Advertisement
১৭ মে ২০২৪
কমিশনের পদক্ষেপে খুশি বিরোধীরা

এ বার পালা কার, চিন্তা সর্বত্র

শাসকদলের সঙ্গে অত্যধিক ঘনিষ্ঠতা। পুলিশ লকআপে প্রৌঢ়কে পিটিয়ে মারা। বিরোধীদের নানা ভাবে হেনস্থা করা। এমন ভুরি ভুরি অভিযোগ তুলে তাঁর বদলির দাবিতে শহরজুড়ে পোস্টার পড়েছিল বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশের বহু আগেই। রামপুরহাটের সেই বিতর্কিত আইসি আবু সেলিম-সহ জেলার চার পুলিশ আধিকারিককে নির্বাচন কমিশন সরিয়ে দেওয়ায় বিন্দুমাত্র অবাক হয়নি বিরোধীরা।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৬ ০১:৫৮
Share: Save:

শাসকদলের সঙ্গে অত্যধিক ঘনিষ্ঠতা। পুলিশ লকআপে প্রৌঢ়কে পিটিয়ে মারা। বিরোধীদের নানা ভাবে হেনস্থা করা।

এমন ভুরি ভুরি অভিযোগ তুলে তাঁর বদলির দাবিতে শহরজুড়ে পোস্টার পড়েছিল বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশের বহু আগেই। রামপুরহাটের সেই বিতর্কিত আইসি আবু সেলিম-সহ জেলার চার পুলিশ আধিকারিককে নির্বাচন কমিশন সরিয়ে দেওয়ায় বিন্দুমাত্র অবাক হয়নি বিরোধীরা। বরং মেদিনীপুর থেকে ভারতী ঘোষের অপসারণের খবর তাঁদের উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কোনও দিন আরও বড়সড় রদবদলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিরোধীরা। ভোটের মুখে নির্বাচন কমিশনের এমন কড়া মনোভাব দেখে আতঙ্কিত জেলা পুলিশ-প্রশাসনের একটা বড় অংশই। গোটা পরিস্থিতিই চাপ বাড়িয়েছে শাসকদলের অন্দরেও। প্রকাশ্যে মানতে নারাজ হলেও আড়ালে সে কথা অস্বীকার করছেন না অনেক তাবড় তাবড় তৃণমূল নেতাই।

কমিশন আবু সেলিম ছাড়াও বোলপুরের আইসি প্রবীর দত্ত, নানুর থানার ওসি পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় এবং ময়ূরেশ্বর থানার ওসি রাকেশ সাধুকে সরিয়ে দিয়েছে। বছর দুয়েক ধরে বোলপুরে কর্মরত ছিলেন প্রবীরবাবু। আবু সেলিম রামপুরহাট থানায় যোগ দিয়েছিলেন গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি। অপসারিত অন্য দুই ওসি বিগত ছ’মাস ধরে থানাগুলির দায়িত্বে ছিলেন। ভোট-পর্ব শুরুর মুখেই কমিশনের এই পদক্ষেপ অন্য রকম ‘বার্তা’ দিচ্ছে বলেই মনে করছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সিউড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম। জেলা কংগ্রেস সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মির বক্তব্য, ‘‘আবু সেলিম কাঁদের কথাই ওঠবোস করতেন, সবাই জানেন। পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের অতিরিক্ত শাসক-ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়াটাই তৃণমূলের আমলে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনিতর জন্য দায়ী। অবাধ ভোটের কথা মাথায় রেখে কমিশনকে ওঁদের সরাতেই হতো।’’

ঘটনা হল, জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ নতুন নয়। নানা ঘটনায় তৃণমূল এবং বিরোধীদের এই জেলার পুলিশকে দু’রকম আচরণ করতে দেখা গিয়েছে। এক যাত্রায় দু’রকম ফলের অভিযোগও উঠেছে। শাসকদলের নেতাদের বিশেষ সম্পর্ক নিয়েও বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে পুলিশের একাংশ। যার জেরে অতীতে খুন ও উস্কানির মামলায় পুলিশ জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের তেমন ‘দোষ’ খুঁজে পায়নি। এমনকী, প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিলেও চার্জশিট থেকেই নাম বাদ যায় লাভপুরের বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের। জেলা পুলিশের কর্তারা অবশ্য বরাবর, আইন মেনে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করছেন বলেই দাবি করে এসেছেন। তার পরেও মনিরুলের মতো শাসকদলের নেতারা যখন প্রকাশ্য মঞ্চে গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেন, ‘এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ। আর বীরভূমের পুলিশের মাথায় অনুব্রত মণ্ডলের হাত রয়েছে’— তখন প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন বিরোধী দলগুলির নেতারা। সিপিএমের এক নেতার কথায়, ‘‘এই পুলিশ-প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অনুব্রত যে ভাবে বারবার ভোট ‘করিয়ে’ নেওয়ার বার্তা দিয়ে চলেছেন। যে ভাবে ভোট দিতে বাধা দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, তাতে বিরোধী ভোটারদের মনে আতঙ্ক তৈরি হবেই।’’ এই প্রেক্ষিতেই ভোটের মুখে জেলার চার পুলিশ আধিকারিককে সরিয়ে দিয়ে কমিশন অবাধ ভোটের বার্তা দিয়ে ভোটারদের আস্থা ফেরাতে চাইছে বলেই মনে করছে বিরোধীরা।

কেন সরতে হল ওঁদের?

পুলিশ সূত্রের খবর, মোটের উপরে দু’টি বড় কারণ রয়েছে। এক, এলাকার আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা। দুই, শাসকদলের হয়ে পক্ষপাতমূলক কাজ করার একের পর এক নালিশ। রামপুরহাটের আইসি-র নানা কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এলাকায় বিস্তর আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। এলাকায় তোলাবাজির অভিযোগ আগেই ছিল। থানা ভাঙচুর, পুলিশের গাড়িতে অগ্নি সংযোগের ঘটনায় যথেষ্টই মুখ পুড়েছিল ময়ূরেশ্বর থানার পুলিশের। আবার নানুর থানা এলাকায় বারবার রাজনৈতিক সংঘর্ষ, খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। পরপর বোমাও উদ্ধার হয়েছে। ফেরার অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থেকেছে। পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার ছবিটা ততই বেরিয়ে পড়েছে। এলাকার আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ছিল বোলপুরেও। পরপর চুরির ঘটনায় পুলিশ কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়েই বসেছিল বলে অভিযোগ। আবার সাম্প্রতিক কালে বাহিরী পঞ্চায়েত এলাকায় শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দুষ্কৃতীদের সংঘর্ষ থামাতেও ব্যর্থ হয়েছে বোলপুর থানা। এর সব কিছুরই মাসুল ওই পুলিশ আধিকারিকদের দিতে হয়েছে বলে মত জেলা পুলিশের একাংশের।

এ দিকে, নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে এখনও পর্যন্ত জেলায় কী পরিমাণ বোমা ও অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি জেলার সুপার মুকেশ কুমার। তবে, পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মুহূর্তে পরোয়ানা জারি হওয়া প্রায় সাড়ে তিনশো অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারেনি জেলার পুলিশ। চার পুলিশ আধিকারিককে সরিয়ে দেওয়া, আইনশৃঙ্খলার হাল নিয়ে ওঠা অভিযোগ— এ সবের দায় কি আপনারও নয়? সরাসরি জবাব দেননি জেলার এসপি মুকেশ কুমার। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়। প্রায় প্রতিবারই ভোটের সময়ে কিছু অফিসার বদল করা হয়। অনেক জেলায় তো এসপি, ডিএম, এমনকী বীরভূমের চেয়ে বেশি অফিসার বদল হয়েছে। এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার। কমিশনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।’’ বহু চেষ্টা করেও জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। অন্য দিকে, গোটা ঘটনায় অনুব্রতর বক্তব্য, ‘‘নির্বাচন কমিশন যেটা ভাল বুঝেছে, করেছে। তাদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।’’

পরের নম্বর কার, ঘোর চিন্তায় জেলা পুলিশ-প্রশাসনের বহু কর্তাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE