Advertisement
০৬ মে ২০২৪

রক্তে-ভেজা ‘উৎসব’ চায় না বাংলা

রাজনৈতিক নেতারা বহু দিন ধরেই বলে আসছেন, ভোট নিয়ে এমন হানাহানি দেশের আর কোনও রাজ্যে হয় না, যেমনটা ঘটে বাংলায়। ভোটের আগে-পরে অসংখ্য খুনোখুনি, রক্তপাতের সাক্ষী এই রাজ্য। কংগ্রেস আমল থেকে শুরু করে বামজমানা হয়ে ঘাসফুলের হাতে ক্ষমতা আসার পরেও ‘ট্র্যাডিশন’ কিছুই বদলায়নি।

বনগাঁর একটি গণনাকেন্দ্রের বাইরে নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

বনগাঁর একটি গণনাকেন্দ্রের বাইরে নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ০২:১১
Share: Save:

রাজনৈতিক নেতারা বহু দিন ধরেই বলে আসছেন, ভোট নিয়ে এমন হানাহানি দেশের আর কোনও রাজ্যে হয় না, যেমনটা ঘটে বাংলায়। ভোটের আগে-পরে অসংখ্য খুনোখুনি, রক্তপাতের সাক্ষী এই রাজ্য। কংগ্রেস আমল থেকে শুরু করে বামজমানা হয়ে ঘাসফুলের হাতে ক্ষমতা আসার পরেও ‘ট্র্যাডিশন’ কিছুই বদলায়নি। ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’র বদল না ঘটলে, বিভিন্ন দলগুলির দৃষ্টিভঙ্গী না বদলালে এই ‘বদলার রাজনীতি’তে ছেদ পড়বে না বলেই মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকেরা।

তবে এ বার বিধানসভা ভোটের শেষ কয়েকটি পর্বে অভূতপূর্ব আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যদিও ভোটের আগে প্রচার পর্বে শাসক দল বারবারই হুমকি দিয়ে এসেছে, নির্বাচন কমিশন কিংবা কেন্দ্রীয় বাহিনী দু’চার দিনের অতিথি মাত্র। তারা ফিরে গেলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় ভরসা কিন্তু সেই রাজ্য পুলিশই!

এই আবহেই আজ, বৃহস্পতিবার রাজ্যের ২৯৪ কেন্দ্রে ভোটের ফল বেরোতে চলেছে। বুথ ফেরত সমীক্ষায় অনেকেই এগিয়ে রেখেছেন ঘাসফুল শিবিরকে। তুলনায় আত্মবিশ্বাসী তারা। অন্য দিকে, সমীক্ষার ফলে জোট শিবিরের উল্লসিত হওয়ার তেমন কারণ না থাকলেও ‘মানুষের রায়’-এর উপরে ভরসা রাখতে বলেই কর্মী-সমর্থকদের মনোবল শেষ লগ্ন পর্যন্ত ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাম-কংগ্রেস শিবির।

কিন্তু ফলাফল যা-ই হোক না কেন, হিংসা-সন্ত্রাস-খুনোখুনি যেন না হয়, সে দিকেই তাকিয়ে বাংলার আমজনতা। শহর ছাড়িয়ে শহরতলি কিংবা গ্রামেও অনেক মানুষই বলছেন, ‘‘ফলাফল যেমনই হোক, রাজ্যটায় শান্তি যেন থাকে। কোনও মায়ের কোল যেন খালি না হয়!’’

এই পরিস্থিতিতে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস রুখতে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে। সেই পুলিশ, টেবিলের তলায় ফাইলে মুখ ঢাকা চেহারাটা কিছু দিনের জন্য হলেও ভোট-পর্ব চলাকালীন বদলে ফেলে মানুষের অকুণ্ঠ শুভেচ্ছা কুড়িয়ে নিয়েছে যারা। ভোটের ফল বেরোনোর পরে অশান্তি ঠেকাতে পুলিশের কোন মুখ দেখবে বাংলার মানুষ, সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।

শান্তি বজায় রাখতে রাজনৈতিক দলগুলির সদিচ্ছার উপরেও ভরসা রাখতেই হবে। শুধু মাত্র পুলিশ-প্রশাসনের ভরসায় রক্তপাত বন্ধ করা যাবে, এমনটা ভাবার কোনও অবকাশ নেই। রাজনৈতিক দলগুলি অবশ্য মুখে সেই ‘সদিচ্ছা’র কথাই বলছে। তৃণমূল বা সিপিএম উত্তর ২৪ পরগনায় অন্তত কেউ-ই বিজয় মিছিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, অতীতে দেখা গিয়েছে, বিজয় মিছিল থেকে বিপক্ষ শিবিরের উপরে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।

যদিও ফল প্রকাশের আগের দিন, বুধবারই আমডাঙার টেঙাটেঙিতে ২৬টি বোমা উদ্ধার হয়েছে। সেগুলি রাখা ছিল মাঠের ধারে একটি ঝোপের আড়ালে। খবর পেয়ে সিআইডি অফিসারেরা গিয়ে বোমা উদ্ধার করেন।

জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা রাজ্যের বিদায়ী খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেন, ‘‘জেলায় আমাদের জনপ্রতিনিধি ও নেতৃত্বকে বলে দেওয়া হয়েছে, কোথাও বিজয় মিছিল করা যাবে না। কোথাও কোনও অশান্তি করা যাবে না।’’ জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানান, কর্মীদের বলা হয়েছে, সিপিএম বা কংগ্রেসের কেউ যদি অশান্তি বাধানোর চেষ্টা করে, তা হলেও প্ররোচনায় পা দেওয়া চলবে না। প্রয়োজনে স্থানীয় থানাকে জানিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। দলের এই নির্দেশ না মানতে কড়া পদক্ষেপ করা হবে। এ হেন কড়াকড়ির কারণ হিসাবে জ্যোতিপ্রিয়বাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘আমাদের এখন থেকেই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।’’ জেলা তৃণমূলের ওই নির্দেশ কর্মী-সমর্থকেরা কতটা মানবেন, তা নিয়ে অবশ্য দলের অন্দরেই সংশয় আছে!

সিপিএমও কর্মী-সমর্থকদের বিজয় মিছিল না করার নির্দেশ দিয়েছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘‘মানুষের কাছে আমাদের যোগ্যতর করে তুলতে হবে। দলের প্রতিটি ইউনিটকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিজয় মিছিল করা যাবে না। কর্মীদের বলা হয়েছে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে গঠনমূলক কাজ করে যেতে হবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আক্রমণ হলে ধৈর্য্যের সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে তার প্রতিবাদ করা হবে।’’

জেলা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পুলিশ সুপার, জেলাশাসক, মহকুমাশাসকদের উপরে চাপ রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি কর্মীদের সংযত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা কংগ্রেস সভাপতি (গ্রামীণ) অমিত মজুমদার বলেন, ‘‘বামেদের সঙ্গে যৌথ ভাবে আমরা প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক ভাবে হিংসা-হামলা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েছি।’

বিজেপি অবশ্য ফলপ্রকাশের পরে হিংসা বা সন্ত্রাস নিয়ে ততটা ভাবিত নয়। দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, জেলায় যে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় গোলমাল বাধতে পারে বলে তাঁদের সংশয় আছে, তা ইতিমধ্যেই পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে জানানো হয়েছে।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, সর্তকতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ইতিমধ্যেই জেলার বেশ কিছু এলাকা (যেখানে গণনা পরবর্তী হিংসা হতে পারে বলে আশঙ্কা) চিহ্নিত করা হয়েছে। এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘ওই সব এলাকায় ইতিমধ্যেই পুলিশ মোতায়েন শুরু হয়েছে। সর্বক্ষণের জন্য থাকছে মোবাইল টহল। খবর পাওয়া মাত্রই দ্রুত ছুটে যাবে পুলিশ।

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে পুলিশ কমিশনার নিজে নজর রাখবেন পরিস্থিতির উপরে। ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসক পীযূষ গোস্বামী বলেন, ‘‘গণনা চলাকালীন বা গণনা পরবর্তী সময় যাতে কোনও বিশৃঙ্খলা না হয়, সে জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’

গণনা পরবর্তী হিংসা ঠেকাতে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে বসিরহাট মহকুমা পুলিশও। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কেবলমাত্র বসিরহাট শহরেই ৮টি গাড়ি এবং ১০টি মোটর বাইকে নিরাপত্তা কর্মীরা বের হবেন। থাকছে ৩ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং প্রচুর রাজ্য পুলিশ।

কাকদ্বীপে তৃণমূলের তরফে বলা হয়েছে, বিজয় মিছিল হবে না। কাকদ্বীপের তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা ক্ষমতায় ফেরার ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। বললেন, ‘‘আমরাই ক্ষমতায় আসছি। তাই হিংসা ঠেকাতে আমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে হিংসা না ছড়ায়।’’

কাকদ্বীপের কংগ্রেস প্রার্থী রফিকউদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘‘আমরা বলে দিয়েছি, কাউকে প্ররোচনা দেবেন না। নিজেরাও প্ররোচনায় পা দেবেন না। এ রকম ঘটনায় কিন্তু দল পাশে দাঁড়াবে না।’’

রাজনৈতিক দলগুলি যা-ই বলুক, পুলিশ-প্রশাসনের সতর্ক থাকছে। কাকদ্বীপ মহকুমা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গণনাকেন্দ্র ঘিরে ত্রি-স্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। পুলিশ কর্তারা আশা করছেন, প্রস্তুতি যে রকম নেওয়া হয়েছে, তাতে হিংসার ঘটনা এড়ানো যাবে।

ক্যানিঙে ফল প্রকাশের পরে যাতে এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে, সে জন্য প্রশাসনের তরফে প্রতিটি থানা এলাকায় তিনটি করে পুলিশের টহলদারি গাড়ি ঘুরবে। ক্যানিং পশ্চিম কেন্দ্রের জোট প্রার্থী কংগ্রেসের অর্ণব রায় বলেন, ‘‘আমি আগে থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছি।’’ ক্যানিং পশ্চিম কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী শ্যামল মণ্ডল বলেন, ‘‘আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব, যাতে কোথাও গণ্ডগোল না হয়।’’ ক্যানিং পূর্ব কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সওকত মোল্লা বলেন, ‘‘গণনার পরে এলাকায় কোনও গণ্ডগোল বরদাস্ত করা হবে না। এ জন্য কর্মীদের বৈঠকে ডেকে সাবধান করা হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Result Vote
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE