Advertisement
E-Paper

বন্দিদশা ঘুচিয়ে বিশ্বনাথ আবার ঘরের লোক

সকাল ৮টা। বালুরঘাট শহরের মঙ্গলপুরে আর্যসমিতি মোড় থেকে রোড শো-র প্রস্তুতি নিয়ে বাম-কংগ্রেস জোটের কর্মী সমর্থকদের ব্যস্ততা তুঙ্গে।

অনুপরতন মোহান্ত

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩১
নাতিকে কোলে নিয়ে বিশ্বনাথ চৌধুরী। ছবি: অমিত মোহান্ত।

নাতিকে কোলে নিয়ে বিশ্বনাথ চৌধুরী। ছবি: অমিত মোহান্ত।

সকাল ৮টা। বালুরঘাট শহরের মঙ্গলপুরে আর্যসমিতি মোড় থেকে রোড শো-র প্রস্তুতি নিয়ে বাম-কংগ্রেস জোটের কর্মী সমর্থকদের ব্যস্ততা তুঙ্গে।

সাড়ে সাতটার মধ্যে শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাড়িতে ধুতি পাঞ্জাবি পরে তৈরি জোট প্রার্থী আরএসপির বিশ্বনাথ চৌধুরী। তার আগে কাকভোরেই বিশ্বনাথবাবু স্ত্রী তৈরি করে ফেলেছেন প্রাতরাশ। ছাতু-মুড়ি খেয়ে চায়ের কাপে মুখ দিতেই কলিং বেলের শব্দে ছোট্ট নাতি গুটি গুটি পায়ে বিশ্বনাথবাবুর বৈঠকখানায় হাজির। বিশ্বনাথের কথায়, ‘‘এই এক মুশকিল। বাড়িতে কেউ এসেছে টের পেলেই হল। বিছানা থেকে ঠিক উঠে আমাকে খুঁজবে।’’ তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট কালী কর তখন এসে বললেন, ‘‘বিশ্বনাথদা সব তৈরি।’’

চায়ের কাপ নামিয়ে বাড়ির ট্যাক্সিতে চেপে সোজা আর্যসমিতি মোড়ে নামতেই এগিয়ে এসে কংগ্রেস নেতা দিলীপ গুহ বললেন, ‘‘বিশ্বনাথদা টুপিটা পরে নিন। খুব রোদ।’’ হুড খোলা ছোট ভ্যান গাড়িতে উঠলেন। পাশে জোটের নেতারা। বিশ্বনাথবাবুর গাড়িকে মাঝখানে রেখে সামনে-পিছনে জোটের বিশাল মিছিল। গাড়ির আগে আগে পায়ে হেঁটে চলছেন আরএসপি নেত্রী সুচেতা বিশ্বাস, অলোক চক্রবর্তী, সিপিএমের শিক্ষক নেতা প্রসাদ দাস, ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রবীর দাস, সিপিএমের কাউন্সিলার অরিজিৎ চন্দদের মতো অগুনতি নেতা-কর্মী। সঙ্গে লাল-তেরঙ্গা পতাকা হাতে নিয়ে পা মিলিয়েছেন বাম-কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা।

বিশ্বনাথবাবুর মিছিল নেপালিপাড়ার রাস্তা ধরে নামাবঙ্গি এলাকা হয়ে যোগমায়া পল্লির গলির রাস্তা দিয়ে যত এগিয়েছে, মহিলা-পুরুষ সকলে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে স্বাগত জানিয়েছেন। সদর রাস্তায় গিয়ে মিছিল শেষ হতেই গাড়ি থেকে নেমে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বিশ্বনাথবাবু বোতল খুলে জল খেলেন। বসলেন মোড়ের চায়ের দোকানে। এক রিকশাচালক কাছে এসে বললেন, ‘‘বিশ্বনাথদা চালিয়ে যান। আমরা আছি।’’ দু-টিপ নস্যি নিয়ে হেসে বিশ্বনাথ তাঁকে বললেন, ‘‘বাড়ির সকলে ভাল আছে তো?’’ রিকশাচালক মাথা নিচু করে বলেন, ‘‘কী বলব বিশ্বনাথদা! এত ছোট শহরে প্রায় চার হাজার টোটো চললে কি আমাদের রোজগার থাকে!’’

এই বিশ্বনাথ চৌধুরীকেই বরাবর চিনত বালুরঘাট। টানা ছ’দফার মন্ত্রী এই বিশ্বনাথবাবু বালুরঘাটের ঘরের লোক, যাঁকে সব মনের কথা বলা যায়। মন্ত্রী ছিলেন তো কী হয়েছে, পাড়ার দোকানেই চলে যেতেন চুল-দাড়ি ছাঁটতে। রাস্তায় বসে আড্ডা দিতেও আটকায়নি কখনও। খোদ জ্যোতি বসুও স্বীকার করতেন, বিশ্বনাথবাবুর নাড়ির যোগ নিজের শহরের সঙ্গে। একবার বালুরঘাটে বন্যা হয়েছে। সে খবর পেয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, ‘‘ব্যস! বিশ্বনাথকে আর কলকাতায় পাওয়া যাবে না!’’ কিন্তু গতবার হেরে যাওয়ার পরে দাপুটে কারামন্ত্রী নিজেকে এক রকম গৃহবন্দি করে ফেলেন। পাড়ার সেলুনে যেতেন না। নাপিতকে বাড়িতে ডেকে নিতেন। বাড়ির সামনে দোকানপাট, এমনকী বাজারেও যেতেন না আর। যাওয়ার মধ্যে ছিল শুধু পার্টি অফিস।

এ বার জোটের হাওয়ায় সেই বন্দিদশা ঘুচেছে। তেমনই এক প্রচারে দু’দিন আগে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ হিলির বালুপাড়া থেকে যখন হেঁটে ফিরছিলেন, আগের মতোই রাস্তায় দেখা স্থানীয় বাসিন্দা এক প্রবীণের সঙ্গে। লাঠি নিয়ে বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বিশ্বনাথবাবুকে বললেন, ‘‘তোমায় দেখে ভাল লাগছে।’’

বিশ্বনাথবাবু বললেন, ‘‘এত রোদের মধ্যে কেন বেরিয়েছেন?’’

বৃদ্ধের উত্তর, ‘‘কী করব বলো! স্ত্রী ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। এখানকার রেশন দোকান থেকে চাল নিয়ে এখন কেরোসিন তেল আনতে দূরে হিলি সদর বাজারের রেশন দোকানে যেতে হবে। এই বয়সে কি সম্ভব?’’পাঞ্জুল এলাকায় যেতে খেতের কাজ ছেড়ে রাস্তায় উঠে এক দিনমজুর তাঁর হাতে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘‘বিশ্বনাথদা হ্যান্ডশেক।’’ তাঁর মুখেও একই কথা, ‘‘দাদা এ বার জমানা পাল্টে দিন। রেশনের চাল তুলতে ত্রিমোহিনী এলাকায় যেতে হয়। তেল-চিনি তুলতে আবার পাঞ্জুলে গিয়ে লাইন দাও। এতেই তো দু’টো কাজের দিন নষ্ট।’’

হিলির জামালপুরে মানিকো এলাকায় গিয়ে অশীতিপর এক বৃদ্ধাকে দেখে বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘কী বুড়ি চিনতে পারছো? আমি বিশ্বনাথ। যত বার এখানে এসে মিটিং করেছি, তত বার তুমি খাওয়ার জল দিয়ে গিয়েছো।’’ বৃদ্ধা ফুলিদেবী চোখে কম দেখেন। বলেন, ‘‘ও তুই বিশ্বনাথ! বাবা বেঁচে থাক। তুই সে সময় আমার বার্ধ্যক্যভাতা করে না দিলে এত দিনে আমি না খেয়েই মরে যেতাম।’’

বালুরঘাট শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার এক সময়ের বিখ্যাত ঘড়ি সারাইয়ের মিস্ত্রি বৃদ্ধ প্রফুল্ল কর্মকার আর বাড়ি থেকে বের হতে পারেন না। কিন্তু বিশ্বনাথবাবু প্রচারে এসেছেন শুনে চঞ্চল হয়ে ওঠেন। বলেন, ‘‘ওঁর জন্য আমরা বার্ধক্যভাতা পেয়ে বেঁচে আছি। ওঁর মতো ভাল ব্যবহার ক’জনের আছে?’’ প্রফুল্লবাবুর সঙ্গে আরও কয়েক জন প্রবীণ ছিলেন।

হাসি মুখে তাঁদের দিকে হাত নেড়ে জোটকর্মীদের পায়ে পায়ে যত এগিয়ে চলেছেন বালুরঘাটের বিশ্বনাথ, ততই কপালে ভাঁজ গভীর হচ্ছে তৃণমূল প্রার্থী শঙ্করের।

biswanath chowdhury assembly election 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy