Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দিল জিতেছেন দিদি, কাজে গতির আশায় উত্তর

হঠাৎ থেমেছিল কনভয়। কালিম্পঙের রাস্তায় লোহাপুলের কাছে। দিনটা ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১১। মুখ্যমন্ত্রী যাবেন ভূমিকম্প বিধ্বস্ত সিকিমে। রাতেই শিলিগুড়ি ফিরবেন। তাঁর ইনোভার কাছে পৌঁছে দেখি বাঁ দিকের জানলার কাচ পড়ে গিয়েছে।

পাহাড়ে মমতা।—ফাইল চিত্র।

পাহাড়ে মমতা।—ফাইল চিত্র।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৬ ০৩:১৬
Share: Save:

হঠাৎ থেমেছিল কনভয়। কালিম্পঙের রাস্তায় লোহাপুলের কাছে।

দিনটা ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১১।

মুখ্যমন্ত্রী যাবেন ভূমিকম্প বিধ্বস্ত সিকিমে। রাতেই শিলিগুড়ি ফিরবেন। তাঁর ইনোভার কাছে পৌঁছে দেখি বাঁ দিকের জানলার কাচ পড়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তখন আমার আলাদা ভাবে পরিচয় ছিল না। মুকুল রায়ের সঙ্গে ছিল। তখন জাহাজ প্রতিমন্ত্রী মুকুলদা গাড়ির ব্যাক সিটে বসেছিলেন।

পাহাড়ের রাস্তায় মেকানিক পাওয়া মুশকিল। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি পৌঁছতেও সময় লাগবে। কারণ, কনভয় থমকে যাওয়ায় দু’দিকেই গাড়ির লম্বা লাইন। সামনে গিয়ে মুকুলদাকে একটু জোরে সে কথা বললাম। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘‘কী করব ভাই! অপেক্ষা করতেই হবে। উপায় কী!’’ ঘটনাচক্রে সে যাত্রা আমি নিজে একটা ইনোভা ভাড়া করে গিয়েছিলাম। বললাম, ‘‘দিদি, আমি যে গাড়িতে এসেছি, সেটায় আপনি যেতে পারেন। সেটাও ইনোভা। আপনার অসুবিধে হবে না।’’

মুখ্যমন্ত্রী বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। তখনই মুকুলদা
বলে ওঠেন, ‘‘ও হচ্ছে আনন্দবাজারের কিশোর। অনেক দিন ধরে চিনি।’’ মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি মিলতেই তাঁর নিরাপত্তা রক্ষীদের ছোটাছুটি শুরু। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাদের ইনোভা পরীক্ষা করিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে হাজির। সফরসঙ্গীরা হইহই করে গাড়িতে উঠে পড়লেন।
আমি আর আমাদের ফটোগ্রাফার কোনও মতে একটা পুলিশের গাড়ির পেছনে উঠলাম।

তিস্তাবাজারের কাছে ফের কনভয় দাঁড়িয়ে গেল। ভাবলাম, গাড়িটায় কোনও গোল হল বুঝি! মুখ্যমন্ত্রীর এক নিরাপত্তারক্ষী ছুটতে ছুটতে এসে বললেন, ‘‘ম্যাডাম খুঁজছেন। তাড়াতাড়ি চলুন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর সামনে দাঁড়ালাম। বললেন, ‘‘তুমি কী রকম ছেলে! আমাকে গাড়ি দিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলে? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি গাড়িতে আছ। ওঠো, গল্প করতে করতে যাব।’’

সেই প্রথম আলাপ। গাড়িতে নানা কথাবার্তার ফাঁকে বুঝলাম, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যে যাচ্ছেন, সিকিম সরকারের সব মহলে সেই বার্তা পৌঁছয়নি। আমি সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক পরামর্শদাতা কে টি গ্যালসেনকে (যিনি পরে সিকিমের স্পিকার হন) ফোন করে সব জানালাম। সিকিমের কৃষিমন্ত্রী রংপোয় মমতাকে স্বাগত জানালেন। ভূমিকম্প বিধ্বস্ত গ্যাংটকের কয়েকটি এলাকা দেখার পরে দুই মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের জন্য একটি তারকা হোটেল কোনও তরফ থেকে ঠিক করা হয়েছিল। সেখানে ঢুকে বিলাসের নানা আয়োজন দেখে হাওয়াই চটি পরা মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা থমকে গেলেন। বললেন, ‘‘এটার মালিক যেন কে?’’ জবাব শোনামাত্র ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘না, না এখানে নয়। কোনও সরকারি জায়গায়।’’

শুরু হয়ে গেল নানা মুনির নানা মত। গোটা ব্যাপারটা ক্রমশ দেরি হচ্ছে দেখে বললাম, ‘‘এনএইচপিসির জিএম-কে আমি চিনি। কালীঘাটের ছেলে। ওঁকে ফোনে ধরছি।’’ এনএইচিপিসি-তেই দুজনের বৈঠক হয়েছিল। রাত ১০টা নাগাদ শিলিগুড়ি ফিরেছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘যোগাযোগ রেখো!’’

যোগাযোগ ধীরে ধীরে বাড়ল। মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে দেখতে বুঝলাম, বাংলাদেশ সীমান্তের বালুরঘাট থেকে ভুটান সীমান্তের জয়ন্তী অবধি বারবার চষে বেড়িয়ে তিনি উত্তরবঙ্গের ‘দিল’ জেতার জন্য মরিয়া। উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি কম। সেটা বাড়ানোর জন্য পাঁচ বছরে কত কিলোমিটার হেঁটেছেন, তার হিসেব কে রাখে! উত্তরবঙ্গে পা দিলেই যেন পাল্টে যান মমতা। ছবি তোলা, গুনগুন করে গান গাওয়া, কোনও আইপিএসকে দিয়ে গিটার বাজানো...। দার্জিলিং বোধ হয় ওঁর সব চেয়ে প্রিয়। না হলে ফি-বছর ৮-১০ বার দার্জিলিঙে আসার কথা তো নয়। যত বিতর্কই হোক, একাধিক বার গোটা নবান্নও যেন উঠে আসত দার্জিলিঙে। মাঝেমধ্যেই গ্লেনারিজে দেখা যেত মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিবকে নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন দিদি।

গ্লেনারিজের সেই আড্ডাতেই এক বার প্রশ্ন করেছিলাম, ‘‘উত্তরবঙ্গে এত হাতির হানা! মানুষ-বন্যপ্রাণ সংঘাত রুখতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা হচ্ছে না কেন!’’ তখনই ঠিক করলেন, মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটা বিশেষ কমিটি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখে রূপরেখা তৈরি করবে। দু’বছর গড়িয়েছে। কমিটি হয়তো আজও কাজ করে চলেছে। হাতি-চিতাবাঘের সঙ্গে মানুষের সংঘাতও চলছে।

ঘটনা এটাই। উত্তরবঙ্গের অনেক ক্ষেত্রেই পরিকল্পনার সঙ্গে রূপায়ণের অনেক ফারাক।

পাঁচ বছরে ৬০ বারের বেশি উত্তরবঙ্গ সফরের সুবাদে পাহাড়-সমতলের জন্য কম পরিকল্পনা করেননি মুখ্যমন্ত্রী। রায়গঞ্জে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল হয়নি বলে তাঁকে অবিরত খোঁচা খেতে হয়। সেখানে দ্রুত গতিতে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে টাকা দিয়েছেন। দু’টোই ‘হাফ-ডান’। আলিপুরদুয়ার জেলা করেছেন, কিন্তু পরিকাঠামোর কাজ ঢিলেঢালা। শিলিগুড়িতে উত্তরকন্যা করেছেন। সেখানে দু’বারের বেশি মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়নি। দক্ষিণ তো দূরের কথা, উত্তরবঙ্গের মন্ত্রীরাও ঘর পাননি। কোচবিহারে মেডিক্যাল কলেজ গড়ার কথা। হলই না। উত্তরবঙ্গে আরও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ দরকার। সেটাও হয় না। ভারী শিল্প তো নেই-ই। উল্টে মালদহে আম, কোচবিহারে তামাক-পাট, হলদিবাড়ির টমেটো-লঙ্কা নির্ভর কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ টানা যায়নি।

এমন কেন হচ্ছে?

মমতা হাঁটা থামিয়ে পাল্টা
প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গে আমার চেয়ে বেশি কোন মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন বলো তো!’’

সত্যিই তো। আপনিই বারবার এসেছেন। গোটা সচিবালয় তুলে এনেছেন। তার পরেও তবে এত প্রকল্প থমকে যায় কেন? বালুরঘাটের নাট্য উৎকর্ষ কেন্দ্র পাঁচ বছরেও না হওয়া, কোচবিহারের উড়ান চালুর পরে বন্ধ হয়ে যাওয়া, ফিল্ম সিটির কাজ না এগোনো, গজলডোবায় মেগা ট্যুরিজম প্রকল্পের কাজ ঢিমেতালে চলা, হেলিকপ্টার সাফারি চালু না হওয়া...। মুখ্যমন্ত্রীর জবাব ছিল, ‘‘একটা প্রকল্প করতে প্রথমে খসড়া বানাতে হয়। চূড়ান্ত হলে বরাদ্দ হয়। টাকা পৌঁছনোর পরে টেন্ডার হয়। বলটা গড়াচ্ছে। আস্তে আস্তে হবে।’’

হবে তো? এ বার কিন্তু মমতার কাছে প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেল।

বছর দেড়েক আগে এক বার যাচ্ছি টাইগার হিল। সেখানে পর্যটকদের জন্য পরিকাঠামো তৈরির কাজ শুরু করতে বলেছিলেন। বললাম, ‘‘দিদি, কাজ-টাজ তো খুব একটা এগোয়নি মনে হচ্ছে।’’ পর্যটন সচিবকে ফোন করে দু’দিনের মধ্যে গিয়ে কাজ শুরুর নির্দেশ দিলেন।

জয়ন্তীর জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে এক বার দেখেন দু’ধারে অনেক গাছ পড়ে আছে। হয়তো ঝড়ে পড়ে গিয়েছিল। বললেন, ‘‘আচ্ছা এগুলো তো নষ্ট হয়ে যাবে। তুলে নিয়ে কাঠ হয় না কেন!’’ বলেছিলাম, ‘‘ওই সব গাছ তুলে কাঠ তৈরির জন্য একটা প্রকল্প রয়েছে। সেই ফাইলটা অনুমোদনের জন্য বহু দিন কলকাতায় পড়ে আছে।’’ হাঁটা থামিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে পরপর কৈফিয়ৎ তলব। দিন পনেরোর মধ্যে ফাইল ‘ক্লিয়ার’।

উত্তরবঙ্গ কি আশা করতে পারে, এই ভাবেই বাকি প্রকল্পগুলোও এ বার অন্তত গতি পাবে?

স্বপ্ন তো অনেক। কত সময় স্বগতোক্তির সুরে মমতাকে বলতে শুনেছি, ‘‘কাজ করতে গিয়ে বাবা, বাধা তো কম নেই। ঘরে-বাইরে যা লড়তে হয় আমাকে!’’ কখনও অস্ফুটে বলেছেন, ‘‘আমার কাজের ইচ্ছেয় ঘাটতি নেই। শুধু বকেঝকে কত আর কাজ করানো যায় বলো?’’

পাঁচ বছরে তাঁর বকাঝকার নমুনা রাজ্যবাসীরা টিভির দৌলতে অনেক দেখেছেন। সে বার সুকনায় ছিলেন। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (এসজেডিএ) বহু কোটি টাকা নয়ছয়ের আশঙ্কা সংক্রান্ত সরকারি ‘নোট’ দেখে চটে গিয়েছিলেন। এক জন অভিযুক্তের নাম করে বলতে শুনেছিলাম, ‘‘ওকে তো জেলে যেতে হবে। কী করে করল এত সব!’’ এক অফিসারকে বললেন, ‘‘আপনারা কি ঘুমোচ্ছিলেন?’’

সেই মামলাতেই মালদহের জেলাশাসককে গ্রেফতার করার দায়ে রাতারাতি পুলিশ কমিশনারকে বদলি করে দেওয়া হয়। কেন? মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, ‘‘ডিএম পদমর্যাদার এক জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হলে গ্রেফতারের আগে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলে জানানো জরুরি।’’ কিন্তু জনমানসে ব্যাপারটা যে ব্যুমেরাং হয়ে গিয়েছিল, সেটাও মনে হয় পরে বুঝেছিলেন। তাঁরই সিআইডি ফের ওই জেলাশাসককে গ্রেফতার করে।

পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ আসনে বসলেও রাজ্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় এখনও পৌঁছনো হয়নি মমতার। সান্দাকফুতে যাওয়া হয়নি। তাঁর অনেক দিনের ইচ্ছে, বসন্তের সময়ে রডোড্রেনডন শোভিত সিঞ্চল বনাঞ্চলের পথে হেঁটে সান্দাকফু যাবেন। এক বার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছিল। পুলিশ ‘ট্রায়াল রান’ করেছিল। কিন্তু হয়ে ওঠেনি।

তাতে কী! বসন্ত আবার আসবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE