Advertisement
০৭ মে ২০২৪

দেশি ‘মাটি’র দাম বেশি, কদর ‘চৌকাঠ-গ্যারান্টি চায়না’র

ভোটের মুখে ‘মাটি’র দাম বেড়েছে। তাই ‘মাল’-এর দামও বেশি পড়বে। বদলে কম দামে ‘চায়না মাটির মাল’ নিতে পারেন। তবে তা কিন্তু ‘চৌকাঠ-গ্যারান্টি’।

অঙ্কন: অশোক মল্লিক।

অঙ্কন: অশোক মল্লিক।

অর্ঘ্য ঘোষ
নানুর শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৩:৩৫
Share: Save:

ভোটের মুখে ‘মাটি’র দাম বেড়েছে। তাই ‘মাল’-এর দামও বেশি পড়বে। বদলে কম দামে ‘চায়না মাটির মাল’ নিতে পারেন। তবে তা কিন্তু ‘চৌকাঠ-গ্যারান্টি’।

‘মাটি’, ‘মাল’, ‘চায়না মাটি’ বা ‘চৌকাঠ-গ্যারান্টি’ ভরা এ ভাষা লালমোহনবাবুর কাছে নির্ঘাত ‘হাইলি সাসপিশাস’ ঠেকত! মানে কী?

বোঝালেন জনৈক সফিকুল। নানুরের এক প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁর ডেরা। মুখে-মাথায় গামছা বাঁধা মধ্য তিরিশের যুবক খোলসা করলেন, ‘‘মাটি মানে বারুদ। মাল মানে বোমা। সস্তা বারুদ হল চায়না মাটি। আর চৌকাঠ-গ্যারান্টি মানে আমাদের ডেরার চৌকাঠ পেরোলে, মালের যাবতীয় গ্যারান্টি খতম।’’

রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে নানুরে। বাম জমানায় সুচপুর গণহত্যা হয়েছে। তৃণমূল আমলে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচে তেতে রয়েছে এলাকা। নিত্যদিন সবুজ খেতের উপরে বোমার ধোঁয়ার সাদা মেঘ ভেসে থাকে। অবস্থা এমনই যে কোনও দিন পোড়া বারুদের গন্ধ না পেলেই বরং অবাক হতে পারেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বর্ধমান এবং মুর্শিদাবাদ থেকে এই এলাকার অল্প দূরত্বের সুবাদে বোমা-শিল্পে জড়িতদের ব্যবসাও চলছে দীর্ঘদিন। পুলিশ ধরপাকড় করলে, অন্য জেলায় গা-ঢাকা দিলেই হল।

অজয় নদের গা ঘেঁষা সরবনের ঝোপে ডেরা সফিকুলের। সেখানে ঢোকার আগে মোবাইল, ক্যামেরা, এমনকী, বুকপকেটের পেনটুকুও

ভরে ফেলতে হল ব্যাগে। বলা হল, ‘‘নারদ-কাণ্ড (স্টিং অপারেশন) দেখেছি টিভিতে। কোথায় ক্যামেরা লুকনো রয়েছে কে জানে? আর বাড়ি-ফাড়ি নিয়ে কিছু জানতে চাইবেন না।’’ সঙ্গে সাবধানবাণী: ‘‘কোনও কায়দাবাজি নয়।’’

ঝোপের ভিতরে সফিকুলেরই বয়সি চার জন ‘হাতের কাজে’ ( বোমা তৈরি) ব্যস্ত। পলিথিনে আলাদা করে সাজানো লাল, সাদা, কালো রঙের গুঁড়ো। তেকোণা লোহার কুচি, ছোট লোহার বল, জাল-কাঠি, পাথরকুচি, সুতলির গোলা, মাঝারি মাপের জর্দার খালি কৌটা, দু’দিকে খাঁজ কাটা লোহার পাইপ।

কৌটোয় সুতলি জড়াতে জড়াতে সফিকুলের সঙ্গী আব্বাস জানালেন, ‘লাল মাটি’ হচ্ছে ম্যাঙ্গানিজ ক্লোরাইড, ‘সাদা মাটি’ পটাশিয়াম ক্লোরেট। দু’টি মিলিয়েই বারুদ বা বোমার মশলা। মুর্শিদাবাদের ঔরঙ্গাবাদ থেকে আনা হয় ‘লাল-সাদা’ বারুদ। কালীপুজোর মতো উৎসবের সময় ওই বারুদের কেজি প্রতি দাম থাকে চার-সাড়ে চার হাজার টাকা। ভোটের আগে দাম দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ থেকে ছ’হাজারে। এক কেজি বারুদ থেকে ১০/১২টি বোমা হয়। গড়ে একটি বোমার দাম পড়ে ৬৫০-৭০০ টাকা।

কিন্তু ভোট-মরসুমে চাহিদা বেশি, সময় কম। ‘‘এই সিজনে (মরসুম) লাল-সাদা মাটির জন্য অপেক্ষার সময়টা দিতে চায় না পার্টি (খদ্দের), অগত্যা চায়না মাটিই ভরসা,’’ বলেন সফিকুল। ‘চায়না’ কি চিন থেকে আসে? ‘‘ওই বারুদটা কমজোরি। আওয়াজ কম, ধোঁয়া বেশি। তাই ওই নাম। আসে ঝাড়খণ্ড থেকে। চায়নার মাল গড়ে ২৫০-৩০০ টাকা পিস। আজ অর্ডার দিলে, কাল রেডি।’’

কোন ‘মাল’ কারা কেনে? সফিকুলের অভিজ্ঞতা, ‘‘যারা ক্ষমতায় থাকে, তারাই বেশি নেয়। ভোটের সময় ভয় দেখানো জরুরি। সংখ্যায় বেশি লাগে বলে তখন চায়না চলে। আবার যেখানে অপোনেন্ট স্ট্রং (প্রতিপক্ষ শক্তিশালী) সেখানে এলাকার দখল নিতে তেজি জিনিস দরকার। তখন লাগে লাল-সাদা।’’

আব্বাসদের দাবি, ভোটের বাজারে তাঁদের বানানো ‘মাল’-এর চাহিদা বর্ধমানের আউশগ্রাম, মঙ্গলকোট, কেতুগ্রাম, মুর্শিদাবাদের বড়ঞা এবং বীরভূম জেলায় নানুরের প্রায় সব গ্রাম এবং লাভপুর ব্লকের অনেক এলাকায় রয়েছে। এই ‘সিজন’-এ শুধু নানুর-লাভপুরেই পাঁচ হাজার ‘চায়না’র অর্ডার রয়েছে তাঁদের কাছে।

কারা দিল ‘অর্ডার’? জিভ কাটেন সফিকুল—‘‘নাম নেওয়া যাবে না। খদ্দের লক্ষ্মী। তবে সব দলই আছে। এক দলের দু’টো গ্রুপও আছে। জানেন তো, নানুরে এখন যারা লড়ছে, তারা কারা?’’

মূলত তিন ধরনের বোমা বানান সফিকুলেরা। সুতলি বোমা বা পেটো, কৌটো বোমা আর সকেট বোমা। এক জন বোমা বাঁধিয়ে দৈনিক গড়ে ৫০-৬০টি করে বোমা বাঁধতে পারে। ‘পার্টি’ (খদ্দের) ‘মাটি’ কিনে দিলে মজুরি বাবদ সফিকুলদের বোমা পিছু ৫০-৬০ টাকা করে আয় হয়। আর নিজেরা বারুদ কিনলে লাভের অঙ্ক বাড়ে। ভোটের মাস তিনেক আগে থেকে এক-এক জনের গড় মাসিক আয় দাঁডিয়েছে ২০-২৫ হাজার টাকা। বোমা বাঁধার সঙ্গে এলাকা দখলের জন্য বোমাবাজি করারও চুক্তি হলে মাথাপিছু আয় আরও হাজার পাঁচেক করে বেশি। উপরি হিসেবে লুঠপাটের মালের ভাগ মেলে।

কিন্তু ঝুঁকি?

আব্বাস হাসেন। বলেন, ‘‘মাল ফেটে টপকে (মারা) গেলে কোথায় না কোথায় পুঁতে ফেলা হবে। সব জেনেও বাড়ির লোকেরা কাঁদতে পারবে না! আর বডি পাওয়া গেলে দুষ্কৃতী বলে হাত ধুয়ে ফেলবে সব্বাই।’’ তা হলে করেন কেন এ কাজ? জবাব আসে, ‘‘অনেক মামলায় পুলিশের খাতায় নাম। লোকে কাজ দিতে চায় না। আর জেলে পচানোর ভয় দেখায়, যখন যে ক্ষমতায় থাকে। মাল না বানিয়ে যাব কোথায়!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE