Advertisement
১৬ মে ২০২৪

শ্রীচরণের হাওয়াই চটিই প্রেরণা শ্রীকান্তের

চৈত্রের পড়ন্ত বিকেল। তৃণমূল অফিসের সামনে দিয়েই এগোচ্ছে জোটের মিছিল। স্লোগান উঠেছে, ‘লুঠ হয়েছে হাজার কোটি/ কে খেয়েছে? হাওয়াই চটি।’

প্রচারেও সঙ্গী হাওয়াই চটি! শালবনির তৃণমূল প্রার্থী শ্রীকান্ত মাহাতো। — নিজস্ব চিত্র

প্রচারেও সঙ্গী হাওয়াই চটি! শালবনির তৃণমূল প্রার্থী শ্রীকান্ত মাহাতো। — নিজস্ব চিত্র

বরুণ দে
শালবনি শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৫৩
Share: Save:

চৈত্রের পড়ন্ত বিকেল। তৃণমূল অফিসের সামনে দিয়েই এগোচ্ছে জোটের মিছিল। স্লোগান উঠেছে, ‘লুঠ হয়েছে হাজার কোটি/ কে খেয়েছে? হাওয়াই চটি।’

শালবনির পার্টি অফিসে বসে পা নাচাচ্ছিলেন এলাকার তৃণমূল প্রার্থী শ্রীকান্ত মাহাতো। পায়ে নীল-সাদা হাওয়াই। সে দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে এক তৃণমূল কর্মী প্রশ্ন করলেন, ‘‘দাদা, কী সব বলছে গো?’’

চটি সমেত পা দ্রুত নেমে এল। চটপট চেয়ার থেকে উঠেও প়ড়লেন এলাকার বিদায়ী বিধায়ক। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘‘রাজনীতিতে এঁটে উঠতে না পেরে কুৎসা করছে। ও সবে কান দিস না।’’

জিন্দলদের কারখানা, কন্যাশ্রী-যুবশ্রী, জোটের অঙ্ক— এ সবের সঙ্গেই শালবনির ভোট বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে হাওয়াই চটির কথা। সেই হাওয়াই চটি, যা কি না শ্রীকান্ত মাহাতোর পদ-যুগলের শ্রী!

গত পাঁচ বছরে অনেক অভ্যেসই পাল্টে ফেলেছেন শ্রীকান্ত। সস্তার ময়লা শার্ট-প্যান্ট ফেলে এখন সব সময় ধোপদুরস্ত সাদা শার্ট-প্যান্ট পরেন। সব সময়ের সঙ্গী আর সাইকেল নয়, চারচাকা। বদলে ফেলেছেন কয়মার মাটির বাড়ির ঠিকানাও। এখন নিবাস শালবনি ব্লক সদরের দোতলা বাড়ি। এই চটিটাই যা ছাড়তে পারেননি!

বছর দশেক আগেও জেলার রাজনীতিতে শ্রীকান্তকে যখন সে ভাবে কেউ চেনে না, ২০০৬ সালে সদ্য তৃণমূলের ভীমপুর অঞ্চল কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, তখনও তাঁর পায়ে থাকত এই হাওয়াই চটি। এর পর একে একে তিনি ব্লক যুব তৃণমূলের সভাপতি হয়েছেন, ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে ভীমপুর পঞ্চায়েতের প্রধান হয়েছেন, তার পর আবার জঙ্গলমহলে মাওবাদী আন্দোলন পর্বে জনগণের কমিটির ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে শ্রীকান্তর বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালে কয়মায় যৌথ বাহিনীর ক্যাম্প ভাঙচুরে নাম জড়িয়ে গ্রেফতারও হয়েছেন শ্রীকান্ত। সেই সময়ও তাঁর পায়ে ছিল সেই হাওয়াই, তবে কিছুটা রংচটা, খয়াটে সুখতলা।

২০১১-র ভোটের আগে আগেই জামিন পেয়ে যান শ্রীকান্ত। বরাত খোলে তার পর। একেবারে বিধানসভার টিকিট। পায়ে হাওয়াই চটি গলিয়েই গোটা শালবনি চষে ফেলেন তৃণমূলের প্রার্থী। কখনও স্ট্র্যাপ ছিঁড়েছে, ধুলো মাখামাখি হয়ে গিয়েছে হাওয়াই, ফের সেফটিপিন লাগিয়ে চলতে শুরু করেছেন শ্রীকান্ত। একের পর এক এলাকা ঘুরেছেন পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে। জিততেও বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।

এর পর বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। জেতার পরে দলের সংগঠনে গুরুত্ব বেড়েছে তরুণ বিধায়কের। প্রথমে জেলা যুব তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি। তার পর একেবারে জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি।

আর পাল্লা দিয়ে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। শালবনির আনাচে-কানাচে কান পাতলেই শোনা যায়, একশো দিনের কাজ থেকে ইন্দিরা আবাসে বাড়ি পাওয়া কিংবা আলুবোঝাই ট্রাকের ওড়িশা সীমানা পার হওয়া— টাকা না দিলে কিছুই হয় না। এমনকী জিন্দলদের কারখানায় চাপ দিয়ে লোক ঢোকানোর পিছনেও নাকি রয়েছে টাকার খেলা।

এত টাকা নেয়টা কে?

প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেললেন শালবনির এক প্রবীণ মাস্টারমশাই। জবাব এল, ‘‘এখানে তো আর নারদের গোপন ক্যামেরা নেই। তা হলেই দেখতে পেতেন কে নেয়। শুধু বলতে পারি, সবের পিছনেই হাওয়াই চটির খেলা।’’ চলতি বছরের গোড়ায় শ্রীকান্তকে জেলা যুব সভাপতির পদ থেকে সরানোর সময়ও কানাঘুষো শোনা গিয়েছিল, শুধু মুকুল রায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা নয়, একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগও দলের শীর্ষ স্তরের কানে পৌঁছেছে।

তার পরেও অবশ্য ভোটের টিকিট পেয়েছেন শ্রীকান্ত। শালবনিতে এ বারও ঘাসফুলের প্রার্থী তিনি। ৪ এপ্রিল ভোট। তাই ফের হাওয়াই পায়ে এলাকায় নেমে পড়েছেন। আর ভোট-বাজারে বিরোধী আক্রমণে বারবার ঘুরেফিরে আসছে সেই হাওয়াই। জোট প্রার্থী সিপিএমের শ্যাম পাণ্ডে যেমন বলছেন, ‘‘তৃণমূল প্রার্থীর হাওয়াই চটি দেখে লোকে আর ভুলছে না। মানুষ জানে পাঁচ বছরে নামে-বেনামে উনি কত সম্পত্তি করেছেন।” বিজেপি প্রার্থী ধীমান কোলের আবার খোঁচা, ‘‘তৃণমূলের উপর থেকে নীচ, সবাই দুর্নীতিতে হাত পাকিয়েছে। সাদা পোশাক আর হাওয়াই চটি পরলেই কি আর সৎ হওয়া যায়!”

বিরোধীদের কথা কানে পৌঁছলে তেতে ওঠেন শাসক দলের প্রার্থী। গলা চ়়ড়িয়ে বললেন, “নির্বাচন কমিশনকে তো হলফনামা দিয়ে দিয়েছি। দেখে নিন না আমার সম্পত্তি কত। মনে রাখবেন যে বাড়িটায় এখন থাকি, সেটাও ভাড়া বাড়ি।”

মনোনয়নের সঙ্গে জমা দেওয়া শ্রীকান্তর হলফনামায় চোখ বুলিয়ে সত্যি হোঁচট খেতে হল। শাসক দলের এক এক জন বিধায়কের সম্পত্তি যেখানে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, সেখানে শ্রীকান্তর সম্পত্তি কমেছে। ২০১১ সালে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ যেখানে ছিল ২ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা, সেটা এখন হয়েছে ১ লক্ষ ৩ হাজার টাকা।

এটা কী ভাবে সম্ভব? শ্রীকান্তর জবাব, ‘‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি করিনি, করবও না। কারও কাছ থেকে কিছু পেয়ে থাকলেও গরিব মানুষকে বিলিয়ে দিয়েছি। এটাই আমার জীবনের ব্রত।’’

তবে তৃণমূলের ঘরেই কান পেতে জানা গেল অন্য অঙ্ক! নেতা-কর্মীদের একাংশ চুপিচুপি বললেন, ‘‘শ্রীকান্তদার স্ত্রী তো আইন নিয়ে পড়েছেন। এক সময় ওকালতিও করতেন। সংখ্যা সোজা-উল্টোনোর হিসেবটা উনি ভালই বোঝেন।’’

দলের লোকেরা কি সত্যি বলছে? শ্রীকান্তর ঠোঁটে এ বার চিলতে হাসি খেলে যায়। ‘ট্রেডমার্ক’ হাওয়াই চটি নাচিয়েই বলতে থাকেন, ‘‘সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগ আর সেই সঙ্গে মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়াটাই রাজনীতি। তৃণমূলে থেকে সেটাই শিখেছি।”

আর হাওয়াই চটিটা? এ বার শ্রীকান্তর জবাব, ‘‘ওটা তো হাফ-প্যান্ট পরা বয়স থেকে সঙ্গী। পায়ে গলালে বাড়তি জোর পাই, অনুপ্রেরণা পাই।’’

চাপা পড়ে না কৌতূহল। চৈত্রের রুক্ষ পথে স্লোগান উড়তে থাকে— ‘লুঠ হয়েছে হাজার কোটি...।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE