ঝান্ডা হাতেই দর কষাকষি চলছে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
ঠা ঠা করছে রোদ্দুর। চৈত্রের দুপুরে চাঁদি ফেটে যাওয়ার জোগাড়। গনগনে সেই আঁচে কোথায় আর ‘ঠান্ডা ঠান্ডা, কুল কুল’ থাকা যায়। জোড়াফুলের ছাপ দেওয়া টি-শার্ট ঘামে লেপ্টে রয়েছে গায়ে। আর এক পা-ও চলা দায়। কচি ডাব দেখেই সকলের অলক্ষে মিছিল থেকে টুপ করে খসে পড়েছিলেন তৃণমূলের এক যুব নেতা মিরাজুল ইসলাম।
—‘কী ভাই কত?’
পকেট থেকে সবে মানিব্যাগটা বের করতে যাবেন, দাম শুনেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া। ‘বল কী হে... এইটুকু ডাব ২০ টাকা!’
শুরু হল দাম নিয়ে দর কষাকষি। কুড়ি টাকা তো কুড়ি টাকাই। এক পয়সাও কমাবেন না ডাবওয়ালা। নাছোড় নেতাও। শেষতক বলেই ফেললেন, ‘‘আমার গাছের ডাব কে খায়! নেহাত গাছে ওঠার লোক নেই। আর আমাকেই কি না ডাবের দাম শোনাচ্ছে!’’
—‘তা হলে কর্তা এত কথায় কাজ নেই। নিজের গাছ থেকেই পেড়ে খান।’ বিক্রিবাট্টার তোয়াক্কা না করে বিরক্তির সঙ্গে লজ্ঝড়ে সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখলেন ডাবওয়ালা। চাকা গড়াতেই তিনি বলছিলেন, ‘‘টিভিতে তো দেখছি তাড়া তাড়া নোট গুনছেন! আর ডাবের বেলা যত দরদাম।’ রক্ষে এই যে, তৃণমূলের ওই যুব নেতার কানে সে কথা পৌঁছয়নি। নাহলে আর একপ্রস্ত নারদ-নারদ হত।
গজগজ করতে করতে মিরাজুল বলছিলেন, ‘‘সব কিছুর একটা সীমা আছে। যা চাইবে সেটাই মেনে নিতে হবে! এই সময়ে দলের কাজে একটু আধটু রোদে ঘুরতে হয়। ডাবটা খেলে শরীর চাঙ্গা থাকে। এ তো দিনেদুপুরে ডাকাতি মশাই।’’ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিরোধী শিবিরের এক নেতা। সুযোগ বুঝে দিলেন চিমটি কেটে, ‘‘বলছিলাম ভাই, নারদের টাকাগুলোও তো দিনেই নেওয়া। নাহলে ক্যামেরায় অত ঝকঝকে ছবি...।’’
জামাইষষ্ঠীর আম-ইলিশ কিংবা ঝুলনের তালের মতোই ভোট-উৎসবে চড়চড়িয়ে বাড়ছে ডাবের চাহিদা। দুপুরের চড়া রোদে অলিগলিতে মিছিল-মিটিংয়ে ঘেমেনেয়ে একাকার নেতাদের তৃষ্ণা মেটাতে বিকল্প আর কী? টিভিতে-খবরের কাগজেও ডাক্তারদের একই পরামর্শ, রাস্তার কাটা ফল বা ফলের রস কিনে খাবেন না। তার বদলে ডাবের জল খান। সুযোগ বুঝে তাই ১০ টাকার ডাব বিকোচ্ছে ২০ টাকায়। প্রশ্ন উঠলেই সটান জবাব, ‘‘কী আর করা যাবে! লক্ষ্মীপুজোর আগে দাম বাড়লে কেউ রা কাড়ে না। যত দরদাম এই সময়। আরে ভোট তো একটা বড় উৎসব না কি! দাম তো একটু বাড়বেই। তা ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় যোগানও বেশ কম।’’
তবে নেতা থেকে সাধারণ ক্রেতাদের দাবি, ভোটের গল্প শুনিয়ে ফাটকাবাজি শুরু হয়ে গিয়েছে। গ্রামে মালিকের কাছ থেকে কম দামে কিনে বাজারে এসে দাম চড়াচ্ছে ওরা। যদিও ডাবে হাত রেখে করিম শেখের দাবি, ‘‘ডাবের দিব্যি বাবু, মাল কিনতে গিয়ে আমাদেরও চোখ কপালে উঠছে। ক্রিকেট বলের সমান এক-একটা ডাবের দাম কি না ১০ টাকা। বলছে নিতে হলে নাও, না হলে কেটে পড়।’’
গাছের মালিক ডোমকলের বাসিন্দা সবুর শেখের বক্তব্য, ‘‘অন্য সময় জলের দরে আমাদের কাছ থেকে ডাব নিয়ে যায়। বললে বলে, এখন ডাবের টান নেই। শহরের বাবুরা টাকা দিয়ে জল কিনে খেতে চান না। পরীক্ষার মরসুমেও তেমন দাম মেলেনি। ভোটে দেখছি সকলে ডাব খাচ্ছে। এখন একটু দাম দেবে না তো কখন দেবে?’’
তেহট্টের ডাব-বিক্রেতা প্রদীপ দে-রও একই বক্তব্য। হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘‘এ সময়ও যদি ডাব-পিছু পাঁচ-ছ’টাকা লাভ না রাখি, তা হলে কী করে চলবে?’’ করিমপুরের পলান হালদারও বলছেন, ‘‘বেশি না, ৩-৪ টাকা করে লাভ রাখছি মাত্র।’’
পড়শির বাড়ির বাগানে সার দেওয়া নারকেল গাছ। কাঁদি কাঁদি কচি ডাব ঝুলছে। যেন সবুজ বিপ্লব। বসন্তের দুপুরে সেই ডাব দেখিয়েই হা হুতাশ করছিলেন ডোমকলের বাসিন্দা তন্ময় পাল। বলছিলেন, ‘‘আরে এখনই কী দেখছেন! চৈত্রের গরমের পাশাপাশি ভোটের গরমটা আরও একটু চড়ুক, দেখবেন নেতা-কর্মী থেকে আমলা সকলেই হামলে পড়বে ডাবের দিকে। সেই সময় দাম শুনলে তো মাথা ঘুরবে। আহা, বাবা যদি জীবনবিমা না করিয়ে রেখে যদি ক’টা নারকেল গাছ লাগাত...।’’
(সহ প্রতিবেদন—কল্লোল প্রামাণিক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy