Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নায়িকা সংবাদেই কি অশুভ সঙ্কেত

লোকে বলে, তিনি কাজের মানুষ, কাছের মানুষ। তিনি তৃণমূলের সুভাষ চক্রবর্তী, ছোট ভার্সন, নদিয়া এডিশন। একদা কমরেড সুভাষ ‘হোপ ৮৬’ করে হাততালি ও গালাগালি দুই-ই কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু ভোট কুড়োতে মিঠুন চক্রবর্তীকে প্রচার মঞ্চে ‘ডিস্কো ডান্স’ করাতে হয়নি তাঁকে। নদিয়া এডিশন কল্লোল খাঁ-ও যে ভোটে জিততে ‘স্টার’ ভাড়া করে আনতে পারেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না কারও।

কল্লোল খাঁ-র সমর্থনে প্রচারে শুভশ্রী।—ফাইল চিত্র

কল্লোল খাঁ-র সমর্থনে প্রচারে শুভশ্রী।—ফাইল চিত্র

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৫৫
Share: Save:

লোকে বলে, তিনি কাজের মানুষ, কাছের মানুষ।

তিনি তৃণমূলের সুভাষ চক্রবর্তী, ছোট ভার্সন, নদিয়া এডিশন।

একদা কমরেড সুভাষ ‘হোপ ৮৬’ করে হাততালি ও গালাগালি দুই-ই কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু ভোট কুড়োতে মিঠুন চক্রবর্তীকে প্রচার মঞ্চে ‘ডিস্কো ডান্স’ করাতে হয়নি তাঁকে।

নদিয়া এডিশন কল্লোল খাঁ-ও যে ভোটে জিততে ‘স্টার’ ভাড়া করে আনতে পারেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না কারও।

চৌগাছা মোড় থেকে হুডখোলা গাড়ি বাগানপাড়ার দিকে বাঁক নিতেই ফিসফিস তাই শুরু হয়ে গিয়েছিল।

গাড়ির মাথায় ঘাসফুল আঁকা বিশাল ছাতা। পাশাপাশি হাত জোড় করা কল্লোল আর হাত নাড়া শুভশ্রী (অভিনেত্রী)। পিছনে মোটরবাইকের মিছিল। জাতীয় সড়ক থেকে রোড-শো ঢুকে গেল গ্রামের রাস্তায়।

রাস্তার পাশেই মিষ্টির দোকানে তখন বসে এলাকার কিছু যুবক। কে যেন প্রশ্নটা খুঁচিয়ে দিলেন— ‘‘কিছু বুঝলেন?’’ উত্তর: ‘‘সেটাই তো ভাবছি। তিন বারের বিধায়ক। তবু জেতার জন্য নায়িকা আনতে হল!’’ আগে থেকে ‘নায়িকা সংবাদ’ থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় তেমন ভিড় ছিল না। এককথায়, শো ফ্লপ।

কিন্তু প্রশ্নটা অন্য। কল্লোল খাঁ-কে তারকা আনতে হল কেন?

এলাকায় ভদ্রলোক বলে সুনাম আছে কল্লোলের। এক সময়ে মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগও ছিল। কাজ একেবারে করেননি, তা নয়। সকাল-বিকেল নিয়ম করে ফিরিস্তিও দিচ্ছেন — সরকারি কলেজ, দমকল, ইংরেজি মাধ্যম মডেল স্কুল, দু’টি কিসান মান্ডি, হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো, ফ্লাড সেন্টার, দু’টি সংখ্যালঘু হস্টেল, সব্জি বাজার, গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ...।

কল্লোলের কথায়, ‘‘আমি উন্নয়ন বুঝি। কাজ করে যাই।’’ তাঁর এলাকায় একেবারেই কাজ হয়নি, এ কথা ঘোর শত্রুও বলতে পারবেন না। ব্যক্তি-কল্লোল নিয়েও বিশেষ অভিযোগ নেই কারও। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, সিপিএম প্রার্থী তন্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ও এ নিয়ে কিছু বলছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যক্তি মানুষকে নিয়ে আমি কিছু বলব না। তবে তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-জনপ্রতিনিধির সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপোষণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।’’

তৃণমূল সূত্রেও উঠে আসছে একই ব্যাখ্যা। তাঁদের আক্ষেপ, কল্লোলকে যাঁরা ঘিরে থাকেন, দলের সেই সব ব্লক নেতা থেকে পঞ্চায়েত স্তরের সদস্যদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে ক’বছরে। তাদের সীমাহীন ঔদ্ধত্যই মানুষকে তৃণমূল-বিমুখ করে তুলছে। তাদের টপকে ‘দাদার’ কাছে পৌঁছতেও নাকি বেগ পেতে হয়। এ সবের প্রভাব পড়তে পারে ভোটে।

তা ছাড়া ভোটের অঙ্কটাও একটু জটিল। কেননা একের পর এক ভোটে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোট কমেছে।

২০১১ সালে পরিবর্তনের ভোটে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার ভোটে বাম প্রার্থীকে হারিয়েছিলেন কল্লোল। সে বার কংগ্রেস-তৃণমূল জোট প্রায় ৪৯ শতাংশ ভোট পায়। দু’বছর পরে, একলা লড়ে ওই এলাকায় তৃণমূল পায় প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট। কংগ্রেসের ভোট ছেড়ে দিলে যা ৪৪ শতাংশের কমে নামা উচিত ছিল না। বামেদেরও ভোট প্রায় দুই শতাংশ কমে ৩৭ শতাংশে দাঁড়ায়। এলাকার ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৮টি দখল করে তৃণমূল। ৩টি সিপিএম, একটি সিপিএম-কংগ্রেস যৌথ ভাবে এবং কল্লোলের নিজের এলাকায় মুড়াগাছা পঞ্চায়েত দখল করে বিজেপি। নাকাশিপাড়া পঞ্চায়েত সমিতিতে জেতে সিপিএম। তিনটি জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে তৃণমূল পায় একটি, বাকি বামেরা।

২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রায় ১০ শতাংশ ভোট ছিনিয়ে নেয় তৃণমূলের থেকে। ১১ শতাংশ ভোট খোয়ায় সিপিএমও। বামেদের পিছনে ফেলে দিয়ে বিজেপি উঠে আসে দ্বিতীয় স্থানে। এ বার যদি তারা সেই ভোট ধরে রাখতে না পারে এবং যার ভোট তার ঘরে ফিরে যায়, তা হলে কিন্তু লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হয়ে যেতে পারে। কেননা সে ক্ষেত্রে তৃণমূল পেতে পারে ৪৫ শতাংশ ভোট, আর কংগ্রেস-সিপিএম জোট ৪৩ শতাংশ। এটুকু ফারাক যখন-তখন এ দিক-ও দিক হয়ে যেতে পারে। কল্লোল কেন শুভশ্রীকে ডেকে এনেছেন, তার একটা ইঙ্গিত এখান থেকেই বোধহয় মিলছে।

কল্লোলের বিরুদ্ধে সিপিএমও দাঁড় করিয়েছে নিজের এলাকায় ‘কাজের মানুষ’ বলে পরিচিত এক জনকে। নাকাশিপাড়া পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি তন্ময়ই বকলমে সমিতির যাবতীয় কাজ সামলান বলে জানে এলাকার লোকে। অসম্ভব খাটতে পারেন। লোকটিও সাদাসিধে। এই কাঠফাঁটা রোদেও রবারের চপ্পল পড়ে তিনি হেঁটে চলেছেন প্রামের পর গ্রাম। সঙ্গে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কংগ্রেসও। তাঁর দাবি, নেতাদের চালচলনে বিরক্ত হয়ে তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মীও তাঁর হয়ে খাটছেন।

ঘড়ি ধরে সকাল ৭টায় বেরিয়ে পড়ছেন তন্ময়। তার পর শুধু হাঁটা আর হাঁটা। কাঁধে তোয়ালে। মাঝে- মধ্যে মুখ মুছে নিচ্ছেন তাতে। আর ঢকঢক করে জল। গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকছে ঘামে ভেজা জামা। বুথে বুথে মিটিং হয়ে গিয়েছে আগেই। এখন দিনে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার হাঁটছেন। কখনও লছিমন বা টোটো গাড়িতে করে ‘রোড-শো’ও করছেন। এই গরমে এত পরিশ্রম, শেষে অসুস্থ্ হয়ে পড়বেন না তো? চটজলদি জবাব— ‘‘না, আমি এতে অভ্যস্ত। এসি গাড়িতে চড়লেই বরং অসুস্থ্ হয়ে পড়ি। হাঁটার অভ্যেসটা আছে বলেই হুডখোলা গাড়ির দরকার হচ্ছে না।’’

খোঁচাটা কার দিকে, তা স্পষ্ট।

কুর্সির কাছে কে প্রথম পৌঁছবে, ধুলোমাখা চাকা নাকি ঘর্মাক্ত শ্রীচরণ, তা কিন্তু বলবে বিজেপি।

উঁহু, বিজেপি নেতারা নন। বরং পদ্ম-ছুট ভ্রমরের দল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE