Advertisement
২২ মে ২০২৪

ঘরের সঙ্গে লড়াই বাইরের, তাল ঠুকছে নারদ

আবুল কাশেম মোল্লাকে এখান থেকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জে। জেলা নেতৃত্বের একটি অংশের মতে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরম আকার নেওয়াতেই সরানো হয়েছে কাশেমকে। কিন্তু তাতেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এড়ানো যায়নি।

নুরুল আবসার
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৬ ০২:০৪
Share: Save:

মেঠো রাস্তায় হাঁটছেন তিনি। প্রচণ্ড দহনেও পরনে ফুলহাতা সাফারি সুট। মাথায় ‘ক্যাপ’। পায়ে স্নিকার। কর্মী-সমর্থকদের দেওয়া বিশাল গোড়ের মালা ঝুলছে গলায়। হাঁটার ভঙ্গিতে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের ছায়া। থেকে থেকে কাউকে নমস্কার, কখনও আবার মাথার উপরে দু’হাত তুলে গ্রামবাসীর অভিবাদন নিচ্ছেন।

মিছিলের সামনেই একটি টোটো থেকে মাইকে ছড়িয়ে যাচ্ছে তাঁর আসার খবর। পিছনে সারি দিয়ে পর পর ইঞ্জিন ভ্যানে দলের পতাকা হাতে সমর্থকেরা। মাইকে আওয়াজ, ‘জগৎবল্লভপুরের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী আমাদের গ্রামে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় করুন’। হাঁটালের গ্রামে গ্রামে ঘোরার ফাঁকেই গলার মালা খুলে ফেললেন জগৎবল্লভপুরের তৃণমূল প্রার্থী মহম্মদ আব্দুল গনি। কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান। আক্ষরিক অর্থেই হেভিওয়েট।

একই দিন, অথচ ভিন্ন ছবি হাঁটালের অন্য প্রান্তে জগদীশপুর ২ পঞ্চায়েতের বাঁকুল গ্রামে। নেই লম্বা মিছিল। প্রার্থীকে পরিচয় করাতে টোটো গাড়িতে মাইকে ঘোযণাও নেই। লোকজন বলতে গুটিকয়েক দলীয় কর্মী-সমর্থক। তাঁদের নিয়েই হাঁটছেন পরনে কালো প্যান্টের উপরে সাদা শার্ট গায়ে ছোটখাটো চেহারার বৈদ্যনাথ বসু, সিপিএম তথা জোটের প্রার্থী। বললেন, ‘‘নাম ঘোষণা হতেই পথে নেমেছি। সবার কাছেই পৌঁছনোর চেষ্টা করছি।’’ প্রতিপক্ষের মতো চোখ ধাঁধানো প্রচার নেই তাঁর। তবুও হাওড়ার এই কেন্দ্র জায়গা করে নিয়েছে জেলার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনায়। ২০১১ সালে কংগ্রেস-তৃণমূলের জোটের এই আসনে জেতেন তৃণমূলের আবুল কাশেম মোল্লা। সিপিএমের কাজি জাফর আহমেদ পিছিয়ে ছিলেন প্রায় ২৫ হাজার ভোটে। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে তৃণমূল ২৬ হাজার ভোটে হারিয়েছিল সিপিএমকে। কংগ্রেসের পক্ষে ভোট পড়ে ৮১৭৮টি। এ বার কংগ্রেসের জোট বামেদের সঙ্গে। সেই হিসাবে লোকসভায় কংগ্রেসের ভোট সিপিএমের বাক্সে পড়লেও বিপদের তেমন সম্ভাবনা নেই তৃণমূল প্রার্থীর। তা সত্ত্বেও উঠে এসেছে কিছু প্রশ্ন, যা নিয়ে জেলা তৃণমূলে অস্বস্তিও রয়েছে।


ভোট-প্রচারের ফাঁকে দুই প্রার্থী। ছবি: সুব্রত জানা।

আবুল কাশেম মোল্লাকে এখান থেকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জে। জেলা নেতৃত্বের একটি অংশের মতে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরম আকার নেওয়াতেই সরানো হয়েছে কাশেমকে। কিন্তু তাতেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এড়ানো যায়নি। এই কেন্দ্রের যে সাতটি পঞ্চায়েত ডোমজুড়ে পড়ে সেখানে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণেই যে নির্বাচনী কাজকর্ম এখনও গুছিয়ে আনা যায়নি তা স্বীকার করেছে দলেরই একাংশ।

কাশেম ছিলেন ঘরের ছেলে। বাড়ি মুন্সিরহাটে। গনি বহিরাগত। বাড়ি মালদহে। এখন থাকেন হাওড়া শহরে। গ্রামের রাস্তায় সাড়ম্বরে পদযাত্রা করলেও বাড়ি বাড়ি যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অনীহা দেখা গিয়েছে। দলীয় কর্মীদেরই কেউ কেউ বলছেন, প্রচারের সময়েই যদি তিনি এমন করেন, তা-হলে জেতার পরে তো টিকি দেখা যাবে না। প্রতিপক্ষের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে মাথায় না রেখে প্রচারে এই বিষয়টাই হাতিয়ার বৈদ্যনাথের। বলছেন, ‘‘জেতা প্রার্থীকে সরিয়ে কেন নতুন প্রার্থী আনতে হল সেই প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ।’’

বর্ধিষ্ণু জগৎবল্লভপুরের বড়গাছিয়ায় রয়েছে এক গুচ্ছ ছোট কারখানা। স্থানীয় গোহালপোতা গ্রামেই রয়েছে চণ্ডীমাতা ফিল্মসের কর্ণধার সত্যনারায়ণ খাঁ-র বাড়ি। এক সময়ে উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়াদেবীর মতো তারকারা এসেছেন শুটিং করতে। ধন্যি মেয়ে, সন্ন্যাসী রাজা, বনপলাশির পদাবলীর মতো বহু ছবির শুটিং হয়েছে এই গ্রামে। মুন্সিরহাট, বড়গাছিয়া প্রভৃতি গঞ্জ শহুরে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সমস্যা। যানজট, নিকাশি নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত মানুষ। সঙ্গে যোগ হয়েছে বড়গাছিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের দুর্দশা। গোহালপোতার অভিমান, মহানায়কের স্মৃতিজড়িত এই গ্রামকে পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করা যেত। কিন্তু তা হয়নি। এই সব ইসুর পাশাপাশি মানুষের কাছে সারদা, নারদ কেলেঙ্কারি, ডিজিটাল রেশন কার্ড না পাওয়া, দুর্নীতি সবই তুলে ধরছেন বিরোধীরা। তবে সব ছাপিয়ে তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘বহিরাগত’ তকমা প্রবল হয়ে উঠছে। মুন্সিরহাটের ধসায় চায়ের দোকানি ও খদ্দেরদের বেশিরভাগই জানালেন, তৃণমূলের হাওয়া অনেকটাই বেশি ছিল। কিন্তু প্রার্থী বাইরে থেকে আসায় সিপিএমের কিছুটা সুবিধা হয়েছে। কারণ ঘরের ছেলের উপরেই ভরসা করেছে তারা।

এ সব কথায় অবশ্য আমলই দিচ্ছেন না গনি। তাঁর দাবি, প্রার্থী হওয়ার আগে থেকেই তিনি এখানকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে নিয়মিত যোগ দেন। তাই নতুন করে জনসংযোগের প্রয়োজন হয়নি। সেইসঙ্গে বলছেন, ‘‘মুন্সিরহাটে অনেক ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে এখানকার মানুষের সঙ্গে আমার সরাসরি যোগ আছে।’’

এখন দেখার ‘বহিরাগত’ তকমার সঙ্গে লড়াই করে তৃণমূল প্রার্থী গড় রক্ষা করতে পারেন কি না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Narada
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE