আলো হয়, গেল ভয়। সেই ছেলেবেলায় পড়েছিলাম। মর্মটা অবশ্য বুঝলাম এতদিনে!
এক খানা ডুম ছাড়া ভোটটাই বেবাক বরবাদ হতে বসেছিল। বহু অপেক্ষার পরে আলো জ্বলতেই ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছেড়েছিল। ভোট চলাকালীন অবশ্য কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু, আগে-পরে এত ঘটনা ঘটল যে, তা বহু দিন মনে থাকবে।
আমি বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারভাইজার। থাকি কল্যাণী বি ব্লকে। এর আগে নয় নয় করে তিন বার ভোটের দায়িত্ব সামলেছি। প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে এ বার গিয়েছিলাম রানাঘাটে। সকাল দেখলেই নাকি দিন বোঝা যায়। সেদিন শুরু থেকেই ঠোক্কর। যেখান থেকে ভোটের জন্য ইভিএম-সহ অন্যান্য ভোট সামগ্রী দেওয়া হবে সেখানে হাজার হাজার ভোটকর্মী। অথচ পানীয় জলের তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। নলকূপ ছিল বটে। কিন্তু সে জল এত ঘোলা যে পানের অযোগ্য। তারপর কোনও রকমে একটি বাসে করে আমরা যখন রওনা দিলাম তখন বিকেল। গন্তব্য রানাঘাট উত্তর পূর্ব কেন্দ্রের দত্তপুলিয়ার কাছে ডালুয়াবাড়ি কালীপুর আঞ্চলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
দোতলা স্কুলবাড়ি। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দোতলায় জওয়ানদের থাকার ব্যবস্থা। নিচে বুথ। সেখানেই আমাদের থাকতে হবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। উপরে জওয়ানদের ঘরে আলো জ্বলছে। আমরাও ঘরে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখি, বিদ্যুতের তার টানা রয়েছে। কিন্তু বাল্ব নেই। এ বার বাল্ব পাব কোথায়? কাছেপিঠে কোনও দোকানও নেই। আমাদের কয়েকজন উপরে জওয়ানদের কাছে গেলেন। যদি সেখান থেকে বাড়তি বাল্ব মেলে। কিন্তু বিধি বাম। ওঁদের কাছে কোনও অতিরিক্ত বাল্ব নেই।
এ দিকে কাজ শুরু করা দরকার। সকাল সাতটা থেকে ভোট। আগের রাতে অনেক কাজ গুছিয়ে রাখা দরকার। কিন্তু আলোর অভাবে কাজ শুরুই করতে পারছি না। এ দিকে আর এক সমস্যা শুরু হয়েছে। স্কুলের মিড ডে মিলের রাঁধুনিদের আসার কথা ছিল সন্ধ্যা ছ’টায়। আমাদের খাবারের দায়িত্ব তাঁদেরই। কিন্তু, সাতটা বাজতে চলল, তাঁদের দেখা নেই। আমার সঙ্গে ছিলেন আরও তিন পোলিং অফিসার, এক কনস্টেবল। তাঁরা বললেন, আর একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক। কিন্তু অন্ধকারে বসে থাকতে থাকতে পাগল হওয়ার দশা আমাদের। সারা রাত যদি কাজ শুরু করতে না পারি! ততক্ষণে এলাকায় চাউর হয়ে গিয়েছে, বুথে ‘ডুম’ নেই।
সাতটা নাগাদ ফোন করলাম সেক্টর অফিসারকে। বললাম, আলো নেই। তিনি অভয় দিলেন। অপেক্ষা শুরু হল। সাড়ে সাতটা, আটটা...। প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ সেক্টর অফিসার গাড়ি করে ডুম নিয়ে এলেন। দুটো বাল্ব আনতে কত টাকা খরচ হল, তা জানার উপায় বা দরকার কোনওটাই তখন আমাদের ছিল না। সাত পণ তেল পুড়িয়ে আলো তো জ্বলল। কিন্তু রাতে খাব কী? রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল। এ দিকে রাঁধুনিদের দেখা নেই। আমি কাজে বসলাম। অন্যেরা গেলেন খাবারের খোঁজে। কিছুক্ষণ পরে তাঁরা ফিরলেন। মুখে বিজয়ীর হাসি। স্কুলের কাছেই একটি পরিবার রান্না করে দিতে রাজি হয়েছে। রাত দশটা নাগাদ খাবার এল। ভাত-ডাল-সয়াবিনের তরকারি।
রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পরে ইভিএম পরীক্ষা করতে বসেছি। তখন হন্তদন্ত হয়ে দু’জন মহিলা এসে হাজির। তাঁরাই রাঁধুনি। গরমের সন্ধ্যায় পান্তাভাত খেয়ে তাঁরা নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন! পরের দিন অবশ্য তাঁরা মুরগির ঝোল আর ভাত রান্না করে খাইয়েছেন। কোনও অশান্তি ছাড়াই ভোট মিটল। এ বার দেরি করল বাস। সাড়ে আটটা নাগাদ বাস এল। রানাঘাট পৌঁছলাম রাত দশটা নাগাদ। সব কাজ যখন শেষ হল রাত তখন বারোটা। কল্যাণী স্টেশনে ছেলে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে বাড়ি ফিরতে আর সমস্যা হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy