পাড়ায় পাড়ায় বোলান শিল্পীরা। — নিজস্ব চিত্র
পড়নে সাদা ধুতি আর রঙিন পাঞ্জাবি। কোমরে জড়ানো উত্তরীয়। খালি পায়ে ছমছম করছে ঘুঙুর। জনা দশেকের একটা দল। কারুর গলায় ঢোল, কেউ বা হাতে কাঁসি কারও খঞ্জনি। গাঁয়ের বটতলায় দাঁড়িয়ে মূলগায়ক গাইছেন— “শুনুন শুনুন বঙ্গবাসী, শুনুন দিয়া মন। আজ এই আসরে ভোটের কথা করিব বর্ণন... আহা ষোলো সালের ভোটের কথা করিব বর্ণন।” সঙ্গে ঢোল, এক পত্তন মাতন তুলে শান্ত হতেই ফের গান ধরলেন গায়ক, “ভোট ভোট ভোট এল বঙ্গে, এ এক আজব কান্ড। ঘটে গেল বাংলার ভোট রঙ্গে।” এ বার গলা মেলালোন বাকিরা, ‘ওগো বাংলার ভোট রঙ্গে’।
ততক্ষণে বটতলা গুটি গুটি পায়ে বটতলায় ভিড় জমতে শুরু করেছে। “হাত-হাতুড়ি বাঁধল জোট। বাংলার জনগণ তাদের দেবেন ভোট?” প্রশ্ন করার ঢঙে গানের কথাগুলো বার বার গাইতে লাগলেন গায়ক। “চিরশত্রুরা সব এক হল, বাংলার ঘাসফুলকে দলতে এলো।” সহ গায়কেরা ফের ধুয়ো ধরল ‘এ কি আজব কান্ড দেখি বাঙলার ভোট রঙ্গে।’ সজোরে বেজে উঠল ঢোল কাঁসি খঞ্জনি। চারপাশে গোল করে ঘিরে থাকা শ্রোতারা খুশিতে হইহই করে ধ্বনি দিয়ে উঠলেন, বলো ভাই শিবনিবাসের বুড়োশিব দেবাদেব মহাদেব।
বোলানের চোখা বুলিতে এ ভাবেই চৈত্র সংক্রান্তি জমজমাট হয়ে উঠেছে নদিয়ায়। এ জেলার নিজস্ব লোকগান এই বোলান বা স্থানীয় লোকের মুখে ‘বুলান’। ফসলহীন চৈত্রের অলস অবসর কাটাতে সেই কবে নদিয়ার কৃষক গলায় তুলে নিয়েছিল গান। ধুলো মাখা ফাটা পায়ে ঘুঙুর জড়িয়ে দল বেঁধে ঢোলকাঁসি নিয়ে নেমে পড়েছিল পথে। কৃষকের অবসরের সেই গান ক্রমে বছর শেষের ‘চোত গাজনের’ প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠল নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ, হাঁসখালি বা কালীনগর, নাকাশিপাড়া, তেহট্টের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। গাজনের সন্ন্যাসী বা ‘গাজুনে বালার’ গান তাই এ গানের নাম বোলান বা বুলান। শুরুতে পুরান থেকে রামায়ণ, মহাভারত হয়ে কৃষ্ণলীলা, চৈতন্যলীলা এ সবই ছিল বোলান গানের বিষয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে বোলান। বিনোদনের বোলান হয়েছে উঠেছে প্রতিবাদের গান, কখনও বা জাগরণের। প্রতিদিনের গ্রামজীবনের অভাব আভিযোগ আবিচারের কথা থেকে শুরু করে সিঙ্গুর,নন্দীগ্রাম পর্ব হয়ে সারদা, সিবিআই সবই উঠে এসেছে নির্ভীক বোলান গায়কের গলায়। কাউকেই সে রেয়াৎ করে না। পরোয়া করে না সরাসরি রাজনীতির কথা বলতে।
২০১১’র চৈত্রে বোলানে ছিল পরিবর্তনের বোল। সেবার লেখা হয়েছিল “ভোট, ভোট, ভোট এল বঙ্গে। ওগো পরিবর্তনের হাওয়া নিয়ে এল সঙ্গে। বঙ্গবাসীর মুখে মুখে একটিই কথা তাই। খুনি বাম সরকারের আমরা পরিবর্তন চাই। আমরা সবে লোকশিল্পী গাই বুলান গান। ওগো সব আসরে গেয়ে বেড়াই পরিবর্তনের গান।” রাজ্যে পালাবদলের ঠিক আগে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এই গান। কিন্তু ২০১৩’র চৈত্রে বদলে গিয়েছিল গানের মেজাজ। সে বার বোলান শিল্পীরা গেয়েছিলেন, “ওগো রাজনীতিতে দাদাগিরি সব আমলেই ছিল। এই আমলেও দাদাগিরি যে কমবেশি হল। বাম আমলে মজিদ মাষ্টার, তপন সুকুর জন্মেছিল। এই আমলেও কত না আরাবুলের জন্ম হল। তাইতো বলি বঙ্গবাসী শুনুন দিয়া মন। এইসব দাদারাই বাংলায় অশান্তির কারণ। আমরা সবে লোকশিল্পী গাই বুলান গান। ওগো দেশ বিদেশে গেয়ে বেড়াই শান্তির গান।”
“বোলান গায়কেরা কাউকে খুশি করার গান গাইতে জানে না ” গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছিলেন বুদ্ধিশ্বর ঘোষ। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ওই বোলান শিল্পী বলেন, “খেটে খাওয়া মানুষের গান হল বোলান। সারাদিন জমিতে অমানুষিক পরিশ্রমের পর যারা বাপ ঠাকুরদার হাত ধরে বোলান গাইছেন তাঁদের তো কাউকে খুশি করার দরকার নেই।’’ কেননা তাঁরা জানেন পেটের ভাতের জন্য সেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম ছাড়া অন্য কিছু পথ তাঁদের নেই। সুতরাং সত্যি কথা বলতে বোলান শিল্পী ভয় পায় না।
নিমাই ঘোষ, প্রাণকৃষ্ণ ঘোষের বা স্বপন ঘোষের মত চার পুরুষের বোলান গায়কদেরও সেই একই কথা। নদিয়ার সবচেয়ে প্রবীণ বোলান শিল্পী পুঁটিরাম ঘোষের বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে। পুরুষানুক্রমে তিনি গাইছেন এই গান। তাঁর ছেলে ভীষ্মদেব ঘোষও এখন ভালো গাইছেন। গণেশ ঘোষের যোগ্য উত্তরসূরি বছর তিরিশের স্বপন ঘোষ নেমে পড়েছেন বোলান গাইতে। তাঁদের সাফ কথা, “নিছক খুশি করা গান বেঁধে থামতে নেই বোলান শিল্পী বা ‘বালাদের’। প্রতি বছর তাঁরা নতুন নতুন গান বাঁধেন সমকালীন বিষয়ে। কাউকে রেয়াৎ করে না বোলানের বুলি।” তাঁদের গানে এক দিকে যেমন কন্যাশ্রী, শ্রমিক মেলা, বার্ধক্য ভাতা, সবার শৌচাগারের অকুন্ঠ প্রশংসা। তেমনি অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ঝরে পড়ে গানে।
গত চৈত্রের শেষ বিকেলে গাজনতলায় নতুন গান শুনতে জড়ো হওয়া শ্রোতাদের সামনে সদর্পে গেয়ে ছিলেন “এত কিছু করার পরেও মন্ত্রী গেলেন জেলে। ওগো অনেক নেতা ধরা পড়ল সিবিআই জালে। চৈত্র শেষে হিসাবপত্র বুঝে নিতে তাই। সিবিআই হানা দিল তৃণমূলের দরজায়।” সমালোচনা আর কে কবে পছন্দ করেছে। তাই ওঁদের কথাও কেউ সেভাবে ভাবে না।
তবু এই চৈত্র দুপুরে চূর্ণির পাড় থেকে যদি কখনও কানে আসে বাংলা ঢোলের গম্ভীর আওয়াজ নিশ্চিত জানবেন কৃষ্ণগঞ্জ, পাবাখালি বা কৃষ্ণপুরের কোন গৃহস্থের উঠোনে বসেছে বোলানের আসর। সেখানে গায়ক গাইছেন “দিল্লি থেকে নির্বাচনের বড় সাহেব এলেন। জেলার জুড়ে সাহেবদের বদলি করে দিলেন। আহা নজিরবিহীন বদলি করে দিলেন। স্ট্রিং অপারেশনের পাতা জালে শাসকদলের অনেক নেতাই জড়িয়ে গেলেন। দেখা যাক ভোট রঙ্গ, কাকে চায় এই বঙ্গ!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy