Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বামেদের দিকে ভোট ঘোরাতে পারেনি কংগ্রেস, ক্ষয় নিজের ভোটব্যাঙ্কেও

বিরোধী শিবিরে আশা জাগিয়েও মুখ থুবড়ে পড়েছে জোট। ভোটের ফলে স্পষ্ট, কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, বলরামপুর থেকে বনগাঁ— বাংলার প্রতিটি প্রান্তে সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল। দক্ষিণবঙ্গে জোট প্রায় খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে তৃণমূল ঝড়ের সামনে। উত্তরবঙ্গে জোটের চেয়ে তৃণমূল কিছুটা পিছিয়ে।

স্লোগানের বানানে এই বিপর্যয় যেন জোটের নির্বাচনী বিপর্যয়েরই প্রতীক।

স্লোগানের বানানে এই বিপর্যয় যেন জোটের নির্বাচনী বিপর্যয়েরই প্রতীক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ১৫:০৩
Share: Save:

বিরোধী শিবিরে আশা জাগিয়েও মুখ থুবড়ে পড়েছে জোট। ভোটের ফলে স্পষ্ট, কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, বলরামপুর থেকে বনগাঁ— বাংলার প্রতিটি প্রান্তে সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল। দক্ষিণবঙ্গে জোট প্রায় খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে তৃণমূল ঝড়ের সামনে। উত্তরবঙ্গে জোটের চেয়ে তৃণমূল কিছুটা পিছিয়ে। তবু সেখানে তৃণমূল যে সাফল্য পেয়েছে, ততটা তৃণমূল নেতারাও আশা করেননি।

এই ফলের রসায়ন কী? শুধুই কি তৃণমূল ঝড়? নাকি জোটের কোনও বড়সড় দুর্বলতা?

প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্র ধরে ধরে ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বাম এবং কংগ্রেসের মধ্যে ভোট দেওয়া-নেওয়া মোটেই মসৃণ ভাবে হয়নি। তাতেই বহু কেন্দ্রে হোঁচট খেয়েছে জোট।

যে কেন্দ্রে বামেদের প্রার্থী, সেখানে কংগ্রেসের ভোট বামেদের বাক্সে জমা হওয়ার কথা ছিল। যে কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী, সেখানে বাম ভোটারদের হাত চিহ্নের বোতাম টেপার কথা ছিল। ফলাফল বলছে, সিপিএম কর্মী-সমর্থকরা হাত চিহ্নের বোতাম টিপেছেন প্রায় সর্বত্রই। কংগ্রেস সমর্থকরা অনেক জায়গাতে কাস্তে-হাতুড়ি-তারার বোতাম টিপেছেন। কোনও কোনও কেন্দ্রে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছেন। আর যে সব কেন্দ্রে জোট প্রার্থীর প্রতীক ছিল সিংহ বা কোদাল-বেলচা, সেই সব কেন্দ্রে হাত চিহ্নের ভোট নিঃশেষে জোড়াফুলে চলে গিয়েছে। সিংহ (ফরওয়ার্ড ব্লক) এবং কোদাল-বেলচার (আরএসপি) সমর্থকরাও হাত চিহ্নকে বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁরাও জোড়াফুলের বোতাম টিপেছেন।

উত্তরবঙ্গেই এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। যেমন কোচবিহারের দিনহাটা বিধানসভা কেন্দ্র। উদয়ন গুহ সেখানে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়েছেন। তিনি ৪৫.৩২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোট ছিল ৪১.২ শতাংশ। বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোটও ছিল প্রায় তার সমান। কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী অক্ষয় ঠাকুর এ বার তার চেয়ে অনেকটা কম ভোট পেয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ৩৫.৫ শতাংশ ভোট। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামেরা ওই কেন্দ্রে ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সেই ভোটে তো ক্ষয় হয়েইছে। কংগ্রেস যে ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে, সেই ভোটটাও বামেদের ঝুলিতে যায়নি। বরং ঠিক চার শতাংশ ভোট বেড়েছে তৃণমূলের। অর্থাৎ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দিনহাটায় কংগ্রেসের প্রার্থী না থাকায়, কংগ্রেস সমর্থকদের ভোট জোড়াফুলে পড়েছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী ওই ভোট পাননি।

জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রেও একই ছবি। কংগ্রেস গত লোকসভা নির্বাচনে সেখানে পেয়েছিল ৪ শতাংশের মতো ভোট। এ বার জোটের সুবাদে সেখানে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিল না। ছিলেন সিপিএমের মমতা রায়। আশা করা গিয়েছিল, লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া ৩৪ শতাংশ ভোটের সঙ্গে কংগ্রেসের ৪ শতাংশ জুড়ে মমতা রায় ৩৮ শতাংশে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু ফলাফল বলছে, বামেরা ৩৪ শতাংশেই রয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের ভোট প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ কংগ্রেসের ভোটারদের সিংহভাগই জোড়াফুলের বোতাম টিপেছেন।

আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে ২০১৪ সালে কংগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছিল সাড়ে সাত শতাংশের একটু বেশি ভোট। এ বার জোট হওয়ার সুবাদে সেই ভোট আরএসপি প্রার্থীর খাতায় জমা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আরএসপি প্রার্থীর ভোট বাড়ল ১ শতাংশের একটু বেশি। প্রায় ৬ শতাংশের কাছাকাছি ভোট বেড়েছে তৃণমূলের। অর্থাৎ সেখানেও কংগ্রেস সমর্থকদের অধিকাংশই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন।

ভোট ‘দেওয়া-নেওয়া’য় ব্যর্থতা

তৃণমূল বামফ্রন্ট কংগ্রেস

বিধানসভা কেন্দ্র জয়ী দল ২০১৬-তে প্রাপ্ত ভোট ২০১৪-তে প্রাপ্ত ভোট বাড়ল / কমল ২০১৬-তে প্রাপ্ত ভোট ২০১৪-তে প্রাপ্ত ভোট বাড়ল / কমল ২০১৬-তে প্রাপ্ত ভোট ২০১৪-তে প্রাপ্ত ভোট বাড়ল / কমল

দিনহাটা তৃণমূল ৪৫.৩২ ৪১.১৯ +৪.১৩ ৩৫.৫২ ৩৭ -১.৫ ০ ৪.১৪ -৪.১৪

তুফানগঞ্জ তৃণমূল ৪৪.৫৩ ৪১.১৮ +৩.৩৬ ০ ৩১.১৫ -৩১ ৩৬.৫৪ ১.৯১১ +৩৪.৬৩

গোয়ালপোখর তৃণমূল ৪৪ ১৫.৫৫ +২৮.৪ ০ ২৬ -২৬ ৩৮.৭৩ ৩৯.১৭ -০.৪৩

সামশেরগঞ্জ তৃণমূল ৩০.৫ ১২.২২ +১৮.৩ ২৯.৩৮ ৩১ -১.৬ ০ ৩৪.৮২ -৩৪.৮২

কালীগঞ্জ কংগ্রেস ৪৫.১৬ ৩২.৫৯ +১২.৬ ০ ২৯.৫৮ -২৯.৫৮ ৪৫.৮৩ ৯.২৭ +৩৬.৫৫

বাদুড়িয়া কংগ্রেস ৩৯ ২৮.৮৭ +১০.১ ০ ৩০.৬৮ -৩০.৬৮ ৫০.৩৫ ২০.২৪ +৩০.১১

কোচবিহারের মেখলিগঞ্জে আবার কংগ্রেসের ভোট গিয়েছে বিজেপি-তেও। প্রায় ৮ শতাংশ ভোট ছিল কংগ্রেসের। ওই কেন্দ্রে ফরওয়ার্ড ব্লকের যে প্রার্থী ছিলেন, তিনি কংগ্রেসের ভোটের বিন্দুমাত্রও পাননি। ৩.৬ শতাংশ ভোট বেড়েছে তৃণমূলের। ২.৫২ শতাংশ ভোট বেড়েছে বিজেপির। অর্থাৎ কংগ্রেস বেশিরভাগ সমর্থকরা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। যাঁরা তা পারেননি, তাঁরা বিজেপিকে দিয়েছেন। তবু ফরওয়ার্ড ব্লককে দেননি।

জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহার জুড়ে এই একই প্রবণতা। হয় কংগ্রেস ভোট দেয়নি বাম প্রার্থীকে। নয়তো বামেরা, বিশেষ করে ছোট শরিকরা, কংগ্রেসকে ভোট দেয়নি। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। কোচবিহার উত্তর এবং কোচবিহার দক্ষিণে কংগ্রেসের ভোটাররা জোটের প্রতি বিশ্বস্তই থেকেছেন।

উত্তর দিনাজপুরের যে অংশে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রভাব বেশি, সেখানে জোট একেবারেই দানা বাঁধেনি। গোয়ালপোখরে বাম ভোট পুরোটা চলে গিয়েছে তৃণমূলে। জোট তথা কংগ্রেস প্রার্থী হেরেছেন। করণদিঘিতে তার পাল্টা। কংগ্রেসের অর্ধেকটা ভোটই জমা হয়েছে তৃণমূলের খাতায়। দীর্ঘ দিনের গড় হাতছাড়া হয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লকের। উত্তর দিনাজপুরের যে সব আসনে সিপিএম বা সিপিআই-এর প্রভাব বেশি, সেখানে কিন্তু ভোট দেওয়া-নেওয়া মসৃণ। রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জে সিপিএমের ভোট সঙ্গে নিয়ে জয়ের ব্যবধান আগের চেয়েও বেশ কয়েকগুণ বাড়িয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। হেমতাবাদে বাম প্রার্থীর জয়ে বড়সড় অবদান রেখেছে কংগ্রেস। ইটাহারে সিপিআই-এর শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায় হেরেছেন ঠিকই। কিন্তু কংগ্রেসের ভোট পুরোটাই তাঁর পক্ষে গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জোট একেবারেই দানা বাঁধেনি মুর্শিদাবাদে। ওই জেলার অনেকগুলি আসনেই বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই ছিল জোটের মধ্যে। কিন্তু যেখানে সেই লড়াই ছিলও না, সেখানেও, কংগ্রেসের ভোট বামেদের দিকে যায়নি। বাম শরিকদের ভোটও কংগ্রেসের ঝুলিতে জমা হয়নি। তবে সিপিএমের ভোট অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কংগ্রেস পেয়েছে।

আরও পড়ুন:

বিরোধী নেতা কে, কংগ্রেসে দড়ি টানাটানি

দক্ষিণবঙ্গে জোট অপেক্ষাকৃত মসৃণ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছুটা এলাকা আর পুরলিয়ার একটা অংশ বাদ দিলে, দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সর্বত্রই বামফ্রন্টের ভোট মানেই সিপিএমের ভোট। তাই যে সব আসনে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন, সেখানে বাম ভোট পুরোটাই কংগ্রেস পেয়েছে। কোথাও কোথাও কংগ্রেসের ভোটও সিপিএম পেয়েছে। তবে দক্ষিণবঙ্গের যে সব আসনে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিল না, সেগুলিতে কংগ্রেসের ভোটের পরিমাণ এতটাই কম যে সেই ভোট পেয়েও সিপিএম জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারেনি। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আরএসপি-কংগ্রেস বিরোধ আর পুরুলিয়ায় ফরওয়ার্ড ব্লক-কংগ্রেস বিরোধ জোটের কাছে বড়সড় ধাক্কা হয়েছে। বেশ কিছু নিশ্চিত আসন হারাতে হয়েছে জোটকে। হুগলি, হাওড়া আর বর্ধমানের গ্রামীণ এলাকাতে কংগ্রেস সমর্থকদের অনেকে সিপিএমকে ভোট দিতেও রাজি হননি। অর্ধেক ভোট সিপিএম প্রার্থী পেয়েছেন। বাকি অর্ধেক তৃণমূলে চলে গিয়েছে।

আসন সমঝোতা নিয়ে বামফ্রন্টের ছোট শরিকদের সঙ্গে কংগ্রেসের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছিল। তার প্রতিফলন ইভিএমে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃত্বের তেমন মতপার্থক্য ছিল না। ফলে জোটের ধর্ম মেনে সিপিএমের ভোট কংগ্রেসেই পড়েছে। কিন্তু বেশ কিছু কেন্দ্রে কংগ্রেসের ভোট সিপিএমে না পড়েনি।

কারণ কী? গলদ কোথায়? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গলদ রসায়নে। দীর্ঘ ৩৪ বছরের ‘অত্যাচার’ বিস্মৃত হয়ে সিপিএমকে আপন করে নেওয়া কি কংগ্রেসের পক্ষে খুব সহজ ছিল? জোটের দাবি যে একে নিচুতলা থেকেই উঠেছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তৃণমূলের তুমুল দাপটের মুখে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাম এবং কংগ্রেসের পক্ষে। সেই পরিস্থিতিতে দু’পক্ষের কর্মীরাই চেয়েছিলেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে হাত মিলিয়ে লড়তে। কিন্তু কংগ্রেসের সাধারণ সমর্থকদের অনেকেই হয়তো মন থেকে এখনও আপন ভাবতে পারেননি বামেদের। তাঁদের ভোটই চলে গিয়েছে তৃণমূলে।

কংগ্রেসের নিজস্ব ভোট তা হলে কতটুকু রইল? নির্বাচন কমিশনের হিসেব বলছে, এ বার ১২ শতাংশেরও বেশি মানুষ হাত চিহ্নের বোতাম টিপেছেন। অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় ৩ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছে কংগ্রেস। কিন্তু এই ভোট কি কংগ্রেসের নিজের ভোট? অধিকাংশ কেন্দ্রেই যে কংগ্রেসের ভোটারদের একটা বড় অংশ তৃণমূলে ভোট দিয়েছেন, তা তো বোঝাই যাচ্ছে? অর্থাৎ ক্ষয় কংগ্রেসেরও হয়েছে যথেষ্টই। কিন্তু জোটের সুবাদে বামেদের ভোটের অনেকটাই কংগ্রেসের ঝুলিতে ঢোকায়, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কংগ্রেস লাভবান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE