ভূতেদের ভবিষ্যৎ আসলে মানুষের হাতে। মানুষ যদি দেবতা গড়তে পারে, তবে ভূতও গড়তে পারে। বিজয় দশমীতে ঠাকুর বিসর্জন দেওয়ার মতো ভূত বিসর্জন দেওয়াটাও মানুষেরই কাজ, ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকার। আমি মনে করি, ভূত তাড়ানোর এটাই আসল ফর্মুলা। মন্ত্রও বলতে পারেন।
ভূত ব্যাপারটাই তো অন্ধকারের— যারা অন্ধকারে থাকে, অন্ধকারের মানানসই আচরণ করে, আবার চারপাশ অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে চেয়ে নিজেরাও আড়াল খোঁজে। ভূত তাড়াতে তাই প্রথম দরকার আলো এবং আরও আলো। এই আলোটা আসলে ইচ্ছাশক্তি। আর তার পাওয়ার স্টেশন। মনের দৃঢ়তা। সেই দৃঢ়তা থেকেই ইচ্ছাশক্তি জোর পায়— তা সে যেখানে ভূতের ভয়, সেখানে রাত কাটানোই হোক বা নিজের ভোট নিজে দেওয়া।
ভূত তাড়ানোর একটা মন্ত্র রবি ঠাকুর শিখিয়ে গিয়েছেন, ‘যখনই জাগিবে তুমি, তখনই সে পলাইবে ধেয়ে।’ ভোটের ভূত তাড়াতেও তো সেই জেগে ওঠাটাই জরুরি। জেগে উঠুন। চোখ রাঙানোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। পাল্টা চোখ রাঙান। একা নয়, দশ জনে মিলে। সেই সাহসের কাছে ভূত মাথা নোয়াতে বাধ্য। যেটা এ বার বিধাননগর দেখাল। হার না মানার এই সাহসটা বড্ড জরুরি। ‘ডর কে আগে জিত হ্যায়’ কি না, সেটা জোর দিয়ে বলতে পারি না। তবে ভয়কে জয় করতে পারলে শান্তি নিশ্চিত। অন্তত ভোটের দিন ভূত তাড়াতে এটা তাৎক্ষণিক মন্ত্র।
তবে ভোটের দিন জেগে ওঠার এই সাহসটা সঞ্চয় করতে হলে সবার আগে দরকার নিজের বোধটাকে জাগিয়ে তোলা। গণতন্ত্রের বোধ, গণতান্ত্রিক দায়দায়িত্ব বা বিশ্বাস— সবটাকেই জাগিয়ে তুলতে হবে শিকড় থেকে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র আমাদের দেশে। তবু সেই দেশেই প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের মনে এই গণতান্ত্রিক বোধটারই বড্ড অভাব। এ দেশ এখনও ভাবে ভোট দিয়ে রাজা-রানি আনছি। তাঁরা মাথার উপরে থাকবেন। যা বলবেন, সেটাই শেষ কথা। কিন্তু গণতন্ত্র তো তা নয়। যারা ক্ষমতার শীর্ষে বসছে, তাদের ক্ষমতাটা যে আসলে আমাদের সাধারণ মানুষেরই ক্ষমতা, ভোট দিয়ে সেই ক্ষমতা আমরাই প্রতিনিধি হিসেবে তাদের হাতে তুলে দিয়েছি— এই সহজ সত্যিটা আমরা বেশির ভাগ মানুষই মনে রাখি না। ক্ষমতার আসনে বসা মানুষগুলোরও তাই সেটা মনে রাখার দায় থাকে না। তারা যা ইচ্ছে তা-ই করে। সেই স্বেচ্ছাচার আমরা কিছুটা ভয়ে, কিছুটা দায়ে মেনে নিই।
ভূত তাড়াতে হলে এটাই আমূল পাল্টানো দরকার। নিজেদের ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখা দরকার। শাসকের আসনে থাকা মানুষগুলোকে জানান দেওয়া দরকার, আমরা যা চাইছি তা না হলে, অন্যায়-অবিচার হলে, তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও আমাদেরই হাতে। তা না হলে তো ভূতেরাই আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে।
আমাদেরই মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ ক্ষমতার পরিবৃত্তে থাকতে ভালবাসেন। ব্যবসায়িক লাভ, বাড়তি উপার্জন, ক্ষমতার ছটার মতো কিছু ছোটখাটো সুযোগ-সুবিধার লোভে তোষামোদ করতে করতে তাঁরা ক্রমশ শাসকের ক্রীতদাসে পরিণত হন। ফলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করার ক্ষমতা হারান। শাসকের সুনজরে থাকতে মিছিলে পা মেলাতে হবে, গলা ফাটাতে হবে, গান গাইতে হবে— এই প্রবণতাগুলোই বন্ধ করাটা খুব জরুরি। এ বারের নির্বাচন বলে শুধু নয়, রং আর দল নির্বিশেষে কোনও সময়েই কারও জন্য এটা করার দরকার নেই। বরং সুশাসন বা সুবিচার না পেলে মসনদ নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতাটা যেন থাকে। রাজনৈতিক মতাদর্শটা একেবারেই ব্যক্তিগত বিষয়। যে যাঁর নিজস্ব ধারণা বা আদর্শের জায়গা থেকে নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। কেউ যেন সেটাকে প্রভাবিত না করে। তেমনই শাসকের সুনজর থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা বা সন্তানকে দুধেভাতে রাখার আকাঙ্ক্ষা— কোনওটাই যেন প্রভাবিত হওয়ার কারণ হয়েও না ওঠে। এটা খুব জরুরি বলে মনে হয় আমার।
একটু আগে বিধাননগরের ভোটের কথা বলছিলাম। সেখানে ভূত তাড়ানোর কৃতিত্ব যেমন ওখানকার বাসিন্দাদের, তেমনই অনেকখানি ভোট-নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং পুলিশের। আমাদের নিরাপত্তার ভার যাঁদের হাতে, তাঁদের শুধু এই নির্বাচনেই নয়, সব সময়েই এমন নিরপেক্ষ ভূমিকায় দেখতে চাই।
কিন্তু, এখানে একটা প্রশ্নও থেকে যায়। একটা সভ্য দেশে কেনই বা লোক-লস্কর, সেপাই-মিলিটারি এনে যুদ্ধের মতো ভোট করাতে হবে? ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় এত হানাহানি, হিংসার দরকারই বা কী?
এই পরিস্থিতিটাই পাল্টাতে, নিজেদের ক্ষমতার বোধ গড়ে তুলতে দরকার শিক্ষার আলো। সেই আলোটাই মনের জোর হয়ে উঠবে। ভারতবর্ষে এখনও একটা বড় অংশের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া যায়নি— সেই অক্ষমতার দিকটা মানছি। কিন্তু অশিক্ষা থেকে উঠে আসতে, পাশে দাঁড়াতেও শিক্ষা দরকার। কিন্তু অশিক্ষা যদি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায়, অশিক্ষাটাকেই যদি গ্ল্যামারাইজ করা হয়, তা হলে সমূহ বিপদ। অশিক্ষার এই সংস্কৃতিটাকে বন্ধ করতে হবে। তার জন্য সচেতন হতে হবে শিক্ষিত মানুষকেই।
শুধু শিক্ষা-দীক্ষায় নয়, সচেতনতা জরুরি আচরণেও। নিজেদের ক্ষমতায় দেশকে ভাল রাখার কাজটা শুরু করুন এক্কেবারে গোড়া থেকে। ধরা যাক, জঞ্জাল ফেলে নিজেরই শহরের রাস্তা নোংরা করাটা বন্ধ করুন। গাড়ি থেকে অবলীলায় পথে-ঘাটে প্লাস্টিকের মতো ক্ষতিকর জিনিস ছুড়ে ফেলার অভ্যাসটা পাল্টান। নিজের শহরটাকে ভাল রাখাটাও গণতান্ত্রিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিন্তু।
লাইক চ্যারিটি, রেভলিউশন অলসো বিগিন্স অ্যাট হোম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy