Advertisement
০২ মে ২০২৪

সরকার কি বুঝল, এটা তাদের পক্ষে কতটা অসম্মানের?

কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে নির্বাচনের মধ্যে এ ভাবে সরিয়ে দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন, এমন ঘটনা ইতিহাসে নেই। এটা একেবারেই নজিরবিহীন ঘটনা। কিন্তু খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটে গেল। বিরোধী দলগুলি বেশ কিছু দিন ধরেই অভিযোগ করছিল, রাজীব কুমার নিরপেক্ষ নন। অভিযোগ উঠছিল, রাজীব কুমার যা করছেন, তা শুধুমাত্র নির্বাচনে শাসক দলের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার তাগিদেই করছেন।

তুষার তালুকদার (কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার)
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ২০:১৫
Share: Save:

কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে নির্বাচনের মধ্যে এ ভাবে সরিয়ে দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন, এমন ঘটনা ইতিহাসে নেই। এটা একেবারেই নজিরবিহীন ঘটনা। কিন্তু খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটে গেল। বিরোধী দলগুলি বেশ কিছু দিন ধরেই অভিযোগ করছিল, রাজীব কুমার নিরপেক্ষ নন। অভিযোগ উঠছিল, রাজীব কুমার যা করছেন, তা শুধুমাত্র নির্বাচনে শাসক দলের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার তাগিদেই করছেন। এই রকম নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দিল।

কতটা অপমানজনক ঘটনা! রাজ্য সরকারের জন্য এবং কলকাতা পুলিশের জন্য এর চেয়ে বড় অসম্মান আর কী হতে পারত? বিরাট ধাক্কা খেল রাজ্য সরকার। প্রমাণ হয়ে গেল, কতটা নীচে নেমে গিয়েছে এই সরকার, প্রমাণ হয়ে গেল কতটা নীচে নেমেছে পুলিশ! জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসা একটা সরকার এখন পুলিশকে এমন ভাবে কাজে লাগাচ্ছে যে নির্বাচন কমিশন মনে করছে এই সরকারের হাতে জনগণের স্বার্থ আর সুরক্ষিত নয়।

কলকাতার নগরপাল পদ থেকে রাজীব কুমারের অপসারণে দু’টি বিষয় খুব স্পষ্ট ভাবে উঠে এল:

১) নির্বাচন কমিশন মনে করছে এই সরকার জনগণের রায় প্রতিফলিত হতে দিতে চায় না।

২) নির্বাচন কমিশন মনে করছে রাজীব কুমার নির্বাচনের মতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পক্ষে বিপজ্জনক।

রাজনীতিকদের একটা শ্রেণি কতটা নীচে নেমেছে, তা সকলেই জানেন। সে নিয়ে আমার নতুন কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার হিসেবে বলতে চাইব, পুলিশ অফিসারেরা কতটা নীচে নেমে গিয়েছেন, তা আরও স্পষ্ট হল। ক্ষমতাসীন দলের বশংবদ হওয়ার তাগিদে এঁদের অনেকের খেয়াল থাকছে না যে এঁরা নিজেদের প্রাথমিক কর্তব্যটুকুও ভুলে গিয়েছেন।

রাজীব কুমারের অপসারণের ঘটনায় আমি এক দিক থেকে লজ্জা বোধ করছি। অন্য দিক থেকে আমি স্বস্তি বোধ করছি।

একটা রাজীব কুমারের জন্য গোটা কলকাতা পুলিশকে কতটা অপমানের সম্মুখীন হতে হল, তা ভেবে কলকাতা পুলিশের প্রাক্তনী হিসেবে আমি লজ্জিত।

আবার নির্বাচন কমিশনের কড়া পদক্ষেপ পুলিশ মহলে একটা সদর্থক বার্তা চারিয়ে দেবে, এটা ভেবে আশ্বস্ত হচ্ছি। এটা ভেবে আশ্বস্ত হচ্ছি যে পুলিশ তার সম্বিৎ ফিরে পাবে, মনে পড়ে যাবে আসল কর্তব্যটা কী? পুলিশ মনোবলটাও ফিরে পাবে। শাসক দলের হাতে আক্রান্ত হতে হতে পুলিশের মনোবল তো তলানিতে চলে গিয়েছে। শীর্ষকর্তারা শাসক ভজনায় এত ব্যস্ত যে আলিপুরে শাসক দলের কর্মীদের হাতে থানা আক্রান্ত হলেও বা বীরভূমে শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতীর বোমার ঘায়ে পুলিশকর্মীর মৃত্যু হলেও, পুলিশের শীর্ষকর্তারা তা দেখতে পান না। পুলিশ অভি‌যুক্তদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস করে না। রাজীব কুমারের অপসারণ পুলিশ মহলে একটা স্বস্তির হাওয়া চারিয়ে দেবে। পুলিশকর্মীরা আশ্বস্ত হবেন যে তাঁদের অধিনায়ক এখন যিনি, তাঁর কাজ আর শুধুমাত্র শাসক দলের ধামাধরা নয়। এটা ভেবে আশ্বস্ত হচ্ছি যে জনসাধারণের মধ্যেও একটা সদর্থক বার্তা যাবে।

আরও পড়ুন:

নগরপাল পদ থেকে রাজীব কুমারকে সরিয়ে দিল নির্বাচন কমিশন

অনেকে বলছেন, এটা নজিরবিহীন ঘটনা নয়। কারণ এর আগে গৌতমমোহন চক্রবর্তীকেও নির্বাচনের মুখে কমিশন কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর অপসারণের কারণ অন্য ছিল। বিধি অনুযায়ী, যে সব প্রশাসনিক পদ নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত, সেই সব পদে কোনও অফিসার তিন বছর কাটিয়ে ফেললে, নির্বাচনের আগে তাঁকে অবশ্যই সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু নগরপাল পদে গৌতমমোহন চক্রবর্তী তিন বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও, তাঁকে সেই পদে রাখা হয়েছিল। তাই কমিশন তাঁকে সরিয়ে দেয়। কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে নয়।

এই অপমান এই রাজ্য সরকার এবং এই বশংবদ পুলিশ অফিসারেরা কতটা গায়ে মাখবেন তা অবশ্য বলতে পারছি না। যদি মান-অপমানের বোধটা থাকত, তা হলে আজ নির্বাচন কমিশনকে এত বড় পদক্ষেপ করতে হত না। বর্তমান শাসক দল যদি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় ফেরে, তা হলে আবার রাজীব কুমারকেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদে ফিরিয়ে আনা হলে আমি আশ্চর্য হব না। কারণ এর আগেও নির্বাচনের মুখে কমিশন বিভিন্ন জেলায় যে পুলিশকর্তাদের সরিয়ে দিয়েছিল, ভোট মিটতেই তাঁদের পুরনো পদে ফিরিয়ে এনেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE