Advertisement
০৫ মে ২০২৪
নজরে বিনপুর

‘ভোট তো হয়েই গিয়েছে!’ নিরুত্তাপ পুরনো মাও-ঘাঁটি

চৈত্রের চাঁদিফাটা রোদে গেরস্তরা মাটির বাড়ির ভিতর সেঁধিয়ে গিয়েছেন। ডাকাই গ্রামের বেশির ভাগ মাটির বাড়ির দেওয়াল জুড়ে শুধু তৃণমূল প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ হেমব্রমের প্রচার লিখন। পাহাড়ি চাষের জমিরও দখল নিয়েছে ঘাসফুলের পতাকা। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেও তৃণমূলের দলীয় পতাকা উড়ছে। কে বলবে এক সময়ে এই ডাকাই গ্রামেই ছিল মাওবাদীদের খাসতালুক!

কাঁকড়াঝোরে চলছে রাজ্য পুলিশের টহল। —দেবরাজ ঘোষ।

কাঁকড়াঝোরে চলছে রাজ্য পুলিশের টহল। —দেবরাজ ঘোষ।

কিংশুক গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ০১:২৬
Share: Save:

চৈত্রের চাঁদিফাটা রোদে গেরস্তরা মাটির বাড়ির ভিতর সেঁধিয়ে গিয়েছেন। ডাকাই গ্রামের বেশির ভাগ মাটির বাড়ির দেওয়াল জুড়ে শুধু তৃণমূল প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ হেমব্রমের প্রচার লিখন। পাহাড়ি চাষের জমিরও দখল নিয়েছে ঘাসফুলের পতাকা। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেও তৃণমূলের দলীয় পতাকা উড়ছে। কে বলবে এক সময়ে এই ডাকাই গ্রামেই ছিল মাওবাদীদের খাসতালুক!

ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়া থানার পচাপানির লাগালাগি ডাকাই গ্রামে কয়েক বছর আগে দিনের বেলাতেও বাইরের লোকজন ঢুকতে ভয় পেতেন। ভোট বয়কটে সাড়া দিত যে গ্রাম, এ বার সেই গ্রামের সব ভোট তৃণমূলের!

রবিবার গ্রামে ঢোকার মুখে গরুর গাড়ি তৈরির জন্য মোটা বাঁশ কাটছিলেন এক যুবক। ভোট কেমন হবে জানতে চাওয়া হলে এ দিক সে দিকে তাকিয়ে বলেন, “ভোট তো হয়ে গিয়েছে!” সে কী! ভোট তো ৪ এপ্রিল সোমবার। এ বার গামছায় ঘাম মুছে যুবক ফিসফিসিয়ে বলেন, “আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছে সব ভোট এ বার তৃণমূলের। যে দেবে না তার কপালে দুঃখ আছে।” কে ঠিক করল? উত্তর, “বলা যাবে না।”

কিছুদূর এগোতেই ভাঙা সাইকেল ঠেলে পাহাড়ি রাস্তার চড়াই পেরিয়ে আসছিলেন এক প্রৌঢ়। তাঁর কথায়, “আগে মাওবাদীদের কথায় কখনও ভোট বয়কট, কখনও আবার মাওবাদী ফতোয়ায় পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য হতেন এলাকার ভোটাররা। এখন মাও দলের সাঙাৎ গুলো তৃণমূলে নাম লিখিয়েছে। ওরা বলেছে এ বার জোড়া ফুলে সব ভোট। না হলে পঞ্চায়েতের পরিষেবা মিলবে না। আরও অনেক বিপদ।” কথা না বাড়িয়ে শিমূলপালের দিকে হাঁটা দেন।

রোদের তাপে পাহাড়ি লালমাটি থেকে গরম ভাপ উঠছে। তার মধ্যেই ডাকাই গ্রামের স্কুলপাড়ায় একটি মাটির বাড়ির দাওয়ায় বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বসেছিলেন তৃণমূলের ডাকাই বুথের সভাপতি ব্রজেন মুণ্ডা। ব্যাগের ভিতর ছিল এলাকার ভোটারদের তালিকা। ‘ভোট নিশ্চিত করণ কর্মসূচি’ চলছে। উল্টোদিকের মাটির দাওয়ায় বসেছিলেন আরও জনা পাঁচেক দলীয় কর্মী। তাঁদের একজন পেশায় মাছ বিক্রেতা অমিয়কুমার সিংহ মাছ ফেরি করতে বেরোননি। হেসে অমিয়বাবু বলেন, “মাছ তো বেচতে বেরবো সোমবার ভোটের দিন। আজ অনেক কাজ।”

বদাডি মোড় থেকে শিমূলপাল পর্যন্ত রাস্তা তৈরির কাজ চলেছে জোর কদমে। কিন্তু ডাকাই গ্রামে এখনও রাস্তা বলতে তো কিছুই নেই। পানীয় জলেরও সঙ্কট তীব্র। পুকুর, খাল-বিল শুকিয়ে কাঠ। এ বার গলা খাঁকারি দিয়ে ব্রজেন বলেন, “রাস্তা যাতে তৈরি হয় সেই জন্যই তো এলাকার মানুষ জোড়াফুলে ভোটটা দেবেন।”

জানা গেল সিপিএম প্রার্থী দিবাকর হাঁসদা গ্রামে প্রচারে এসেছিলেন। তৃণমূল প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ হেমব্রম এলাকায় আসেননি। তাতে কোনও প্রভাব পড়বে না? ডাকাইয়ের এক যুবক বলেন, “গ্রামে গ্রামে নাগাড়ে হুমকি-চাপ দেওয়া হচ্ছে। সব ভোট ওরা নেবেই।”

কাঁকড়াঝোর যাওয়ার পথে সার দিয়ে তৃণমূলের পতাকা। কাঁকড়াঝোরে গিয়ে দেখা গেল মোটরবাইকে টহল দিচ্ছেন কয়েকজন রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের জওয়ান। সঙ্গী আলোকচিত্রী ছবি তুলতেই কয়েকজন পুলিশ কর্মী অশ্লীল গালিগালাজ শুরু করলেন। সেখান থেকে কাঁকড়াঝোরের ঘাটশিলা মোড়ে রাজ্য পুলিশের নাকা চলছে। গাড়ি পরীক্ষা করার পরে সংবাদপত্রের নাম জেনে পুরুলিয়া থেকে আসা পুলিশ কর্মীর বক্তব্য, ‘‘আপনারা বড্ড বেশি শাসকবিরোধী খবর করেন। সাবধানে যান।” কাঁকড়াঝোর হাটচালায় আরও কিছু রাজ্য পুলিশ। স্থানীয় সিআরপি ক্যাম্পের জওয়ানদের অবশ্য দেখা গেল না।

ছুরিমারা গ্রামেও সব বাড়িতে তৃণমূলের পতাকা উড়ছে। জামবনি ব্লকের পড়িহাটিতেও একই ছবি। তৃণমূলের স্থানীয় বুথ কমিটির সম্পাদক কাদের খান হেসে বলেন, “গত বার এই আসন আমরা পাইনি। এ বার একটা ভোটও সিপিএম পাবে না।” কীভাবে? জামবনির বাঁকবেড় মোড়ে জোড়াফুলের ছাপ দেওয়া গেঞ্জি পরা কয়েকজন তৃণমূল কর্মী বুথে যাওয়ার রাস্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেওয়া পোস্টার সাঁটাচ্ছিলেন। তাঁরা জানালেন বাঁকবেড় বুথে বারোশ ভোটার। বেলা বারোটার মধ্যে সব ভোট হয়ে যাবে। এক তৃণমূল কর্মী গলা চড়িয়ে বললেন, “ভোট ভাগাভাগির জায়গাই নেই। সব ভোট তৃণমূল। সেই বন্দোবস্তই হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 maoist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE