ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশের দিন থেকেই মনের ভিতর অস্বস্তি ভাবটা শুরু হয়েছিল। আবার সেই অপ্রীতিকর ঘটনার সামনে পড়ব না তো? রক্তাক্ত মন নিয়ে বুথ থেকে বাড়ি ফিরতে হবে না তো? একবার মনেও হল, পরের বছরই অবসর। এই বয়সে নিশ্চয় আর ভোট করতে আমাকে বুথে পাঠানো হবে না!
আমার সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে খবর এল। ফের প্রিসাইডিং অফিসারের কাজ। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে দ্বারকা পঞ্চায়েতের বুথের ঘটনা। ভোটের দিন সকালে বিশাল লাইন। মেয়েরা সকাল সকাল ভোট দিয়ে বাড়িতে কাজ সারবে। কিন্তু কেউ ভোট দিতে পারছেন না। বুথের ভিতরে স্থানীয় নেতার সঙ্গে আমার বচসা শুরু হল। তিনি ছাপ্পা দিতে চান। তার কথায় পাত্তা না দিয়ে আমরা সুষ্ঠু ভাবে ভোট পরিচালনা করছি। বেলা ৩টের পর নেতাদের চেহারা বদলে গেল। বুথ জ্যাম করতে শুরু করলেন। সঙ্গে আমাকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য গালিগালাজ। এল প্রাণে মেরে ফেলার শাসানি। জেদ বেড়ে গেল আমারও। কিছুতেই সমঝোতা করব না। জওয়ানদের বলে মোবাইল স্কোয়াডের সাহায্যে তাড়িয়ে দেওয়া হল ওই নেতাদের। সে বার কোনও রকমে প্রাণ হাতে নিয়ে বোলপুর ফিরে আসি। ছাপ্পা হতে না দেওয়ায় গর্ব হয়। তবে ওদের অশ্লীল গালিগালাজ আজও আমাকে অস্থির করে তোলে।
ইতিমধ্যেই দশটা ভোট পরিচালনার অভিজ্ঞতা আমার। তাই দায়িত্ব না এড়িয়ে এ বারও ডিউটি নিলাম। আমাকে পাঠানো হল দুবরাজপুর বিধানসভায়। নিয়োগপত্রে খেয়াল করলাম, ওই কেন্দ্র মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা। তাই বাকিদের তুলনায় দু’ঘণ্টা আগে ভোট শেষ করতে হবে। ১৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৬টায় বাড়ি জয়দেব থেকে বের হলাম। সিউড়ি রামকৃষ্ণ শিল্প বিদ্যাপীঠ আমার যাত্রার লক্ষ্যস্থল। কিন্তু সেখানে সরাসরি যাওয়ার কোনও গাড়ির ব্যবস্থা নেই। কোনও রকমে বাস বদল করে সকাল ৯টা নাগাদ ওই স্কুলে পৌঁছে জানতে পারলাম, আমার ডিউটি পড়েছে খয়রাশোলের হজরতপুর হাইস্কুলে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়! শেষমেশ খয়রাশোল ব্লক! উপাই নেই। তাড়াতাড়ি ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে ভোটযন্ত্র ও কাগজপত্র সংগ্রহ করে মিলিয়ে নিলাম। বেলা ১টা নাগাদ আমার ভোট পরিচালনার সঙ্গীদের নিয়ে বাস ধরতে সিউড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে হাজির হলাম। প্রচণ্ড রোদ, বাতাসে লু বইছে, জল তেষ্টাও পাচ্ছে। একে ভোটের তাপ, সঙ্গে আবার রোদের তাপ! ব্রহ্মতালু শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড়। আমাদের বাস চারটি বুথ যাবে। ইতিমধ্যেই একটি বুথের প্রিসাইডিং অফিসার ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়লেন। বিকাল ৪টে ১৫ মিনিট নাগাদ রিজার্ভ ক্যাটেগরি থেকে নতুন প্রিসাইডিং অফিসার নিয়ে আমরা চারটি দল হজরতপুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
বাস চলছে, মাথায় নানা চিন্তাও ভিড় করছে। বুথ কেমন হবে? পরিবেশ? খাওয়া-দাওয়া কিছু জুটবে তো? সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারব তো? বিকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ আমাদের গাড়ি হাইস্কুলে পৌঁছল। কেন্দ্রীয় বাহিনীর অভ্যর্থনায় বুথে পৌঁছলাম। এই স্কুলে দুটো বুথ ছিল। আমার দল তিনতলা বিল্ডিংয়ে নীচের তলায় দু’নম্বর বুথে ভোট পরিচালনা করবে। এই স্কুলে প্রায় একশো জন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান রয়েছেন। তাঁদের নিয়মানুবর্তিতা এবং কাজের প্রতি দরদ আমাকে অভিভূত করল। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে করতেই বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়া সারছেন। সকাল ৬টায় কয়েক জন জওয়ান একটি হনুমান ও কালীর ছবির সামনে কয়েক মিনিট স্তব করলেন। নাহ! নেই কোনও চোখ রাঙানি, নেই কোনও হুমকি, নেই কোনও অস্বস্তি! বিকেলে স্নান সেরে কিছু টিফিন করে ভোটের কাজের প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম।
ছ’টি পাখা, চারটি লাইট বিশিষ্ট বিশাল কক্ষ নিয়ে আমার বুথ। ইতিমধ্যে সেক্টর অফিস থেকে অফিসার এসে বুথের সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনলেন। একটা চার্জার লাইট, বালতি-মগ ও জল রাখার পাত্র দিয়ে গেলেন। সঙ্গে সাহসও। প্রশাসন জাগ্রত। কোথায় মাওবাদী, কোথায় দুষ্কৃতী, চার দিকে শুধুই নিস্তব্ধতা! কখনও সখনও জওয়ানদের ভারী বুটের শব্দ। রাত ১১টা নাগাদ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের মনোরম রান্না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু ভোটের চিন্তায় রাত১টার পরেই ঘুম ভেঙে গেল। বাকি রাত আধ ঘণ্টা অন্তর বাইরে গিয়েছি আর অবাক চোখে দেখেছি জওয়ানদের অতন্দ্র প্রহরা।
সকাল ৭টায় ভোট শুরু হল। রাজ্যের মূল তিনটি রাজনৈতিক দলের এজেন্টরা উপস্থিত হয়েছেন। পুরুষ ও মহিলাদের সুশৃঙ্খল লাইন। একে একে ভোট দিচ্ছেন আর চলে যাচ্ছেন। বুথের দরজার সামনে এক জন জওয়ান। আর লাইন সামলাচ্ছেন এক জন রাজ্য পুলিশ। বিনা অনুমতিতে একটি মাছিও গলতে পারছে না। নেই কোনও ভিড়, নেই কোনও উত্তেজনা। এজেন্টদের মধ্যেও দারুণ বোঝাপড়া। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া চকোলেট, ওআরএস— সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়া। দুপুরে ভাত-ডাল-মাছ-আলুপোস্ত-চাটনি সহযোগে আহার। মাঝে মাঝে সেক্টর অফিসে তথ্য আদান-প্রদান। বিকেল কাটতেই ভোট শেষ। এজেন্টরা ভোট মেশিন সিল থেকে শুরু করে জিনিসপত্র গোটানো, সবেতেই সহযোগিতা করলেন। রাত ৮টায় কাউন্টারে কাগজপত্র, ভোটযন্ত্র জমা দিয়েই বাড়ি ফেরা!
বাড়ির লোকের উদ্বেগ আর সহকর্মীদের আশঙ্কা দূর হল। একটা সুন্দর স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে ভোটদান প্রক্রিয়া পরিচালনা করে বত্রিশ বছরের কর্মজীবনের সেরা মুহূর্ত উপহার পেলাম। ধন্যবাদ হজরতপুর গ্রামের মানুষকে। ধন্যবাদ নির্বাচন কমিশনকে। আর স্যালুট আমাদের জওয়ানদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy