Advertisement
০৮ মে ২০২৪

প্রাণপাত করেছিল ছেলেটা, আক্ষেপ সুখেনের

ঘরের ছেলে হয়ে ওঠার চেষ্টায় কোনও ত্রুটি ছিল না। কালীঘাট থেকে প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার পরেই বড়জোড়ায় এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন টালিগঞ্জের তারকা সোহম। একাধিক গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে থাকা দলীয় কর্মীদের এক করার চেষ্টায় দিন রাত বৈঠক করেছেন। সবার অভিযোগ শুনেছেন মন দিয়ে। মান ভাঙাতে পৌঁছে গিয়েছেন টিকিট না পাওয়া বিদায়ী বিধায়ক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতেও। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই শেষ রক্ষা হল না। দলের ভরা বাজারে বড়জোড়া কেন্দ্রে তারকা প্রার্থীর পরাজয়ের বিষয়টিকে নেতা কর্মীদের অনেকেই অঘটন ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছেন না।

গণনাকেন্দ্রে সোহম। বৃহস্পতিবার।

গণনাকেন্দ্রে সোহম। বৃহস্পতিবার।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রশান্ত পাল
বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৬ ০৩:০২
Share: Save:

ঘরের ছেলে হয়ে ওঠার চেষ্টায় কোনও ত্রুটি ছিল না। কালীঘাট থেকে প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার পরেই বড়জোড়ায় এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন টালিগঞ্জের তারকা সোহম। একাধিক গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে থাকা দলীয় কর্মীদের এক করার চেষ্টায় দিন রাত বৈঠক করেছেন। সবার অভিযোগ শুনেছেন মন দিয়ে। মান ভাঙাতে পৌঁছে গিয়েছেন টিকিট না পাওয়া বিদায়ী বিধায়ক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতেও। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই শেষ রক্ষা হল না। দলের ভরা বাজারে বড়জোড়া কেন্দ্রে তারকা প্রার্থীর পরাজয়ের বিষয়টিকে নেতা কর্মীদের অনেকেই অঘটন ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছেন না।

বৃহস্পতিবার গণনা শেষ হওয়ার পরে, বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজিয়েট স্কুলের গণনাকেন্দ্র থেকে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে আসেন সোহম। অন্যমনস্ক হয়ে হোঁচটও খান এক বার। ৬১৬ ভোটে সিপিএমের সুজিত চক্রবর্তীর কাছে হেরে গিয়েছেন তিনি। বাইরে বেরোতেই তাঁকে ঘিরে ধরেন এক দল কর্মী সমর্থক। অনেকেরই চোখে জল।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা কাছে ঘেঁষতে সোহম শুধু বলেন, ‘‘আজ কিছু বলব না।’’ কর্মীদের দিকে এক বার ফিরে তাকিয়ে অপেক্ষা করে থাকা এসইউভি-তে উঠে পড়েন। কর্মীদের জটলা তখন থমথম করছে। আক্ষেপ ঝরে পড়ে সোহমের নির্বাচনী এজেন্ট সুখেন বিদের গলায়। তিনি বলেন, ‘‘প্রাণপাত করে খেটেছিল ছেলেটা। আমরাও মরিয়া চেষ্টা করেছিলাম। এমন হবে ভাবতেই পারিনি।’’ প্রার্থীর পরাজয়ে হতাশ স্থানীয় তৃণমূল নেতা অলক মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “সাধারণ চা দোকানি থেকে মধ্যবিত্ত মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন সোহম। তার পরেও হেরে গেলেন। বিশ্বাসই হচ্ছে না।’’

শুধুই বড়জোড়া নয়, বাঁকুড়াতেও ঘটে গিয়েছে অঘটন। দুপুরের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল, হারতে চলেছেন মিনতি মিশ্র। কাশীনাথ মিশ্রের স্ত্রী। প্রয়াত বিধায়ক কাশীনাথ মিশ্রের খ্যাতি শুধু দলের কর্মীদের মধ্যে আটকে থাকেনি কখনও। ২০১২ সালে তৃণমূল বিধায়ক কাশীনাথবাবুর মৃত্যুর পরে ওই আসনে উপনির্বাচনে বড়সড় ব্যবধানে জয়ী হন মিনতিদেবী। এ বারও দলের নেতা কর্মীরা স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মিনতিদেবীর জয় মোটের উপর নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ হাসিটা হাসলেন কংগ্রেসের শম্পা দরিপা। ভোট ঘোষণার পরে যাঁকে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে দল থেকে বহিস্কার করেছিল জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। শম্পাদেবী যোগ দিয়েছিলেন কংগ্রেসে। জোটের প্রার্থী হয়ে মিনতিদেবীর বিরুদ্ধে নেমেছিলেন লড়াইয়ের ময়দানে।’’

এ দিন সকালে গণনাকেন্দ্রে যাননি শম্পাদেবী। সিপিএমের কার্যালয়ে বসে ফোনে খবর নিয়েছেন। সেখানেই খবর পান এক হাজারেরও বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি। আবীর রাঙা গণনাকেন্দ্রে উপস্থিত হন জয়ী প্রার্থী। সেখানে বলেন, “গণতান্ত্রিক দেশে লাল চোখ দেখিয়ে মানুষকে আর দমিয়ে রাখা যাবে না। এই জয় সেটাই প্রমাণ করল।”

নক্ষত্র পতন অবশ্য বিরোধী শিবিরেও হয়েছে। পরাজিত হয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র। গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভরা বাজারেও দক্ষিণ বাঁকুড়ায় যে ক’টি দুর্গ রক্ষা করতে পেরেছিল সিপিএম, তার মধ্যে অন্যতম হল তালড্যাংরা। অমিয়বাবু এই কেন্দ্রেরই বাসিন্দা। প্রাক্তন বিধায়কও বটে। কলকাতা থেকে এসে এলাকাবাসীর কাছে অচেনা মুখ সমীর চক্রবর্তী ওরফে বুয়া তাঁর গড়ে তাঁকেই পরাস্ত করে দেবেন, তা কল্পনাও করতে পারেননি সিপিএমের অধিকাংশ নেতা-কর্মীই। সোহমের মত নিজের কেন্দ্রে ঘাঁটি গেড়েছিলেন সমীরবাবু। সোহম না পারলেও তিনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজিমাতও করেছেন।

তালড্যাংরা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রায় দু’দশক আগে তিনবার জয়ী হয়েছিলেন সিপিএমের বর্তমান রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র। এ বার তালড্যাংরায় নিজের তালুকেই তাঁকে প্রার্থী করে পাখির চোখ করেছিল দল। কিন্তু এ দিন গণনার প্রথম রাউন্ডে সামান্য ভোটে এগিয়ে থাকলেও পরবর্তী রাউন্ডে পিছিয়ে যান তিনি। বেলা যত গড়িয়েছে তৃণমূল প্রার্থীর সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ততই বেড়েছে। সকালে গণনাকেন্দ্রে একবার ঢুকেই তিনি বাইরে বেরিয়ে যান। আর তিনি গণনাকেন্দ্রের ত্রিসীমানায় আসেননি। পরে তিনি বলেন, ‘‘একটা লড়াই শেষ হল। লড়াইয়ে জয়-পরাজয় দু’টোই থাকে। তা বলে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই থেমে থাকবে না।’’

পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের তৃণমূল প্রার্থী রাজীব সোরেনের জয়কে অনেকে তাঁর বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ বলেই মনে করছেন। বেশ কয়েক বছর আগে কংগ্রেসে কর্মী জাগরণ সোরেন খুন হন। সিপিএমের লোকেরাই খুন করেছিল বলে অভিযোগ। তাই এ দিন সিপিএমের বিদায়ী বিধায়ককে হারানোর পরে রাজীব নিজের এই জয় বান্দোয়ান কেন্দ্রের মানুষের সঙ্গে স্বর্গত বাবাকে উৎসর্গ করেছেন।

এই ফল কিছুটা প্রত্যাশিত হলেও পুরুলিয়া কেন্দ্রের ফল অপ্রত্যাশিতই— বলছেন তৃণমূলের কর্মীরা। এই কেন্দ্রে তৃণমূলের বিদায়ী বিধায়ক কেপি সিংহদেও-এর বদলে শাসকদলের প্রার্থী করা হয়েছিল তাঁর ছেলে দিব্যজ্যোতিপ্রসাদ (ডিপি) সিংহদেও-কে। দিল্লির কর্পোরেট অফিসের চাকরি ছেড়ে বাবার মুখ রক্ষা করতে মাটি কামড়ে প্রচারে নেমেছিলেন। কেপি বিরোধীরাও দ্বন্দ্ব দূরে ঠেলে প্রকাশ্যে ডিপি-র হয়ে প্রচারে নেমেছিলেন। কিন্তু ইভিএমে ডিপিকে টেক্কা দিয়ে এক সময়ে তৃণমূলেরই ঘরের ছেলে কংগ্রেস প্রার্থী সুদীপ মুখোপাধ্যায় (কাল্টু) পুরুলিয়া কেন্দ্র ছিনিয়ে নিলেন। তৃণমূল কর্মীদের আক্ষেপ, পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ কেপিদা লড়াইয়ে থাকলে ফল এমনটা হতো না। জেলার রাজনীতি নিয়ে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছিলেন, পাড়া ও জয়পুরে জোটপ্রার্থীর পক্ষে হাওয়া রয়েছে। কিন্তু ওই দুই কেন্দ্র তৃণমূলই পেয়ে শত্রুর মুখে ছাই দিয়েছে। এই ফলও যে প্রত্যাশিত নয়, তা মানছেন তৃণমূলের বহু কর্মীই। — নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Actor Soham Chakroborty TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE