Advertisement
২৪ মে ২০২৪

ইতিহাসের চাকা ঘোরাতে নৌকা পাড়ি

ইতিহাসের একটা খারাপ অভ্যাস আছে। সে ফিরে ফিরে আসে। বলেছিলেন এক জার্মান দার্শনিক। পূর্ব মেদিনীপুরের এক জাঁদরেল ভূখণ্ডে তাঁর পা পড়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। তবে এখন এক বার ঘুরে গেলে দেখতে পেতেন, তাঁর কথা কেমন ফলে যাচ্ছে! খুশি হতেন কি না, বলা অবশ্য মুশকিল!

হেঁড়িয়ায় সিপিএমের জোনাল পার্টি অফিস। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরে মাসখানেক আগে খুলেছে এই ভবনটি। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

হেঁড়িয়ায় সিপিএমের জোনাল পার্টি অফিস। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরে মাসখানেক আগে খুলেছে এই ভবনটি। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

সন্দীপন চক্রবর্তী
খেজুরি শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৬ ০৪:৩৯
Share: Save:

ইতিহাসের একটা খারাপ অভ্যাস আছে। সে ফিরে ফিরে আসে।

বলেছিলেন এক জার্মান দার্শনিক। পূর্ব মেদিনীপুরের এক জাঁদরেল ভূখণ্ডে তাঁর পা পড়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। তবে এখন এক বার ঘুরে গেলে দেখতে পেতেন, তাঁর কথা কেমন ফলে যাচ্ছে! খুশি হতেন কি না, বলা অবশ্য মুশকিল!

বিগত জমানায় পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে গ্রামে গ্রামে সাদা থান পাঠানোর খবর বাংলায় ছড়িয়ে দিয়ে হাড় হিম করে দিয়েছিল যে জায়গা, তারই নাম খেজুরি। ভোটটা জায়গামতো পড়া চাই। নয়তো বাড়ির মহিলাদের সাদা থান পরার জন্য তৈরি থাকতে হবে! শান্তিপূর্ণ, কিন্তু কী অমোঘ বার্তা! ভাজাচাউলি, কামারদা, বারাতলা, বিদ্যাপীঠ— একের পর এক সব পিলে চমকানো নাম! বিরোধিতার স্বর দাবিয়ে রাখার পীঠস্থান একেবারে। গোটা খেজুরি তখন লালে লাল।

সে সব দিন ইতিহাস হয়ে গিয়েছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু ঠিকও নয় পুরোপুরি। ইতিহাস ফিরে এসেছে গত পাঁচ বছরে। আরও ভয়ঙ্কর চেহারায়। বাংলায় পরিবর্তন এনেছিল যারা, গুরুমারা বিদ্যার সার্থক প্রয়োগ তারা খেজুরিতেও ঘটিয়েছে! এই বিধানসভা ভোটের মুখে গ্রামে গ্রামে ঘরবন্ধ সন্ত্রস্ত জনতার হৃদ্স্পন্দন প্রায় থামিয়ে দিয়ে বাইক বাহিনীকে তাই শূন্যে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। আর খবর পেয়ে হেঁড়িয়ার জোনাল কার্যালয়ে বসে সিপিএম নেতা হিমাংশু দাস থানার ওসি এবং জেলার পুলিশ সুপারকে ফোন করেন। পুলিশ সুপার নিরুত্তাপ গলায় বলেন, ভোটের আগের দিন থেকে একটা পাতাও নড়বে না! দেখুন না!

হিমাংশুবাবুরা একটা ঘটনা আর কী দেখবেন? তাঁরা আসলে ইতিহাস দেখছেন। কয়েক বছর আগে খেজুরিতে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত যাঁর কথায়, তিনি সিপিএমের জোনাল সম্পাদক ও তৎকালীন পঞ্চায়েত সমিতির প্রধান হিমাংশুবাবু। নন্দীগ্রামে তুলকালাম সংঘর্ষের সময়ে সিপিএমের ঘরছাড়া সমর্থকদের ভরসা ছিলেন হিমাংশুবাবু। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি বরাবর অভিযোগ করে এসেছিল, খালের ও’পারে খেজুরি থেকেই বোমা-গুলি আছড়ে পড়ত নন্দীগ্রামে। দুষ্কর্ম করে দুষ্কৃতীরা নাকি খেজুরি দিয়েই পিঠটান দিত।

আর এখন? পরিবর্তনের জমানায় হিমাংশুবাবুর লোকজনই দিনের পর দিন ঘরছাড়া থেকেছেন। তল্লাট জুড়ে সব দলীয় কার্যালয় বেদখল নয়তো ভাঙচুর হয়েছে। এ বার ভোটের অল্প দিন আগে লেনিনের জন্মদিনে আবার কার্যালয় খুলে বসেছে সিপিএম। মাসখানেক আগে খোলা হয়েছে হেঁড়িয়ার জোনাল কার্যালয়ও। বাড়ির জানলা-দরজা পর্যন্ত খুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল অধুনা শাসক দলের বাহিনী। কাঠের নতুন পাল্লা লাগিয়ে, কোনও রকমে শৌচালয় গড়ে সেখানে আবার দলের কর্মীদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। গৃহকর্তার মতো তাঁদের আগলে রেখেছেন হিমাংশুবাবু। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুকে এনে পদযাত্রা করিয়ে কর্মীদের মনোবল ফেরানোর চেষ্টা করেছেন।

কী মনে হচ্ছে? তাঁদের কৃতকর্মই উল্টো হয়ে ফিরেছে তা হলে? প্রচারের শেষ দিনে ১৪ কিলোমিটার হেঁটে ফিরেও হিমাংশুবাবুর হাসি অমলিন। বলছেন, ‘‘ওই ফাটা রেকর্ড আর কত দিন চলবে? কাগজপত্র বার করে আনুন। আমরা বিরোধীদের ভোটই দিতে দিইনি, এমন হয়েছে? আর এরা গত কয়েক বছরে কী করেছে?’’

যুগের ফেরে সেই খেজুরিতে এ বার সিপিএমের প্রতীকে প্রার্থীই নেই! পাল-তোলা নৌকো চিহ্নে গণতান্ত্রিক জোট সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়েছেন অসীম মণ্ডল। আদতে সমাজবাদী পার্টি থেকে আসা। তাঁর সমর্থনে মিছিলে হেঁটেছেন অধীর চৌধুরী, রবীন দেবেরা। কিন্তু নিজেদের প্রতীকে প্রার্থী দেওয়া গেল না কেন? হিমাংশুবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘এত দিন বাইরে থেকে লোকগুলো ঘরে ফিরেছে। সন্ত্রাসের পরিবেশ আছে। আবার তৃণমূলেও বিক্ষুব্ধ আছে। তাই সকলের সমর্থন পেতে নির্দল প্রার্থী দেওয়াই ঠিক হয়েছে।’’ তবে বিধানসভা কেন্দ্রের ২৪৪টি বুথের জন্য এজেন্ট বাছাই করে চুপচাপ তাঁদের প্রশিক্ষণ সেরে ফেলেছে সিপিএম। হিমাংশুবাবুরা বলছেন, ‘‘জীবনের শেষ যুদ্ধ মনে করে লড়ছে ওরা! যা হয় হবে!’’

জেলা তৃণমূলের নেতা এবং পাশের কেন্দ্র থেকে দলের তারকা-প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী প্রত্যাশিত ভাবেই বলছেন, ‘‘সিপিএমের ভোট চাওয়ারই অধিকার নেই! ওরা কী করেছিল, মনে নেই?’’ কিন্তু তাঁরা তো একই জিনিস করছেন? এ বার খেজুরির তৃণমূল প্রার্থী রণজিৎ মণ্ডলের জবাব, ‘‘রাখেন তো ওই সব ভুেয়া গল্প! উন্নয়ন দেখুন, উন্নয়ন। উন্নয়নে আমরা ভাসিয়ে দিয়েছি।’’

লোকসভা ভোটের হিসেব দেখলে পাল-তোলা নৌকার কূল পাওয়া সত্যিই কঠিন! সে বার তৃণমূল এই কেন্দ্রে ৫৩.৯২% ভোট পেয়েছিল, সিপিএম ৩২.৭১%। আর কংগ্রেসের বাক্সে ছিল মাত্র ২৮০০ ভোট। এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নজরে ভোট হলেও প্রায় ২২%-এর ব্যবধান মেটানো কি মুখের কথা? বিজেপি পেয়েছিল ৯% ভোট। খেজুরির প্রাক্তন বাম বিধায়ক স্বদেশ পাত্র এ বার এখানে বিজেপি প্রার্থী। বামেদের দিকে বিজেপি-র ভোটের ‘ঘর ওয়াপসি’ হলেও নৌকোর যাত্রা বেশ টলমলে!

সব প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করেই জোট-প্রার্থী অসীমবাবু অবশ্য বলছেন, ‘‘৫ মে কার্ল মার্ক্সের জন্মদিন। ঐতিহাসিক ভোট হবে সে দিন। জোট সরকার আসছেই!’’ মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ইতিহাসের পুনরাবৃ্ত্তির বাণী দেওয়া সেই দার্শনিকের নামটাও কার্ল মার্ক্স!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Khejuri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE