গত সপ্তাহে মেয়ে-জামাই কলকাতায় এসেছে ভোট দিতে। এক সপ্তাহের ছুটি। ভোটের ব্যস্ততা কেটে যাওয়ার পরে বুধবার রাতে সপরিবার রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলাম। জয়শ্রীর মণ্ডলপাড়া রোডের বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত ১১টা পেরোলো। আমি, আমার স্ত্রী কুমকুম ছিলাম প্রথম গাড়িতে। ছোট ভাইয়ের মোটরবাইকে মেয়ে সময়িতা। ওঁরা ছিল একটু পিছনে। দরজার তালা খুললাম। ঘরের আলো জ্বেলে সবে দোতলায় উঠেছি।
আচমকা বিকট একটা শব্দ!
সাঙ্ঘাতিক তীব্র আওয়াজে বুক কেঁপে উঠল। টিভিতে ‘কেকেআর’-এর খেলা চলছে। পীযূষ চাওলার বলে সবে আউট হয়ে গিয়েছে পঞ্জাবের গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। কিন্তু এ তো জয়ের আতসবাজি নয়! তবে কি মেয়ের কিছু হল? ২০১৪ সালের নভেম্বরে একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে আমার। বুকে ধড়ফড়ানি নিয়েই একছুটে একতলায়।
নীচে জমাট ধোঁয়া। তীব্র বারুদের গন্ধ। সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাচের টুকরো। জানলার কাঠামোটা উপড়ে পড়ে রয়েছে মাটিতে। তার মধ্যেই সদর দরজায় বেল। স্বস্তি ফিরল পরক্ষণেই। যাক! মেয়ে আর ভাই ঠিক আছে!
পড়শি, পুলিশ, সংবাদমাধ্যম, আত্মীয়, বন্ধু— মিনিট পনেরোর মধ্যেই পাড়া জুড়ে শোরগোল। এরই মধ্যে কেউ এক জন আমার বাড়ির বারান্দায়, ঠিক দরজার সামনে পড়ে থাকা একটা দড়ির দলার দিকে এগিয়ে গেল। না-ফাটা একটা তাজা বোমা। ফের ভয়ে কাঁটা সকলেই।
খানিক পরে পুলিশ এসে পেটো-টার উপরে জল ছড়াল। তার পর খালি হাতেই সরিয়ে নিয়ে তুলল জল ভরা বালতিতে। বিস্ফোরণের সময়টায় বাড়ির ঠিক সামনে রাস্তার আলো নিভে গিয়েছিল। কারা, কী ভাবে এসে বোমা মেরে গেল, দেখতে পাননি পড়শিদের কেউই। আমিও না। তবে নিজের বাড়ির বসার ঘরটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধ চলছিল এতক্ষণ!
প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে বামপন্থী পরিবেশের মধ্যেই আছি। শাসক যে বরাবরই গণতন্ত্রকে নিজের মতো করে ব্যবহার করার চেষ্টা করে, সে কথাও জানি। এক দিকে শহরজোড়া নির্বাচনী ফেস্টুন, তারই মধ্যে আমার ঘরময় কাচের টুকরো— দেখে গণতন্ত্রের নিষ্ঠুর কার্টুন-ছবির মতো লাগছিল। কয়েক মিনিট এ দিক-ও দিক হলে হয়তো এই লেখাটাও আর লেখা হতো না!
সত্তরের দশক দেখেছি। বোমা, গুলি, দৌড়— কোনওটাই আমার কাছে নতুন নয়। ১৯৭৯ থেকে এ পাড়ায়। কিন্তু এমন গুন্ডামি দেখিনি আগে। তবে যে সন্ত্রাসের হাতে সাড়ে তিন বছরের শিশু রেহাই পেল না, ভোট দেওয়ার অপরাধে যেখানে কান কেটে নেওয়া হল, সেখানে ‘সামান্য দুটো পেটো’ দেখে মনে হয় এ আর এমন কী!
যাঁরই নির্দেশে এই উদ্ভ্রান্ত যুবকের দল বিরোধী-খতমের খেলায় নেমে থাকুক, তাঁদের জানাই— আমার পরিবার দীর্ঘ সাড়ে চার দশক ধরে বামপন্থী দর্শনকে আশ্রয় করে বাঁচতে শিখেছে। আগামি দিনেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামব, যদি না কেউ মেরে ফেলতে পারে।
কথা দিলাম। মিলিয়ে নেবেন।