Advertisement
০৪ মে ২০২৪

ধূপগুড়ির সেই কিশোরীর স্মৃতি ছায়া ফেলছে ভোটে

ভোটের কথা তুললেই ধূপগুড়ি ফিরে যায় অতীতে। যে অতীত ছড়িয়ে থাকে দিগন্ত বিস্তৃত ধানখেত চিরে যাওয়া রেল লাইনের পাশে, শহরের ফালাকাটা রোডের ধারে, জাতীয় সড়কের দু’দিকের হিমঘরে। ভোটের ময়দানে সেই টুকরোগুলিই যেন জীবন্ত হয়ে বাতাসে ভাসছে। তাতে রয়েছে এক পরিবারের ঘর ছাড়ার কাহিনি।

অনির্বাণ রায়
ধূপগুড়ি শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:২১
Share: Save:

ভোটের কথা তুললেই ধূপগুড়ি ফিরে যায় অতীতে।

যে অতীত ছড়িয়ে থাকে দিগন্ত বিস্তৃত ধানখেত চিরে যাওয়া রেল লাইনের পাশে, শহরের ফালাকাটা রোডের ধারে, জাতীয় সড়কের দু’দিকের হিমঘরে। ভোটের ময়দানে সেই টুকরোগুলিই যেন জীবন্ত হয়ে বাতাসে ভাসছে। তাতে রয়েছে এক পরিবারের ঘর ছাড়ার কাহিনি।

এখনও দিনের শেষে ঘরে ফিরতে পথ ভুল করে একটি বাছুর। সোনা। মাঠ থেকে ফিরে অভ্যেস মতো সোনা এসে হাজির হলেই বাইরে থেকে বৃদ্ধ হাঁক দেন নাতিকে, ‘‘দাদুভাই সোনাকে ধর।’’ চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সেই বালক গিয়ে সোনার মুখ ঘুরিয়ে দেয় উঠোনের আর এক দিকে। আসলে সোনার তো দোষ নেই। সোনার গোয়ালই যে এখন ওই বৃদ্ধর মেয়ের সংসার। গোয়াল মেরামত করে মাস দুয়েক ধরে সেখানেই থাকেন এক দম্পতি ও তাঁদের ছোট দুই ছেলেমেয়ে।

পড়ন্ত বিকেলে উঠোনে বসে চোখে চশমা আঁটেন পরিবারের কর্তা। অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে এ বার দু’বিঘায় পাট লাগিয়েছেন। দূরে মাইকে ভেসে আসছে কোনও পথসভায় তোলা স্লোগানের কলি। ভোটের কথা তুলতেই ফিরে গেলেন অতীতে—রাজ্যে সবে পরিবর্তন এসেছে। ২০১২ সালের ধূপগুড়ি পুরভোট। তৃণমূলের হয়ে মিছিল-সভায় তিনি পরিচিত মুখ। জানালেন, তাঁর বাড়িতে তখন সর্ব ক্ষণ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের আনাগোনা। এক সঙ্গে পান্তা খাওয়া। বিজয় মিছিল থেকে সারা গায়ে সবুজ আবির মেখে বাড়ি ফেরা। বাড়ির পাশেই ল্যাম্পপোস্ট।

সেই ল্যাম্পপোস্টের নীচেই এক রাতে পাল্টে গেল তাঁদের জীবন।

সেখানেই সালিশি সভায় এক রাতে ডাক পড়েছিল তাঁর। সভা ডেকেছিলেন তৃণমূলের নেতারাই। সেই সভাতেই তাঁকে মারধরের প্রতিবাদ করেছিল দশম শ্রেণির ছাত্রী বড় মেয়ে। সভার মাতব্বরেরা তখন সেই কিশোরীকে থুতু চাটতে বলে। ভয়ে অপমানে সেই কিশোরী অন্ধকারের দিকে দৌড়ে যায়। তার বাবাকে আটকে রাখে মাতব্বরেরা।

মেয়ে আর ফেরেনি। বাড়ির পাশের রেললাইনের ধার থেকে পর দিন ভোরে তার ক্ষতবিক্ষত দেহ মিলল। ২০১৪-র ২ সেপ্টেম্বর সেই ঘটনার পরে ১৪ জনের বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ করেছিলেন তিনি। অভিযুক্তরা সকলেই তৃণমূলের নেতা-কর্মী। এখন বলেন, ‘‘সে দিন কোনও নেতাকে পাশে পাইনি। সকলেই অভিযুক্তদের পক্ষে গেলেন। আমার উপরে শুরু হল হুমকি।’’

অতীত বলছে, শেষ পর্যন্ত অভিযুক্তদের সকলেই ধরা পড়ে। কিন্তু মামলার প্রধান সাক্ষীই খুন হয়ে যান। আরও আশ্চর্যের, সেই খুনে জড়িয়ে যায় ওই ছাত্রীর বাবারই নাম। তিন মাস জেল পর্যন্ত খাটতে হয় তাঁকে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে অভিযুক্তদের হুমকিকে এখন ঘরছাড়া ছাত্রীর পরিবার। ঠাঁই হয়েছে শ্বশুরবাড়ির গোয়ালে।

ওই ছাত্রীর বাবা এখনও প্রচারে যান। কিন্তু এখন জোট প্রার্থী সিপিএমের মমতা রায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বলেন, ‘‘আমার মেয়ের খুনের বিচার চাই। তাই পতাকা পরিবর্তন করেছি।’’

ছাত্রী খুনের পরে প্রতিবাদে পথে হেঁটেছিল ধুপগুড়ি। কিন্তু সেই ছাত্রীর বাবাকেই মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ ওঠায়, সেই মিছিলে হাঁটা মুখগুলোও এখন আতঙ্কিত। তবে শহরের হাটে বাজারে এখনও সেই ছাত্রীর মৃত্যুর তদন্তের দাবি শোনা যায়। তাই ধূপগুড়ির তৃণমূল প্রার্থী মিতালি রায় বলেন, ‘‘কে কী করেছে, জানি না। তবে ছাত্রীর মৃত্যু নিশ্চয়ই মর্মান্তিক। ভোটে জেতার পরে ওদের বাড়ি যাব, ওদের সুবিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করব।’’

মিতালিদেবীকেও তাড়া করছে অতীত। এক সময়ের দাপুটে কেপিপি নেত্রী মিতালিদেবী বছর তিনেক আগে তৃণমূলে যোগ দেন। ধূপগুড়ির তৃণমূল নেতারা রাজ্য নেতৃত্বের কাছে যে তালিকা পাঠান, তাতে মিতালিদেবীর নাম ছিল না। কিন্তু তাঁকেই প্রার্থী করার পরে নেতাদের মান-অভিমান ছিল।

তবে বাম-কংগ্রেসের ভোট যোগ করার পরেও, গত লোকসভা নির্বাচনে ধূপগুড়ি বিধানসভা এলাকায় তৃণমূল এগিয়ে ছিল প্রায় সাড়ে চার হাজার ভোটে।

কিন্তু তাতে নিশ্চিন্ত হওয়ার জো কোথায়? ওই গোয়ালঘর, ওই ল্যাম্পপোস্ট সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পরের ঘটনাক্রমের। তৃণমূল জানে, তার প্রভাব ভোটে পড়বে। তাই প্রচারে বলে চলেছেন, ‘‘অতীত দেখবেন না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 dhupguri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE