Advertisement
E-Paper

‘দাদারা’ জয়ী, সিন্ডিকেটের দাপট ফেরার শঙ্কা

তিনি বলেছিলেন, সিন্ডিকেট-রাজকে তিনি সমর্থন করেন না। ‘যারা সিন্ডিকেট করবে, তারা দল করবে না।’ আবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বক্তব্যকে কার্যত খারিজ করে তাঁরই দলের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত সেই সময় দাবি করেছিলেন, সিন্ডিকেটের কাজ বন্ধ করে দিলে সরকারই উল্টে যাবে!

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ০২:৩৫

তিনি বলেছিলেন, সিন্ডিকেট-রাজকে তিনি সমর্থন করেন না। ‘যারা সিন্ডিকেট করবে, তারা দল করবে না।’ আবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বক্তব্যকে কার্যত খারিজ করে তাঁরই দলের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত সেই সময় দাবি করেছিলেন, সিন্ডিকেটের কাজ বন্ধ করে দিলে সরকারই উল্টে যাবে!

উল্টে যায়নি। বরং বিপুল জনসমর্থন নিয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য বঙ্গের মসনদে ফিরে এসেছে মমতার তৃণমূল। এখন প্রশ্ন উঠেছে, সরকার টিকিয়ে রাখতে সত্যিই কি সিন্ডিকেট-রাজ অপরিহার্য? রাজারহাট-নিউটাউন, রাজারহাট-গোপালপুর ও বিধাননগর কেন্দ্রের ফলাফলে সিন্ডিকেটের প্রভাবের আঁচ কতটা জানতে চাইলে বিধাননগরের পরাজিত কংগ্রেস প্রার্থী অরুণাভ ঘোষের সাফ জবাব, ‘‘সব্যসাচী, সুজিত বসু সিন্ডিকেটের দৌলতেই জিতেছেন।’’

ঘটনা হল, ভোটের দিন সিন্ডিকেটের ছেলেপুলেকে বুথের কাছে ভিড়তে দেয়নি পুলিশ। ‘সিন্ডিকেটবাজ দাদা’দেরও ঠুঁটো করে রাখায় মোটামুটি অবাধ ভোট হয়েছিল। যা দেখে ঘনিষ্ঠ মহলে আক্ষেপ করেছিলেন জয়ী প্রার্থীদের কেউ কেউ। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এখন ভোটে হার-জিত অনেকটা নির্ভর করে সিন্ডিকেটের উপরে। সব্যসাচী তো পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘‘এরা (সিন্ডিকেটের সদস্যেরা) জানে, এমএলএ’র জন্য এক দিন (ভোটের দিন) কাজ করলে পরের সাড়ে চার বছর এমএলএ আমাদের জন্য থাকবে।’’

বৃহস্পতিবারও সব্যসাচী তা-ই বলেছেন। দলীয় সুত্রের ইঙ্গিত, বুথে বুথে ‘কেরামতি’ দেখাতে না-পারলেও ওই তল্লাটে ইমারতি সিন্ডিকেটে জড়িত বিরাট সংখ্যক মানুষ ও তাঁদের পরিবার ‘প্রতিদান’ হিসেবে শাসকদলের প্রতি আনুগত্য উজাড় করে দিয়েছেন ইভিএমে। সঙ্গে জুড়েছে তৃণমূলের ভোট-প্রস্তুতিতে সিন্ডিকেটের টাকার জোর। বিরোধী-মতে, তিন কেন্দ্রে তৃণমূলের জয়ের নেপথ্যে এই দু’টি হল অন্যতম কারণ। তৃণমূলের একাংশও সে তত্ত্বে সিলমোহর দিচ্ছে।

বস্তুত রাজ্যের আনাচে-কানাচে তৃণমূলের বিভিন্ন প্রার্থীর জয়ের পিছনে সিন্ডিকেটের ‘সক্রিয়’ চেহারা দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। ‘‘গত পাঁচ বছর নির্বিবাদে ‘করে খাওয়া’র প্রতিদানই কি প্রতিফলিত হল ভোট-মেশিনে?’’— জিজ্ঞাসা এই মহলের। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, ইদানীং সিন্ডিকেটের রমরমা যে ভাবে গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে কতটা রাশ টানতে পারবেন মুখ্যমন্ত্রী?

নির্মাণশিল্পে জড়িতদের দাবি: পশ্চিমবঙ্গে ইমারতি সিন্ডিকেটের হাত ধরে সমান্তরাল একটা অর্থনীতি চলছে। প্রাথমিক হিসেবে, গত চার বছরে সিন্ডিকেটের পকেটে ফি বছর গড়ে সাড়ে সাতশো কোটি টাকা ঢুকেছে। রাজারহাটের এক সিন্ডিকেট-চাঁইয়ের কথায়, ‘‘এখানকার সিন্ডিকেটের হাতে মোটের উপর তিন হাজার কোটি এসেছে।’’

এ হেন ‘সমান্তরাল অর্থনীতি’কে অবজ্ঞা করে সরকার চালানো যে দস্তুরমতো কঠিন, শাসকদলেরও অনেকেও তা মানছেন। ফলত কসবা থেকে শ্যামবাজার, টালা থেকে টালিগঞ্জ— নগর জুড়ে গজিয়ে ওঠা হাজারো সিন্ডিকেটের মাথায় জাঁকিয়ে বসেছে শাসকের ছাতা। যাতে ঠোক্কর খেয়ে ফিরে যাচ্ছে জুলুমবাজির যাবতীয় অভিযোগ। বাড়ি তৈরির ইট-বালি-সুড়কি সিন্ডিকেটের থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। বেসরকারি বা সরকারি সংস্থারও ছাড় মিলছে না। সিন্ডিকেটের পকেট ফুলে-ফেঁপে উঠছে। তার দাম চোকানো হচ্ছে শাসকদলের প্রতি নিরন্তর আনুগত্য প্রদর্শন ও তহবিলে টাকা জুগিয়ে। বীরভূম-বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-বর্ধমানেও তা-ই। সেখানে পাথর খাদান, অবৈধ কয়লা, নদী থেকে বালি তোলার কারবারেও সিন্ডিকেটের আধিপত্য একচ্ছত্র বলে অভিযোগ।

অনেকের মতে, এ হওয়ারই ছিল। শিল্পের অভাবে বেকার বাড়ছে। কাঁচা টাকার টোপে সিন্ডিকেটের ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে বহু ছেলে। মোটরবাইক থেকে শুরু করে নেশাতুর রাত, দামি পোশাক, মোবাইল, এমনকী বিদেশ ভ্রমণও হাতের মুঠোয়! রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের ‘আশীর্বাদী’ হাত মাথায় থাকায় তারা আরও বেপরোয়া। এলাকা দখলের তাগিদে হামেশা খেয়োখেয়িও বাধছে। ঝরছে রক্ত। যেমন ক’দিন আগে বাগুইআটিতে সঞ্জয় রায় ওরফে বুড়ো নামে এক যুবককে দিনের আলোয় ভরা বাজারে গুলি করে মারা হয়েছে।

আখেরে অবশ্য সিন্ডিকেট-রাজের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। ‘দাদা’দের খাঁই মেটাতে প্রোমোটার দ্বিগুণ-তিনগুণ দরে মাল-মশলা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিণামে ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে। আবার সিন্ডিকেটের জোগানো মাল-মশলার গুণমান ভাল না-হওয়ায় বহু আনকোরা বাড়ি ক’বছরেই ফেটে-ফুটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে! সারা জীবনের সঞ্চয়ের এই গতি দেখে পথে বসছে আমগেরস্ত। প্রসঙ্গত, মমতা এক সময়ে জানিয়েছিলেন, সিন্ডিকেট হল ব্যবসা। যে কেউ করতে পারে। শুধু দেখতে হবে, তারা যেন জুলুম না-করে। অথচ সিন্ডিকেটের কারবারে জুলুমবাজি-ই এখন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ।

সব্যসাচীরা আবার জিতেছেন। অনেকেরই শঙ্কা, সরকার ‘রক্ষা’ করতে সিন্ডিকেট কি আবার বীর-বিক্রমে মাথাচাড়া দেবে?

assembly election 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy