবেন না?’’ প্রশ্নটা শুনে হাসলেন ওই বৃদ্ধা। বললেন, “অনেকেই তো আসতে শুরু করেছেন আবার। কত আশ্বাস শুরু হয়েছে। ভোট চলে গেলে আর কেউ আসবেন না।” যেন বুধমতীর কথা ওই বৃদ্ধার গলাতেও।

কিছুটা দূর এগিয়ে বীরপাড়া বাজার। প্রচুর দোকান চার দিকে। বড় বড় বাড়িও তৈরি হয়েছে কিছু। আঁটোসাটো রাস্তায় গাড়ির ভিড় উপচে পড়েছে। দিন কয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সভা করে গিয়েছেন। বীরপাড়ার সার্কাস ময়দানে। ওই ময়দানও বন্ধ চা-বাগান ঘেঁষেই। প্রধানমন্ত্রী কী বলেন তা শুনতে হাজির হয়েছিলেন অনেক চা-শ্রমিক। ঠায় বসে থেকে কথা শুনেছেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাও শুনেছেন। আলিপুরদুয়ারের প্যারেড গ্রাউন্ড থেকেই সভা করে চা বাগানের জন্য কী করেছেন তিনি সে কথা শুনিয়েছেন। এই আকচাআকচি অবশ্য আর কারও ভাল লাগছে না, ওই চা শ্রমিকদের। বীরপাড়া বাজারের এক ব্যবসায়ী ছোট্ট কথায় বলেন, “কাজের কাজ কেউই করেন না। সবার মুখেই শুধু বড় বড় কথা।” বীরপাড়া থেকে কালচিনি, হাসিমারা হয়ে আলিপুরদুয়ারের পথ। গোটা রাস্তা যেন সবুজে ঘেরা। কোথাও সেগুন গাছের সারি। কোথাও সুপারি।

জলদাপাড়া, চিলাপাতা পেরিয়ে হলং বাংলোর সামনে দিয়ে হাইওয়ে। এগিয়ে চলেছি সে পথেই। এই হলং বাংলোর সঙ্গে কত ইতিহাস জড়িয়ে আছে। ডুয়ার্স আকৃষ্ট করেনি কাকে। জ্যোতি বসু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পায়ে থাকা হাওয়াই চটি হাতে নিয়ে পড়িমরি করে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে চার জন। হাইওয়ে ধরে তাঁদের দৌড়ে সবাই ঘাবড়ে গিয়েছে। কী হল? কী হল? রাস্তায় চলা বাইক, গাড়িগুলিও তাঁদের গতি তীব্র করে দিয়েছে। যারা পালিয়ে যাচ্ছে তাঁরা জঙ্গলের দিকে ইশারা করে কী যেন দেখাচ্ছেন। জঙ্গল বলতে ‘বক্সা টাইগার রিসার্ভ ফরেস্ট’। ভাল করে তাকিয়ে দেখি, জঙ্গলের ভিতরে দু’জন দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের চোখ হাইওয়ের দিকেই... ভাব খানা এমন, যেন এই মুহূর্তেই হাইওয়ের দিকে ছুটবে তারাও। না কেউই আর ঝুঁকি নিচ্ছে না। যারা প্রথম ছুটছিল তাঁরা বস্তিরই বাসিন্দা। তাঁদের পোশাক, ভাষা সে কথাই বলে দিচ্ছিল। তাঁদের পিছন পিছন কিছুটা গিয়ে কথা বলার জন্য ডাক দিলাম। চার জনই দাঁড়ালেন। দু’জন বয়সে বড়। এক জন মহিলা, অন্য জন পুরুষ। জিজ্ঞেস করলাম ‘ভয় পেয়েছেন?’ কেমন বোকা বোকা ভাবে আমার দিকে তাকালেন দু’জন। আসলে প্রশ্নটাও তো বোকা বোকা। সামনের জঙ্গল থেকে দুই হাতি বেরোতে দেখে ভয় পাবেন না, এমন কেউ আছেন নাকি পৃথিবীতে। তাঁরা কিছু বলার আগেই আবার জিজ্ঞেস করলাম ‘ভোট দেবেন?’ বললেন, “সে সব ভাবার সময় নেই। দেখছেন না হাতি বেরিয়ে এসেছে।” বলেই আবার ছুট দিলেন। আমিও সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করলাম। জঙ্গল যেন অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যেতে বসেছে। জঙ্গলের পশুরাও এখন আর নিরাপদ নয়। চলতে চলতে এই কথাগুলি বলেছিলেন আলিপুদুয়ারের বাসিন্দা ব্রজমোহন রায়। বললেন, “জঙ্গল কেটে সাফ হয়ে যাচ্ছে। কাঠপাচার তো নিত্য দিন চলছে। বন্যপ্রাণী শিকারও হচ্ছে হরদম। এ সব বন্ধ হওয়া উচিত।”

ব্রজমোহনবাবু সরকারি চাকরিজীবী। জিজ্ঞেস করলাম, “ভোট কাকে দেবেন?” মুচকি হেসে বললেন, “কাকে দেব তা বলছি না। তবে দেব। আশা করি কেউ তো এক দিন বুঝবেন।”

Namitesh Ghosh assembly election 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy