একই ভাবে মানুষেরও দু’রকম অবস্থান থাকে। ‘১’ বা ‘-১’, এমনটা ভাবা যায়।
ব্যাপারটা আর একটু বিশদে বলা যাক। মনে করা যাক, একটা নির্বাচনে দু’জন প্রার্থী। তপনবাবু যদি প্রথম প্রার্থীকে ভোট দেন তা হলে ওঁর মত ‘১’। আর আকাশবাবু দ্বিতীয় জনকে ভোট দিলে তাঁর মত ‘-১’। কিন্তু এক দিন চায়ের আড্ডায় আকাশবাবু এমন সব যুক্তি দিলেন দ্বিতীয় জনের পক্ষে, তপনবাবু তার প্রভাবে নিজের মতটা দিলেন পাল্টে। তাই তাঁরও মত হয়ে গেল ‘-১’ । অর্থাৎ, ‘-১’ এর সংখ্যা বেড়ে গেল। ফলে, ভোটের গ্রাফও পাল্টে গেল।
কে কী ভাবে অন্যের মতে প্রভাব বিস্তার করবেন, সেটাই হবে মডেলের মূল কারসাজি। গ্যাসের অণু পরমাণু বা চুম্বকের মধ্যে থাকা স্পিনগুলো একটা বিশেষ নিয়ম অনুযায়ী পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত থাকে। ঠিক সেই সমীকরণটাই মানুষের জন্য ব্যবহার করা যায়।
তবে মানুষ তো ঠিক একটা অণু বা স্পিন (যাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি নেই, এমন কোনও বস্তু) নয়। তাই সেই অনুযায়ী মডেলেও কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়। প্রার্থীসংখ্যা বেশি হলে মডেলটাও আর একটু জটিল হবে।
প্রমাণ কোথায়?
বিজ্ঞানের যে কোনও তত্ত্ব প্রমাণ করা হয় গবেষণাগারে পরীক্ষা করে বা পর্যবেক্ষণের সাহায্যে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সব মত বিনিময়ের মডেলের বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায়? সত্যিই কি কেউ জানে, কী ভাবে মানুষের মধ্যে মতের আদানপ্রদান তাঁদের প্রভাবিত করে?
পরীক্ষার দ্বারা বিজ্ঞানের তত্ত্ব যে ভাবে ‘নির্ভুল’ দাবি করা যায়, এ ক্ষেত্রে সে কথা ঠিক খাটে না। তবুও বাস্তবে যা ঘটছে তার সঙ্গে মডেল থেকে যা পাওয়া গেল, তা যদি মিলে যায়, তা হলে সেই তত্ত্বগুলি একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়।
এই প্রসঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথাটা ভাবা যাক। প্রতি নির্বাচনের মত এ বারও বিভিন্ন মডেল ধরে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। তার কোনওটা মিলেছে, কোনওটা মেলেনি। তাই আরও ভাল মডেল বানানোর প্রচেষ্টা চলবেই।
তবে কে নির্বাচিত হবেন এটা ছাড়াও কিছু জটিল প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন, আমেরিকার ‘ইলেকটোরাল কলেজ সিস্টেম’ অনুযায়ী যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পেলেন তিনিই প্রেসিডেন্ট হবেন, এমনটা না-ও হতে পারে। ২০১৬-য় যেমন হিলারি ক্লিন্টন বেশি ভোট পেলেও শেষ হাসিটা হেসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পই।
এই ঘটনা কী ভাবে সম্ভব তার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গ্যাসের আণবিক তত্ত্ব ও চুম্বক-তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে প্রস্তাবিত মডেলগুলি দিয়ে খানিকটা বোঝা গিয়েছে।
দুই প্রার্থীর ভোটপ্রাপ্তির পরিমাণ যখন খুব কাছাকাছি, অর্থাৎ রেষারেষি তুঙ্গে, তখনই এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব। মডেলে তখন ধরতে হবে ওই বাইরের ‘নয়েজ’ খুবই প্রভাবশালী। আবার ধরা যাক ‘ব্রেক্সিট’। এই নিয়ে বহু দিন ধরে অনেক সমীক্ষা হয়েছে। কখনও ব্রেক্সিটের পক্ষে কখনও-বা বিপক্ষে পড়েছে বেশি ভোট। তাতে ফলাফল গিয়েছে উল্টে। কত সময়ের ব্যবধানে এই উল্টে যাওয়ার প্রবণতা আশা করা যায়, সেটাও পদার্থবিদ্যার থেকে ধার করা মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
একটা জিনিস পরিষ্কার, ভাল মডেলের জন্য চাই অনেক অনেক তথ্য বা ‘ডেটা’। তার চুলচেরা বিশ্লেষণ, যা কি না এখনকার দিনে সহজলভ্য। এ জন্যই ‘বিগ ডেটা অ্যানালিসিস’ বলে একটি নতুন বিষয়ও তৈরি হয়েছে। যার জনপ্রিয়তা নানা ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান। এ ছাড়াও ইন্টারনেটের দৌলতে অনেক অনলাইন সামাজিক পরীক্ষাও এই ধরনের গবেষণায় এখন কাজে লাগানো যায়।
মানুষের সামাজিক আচার আচরণ বোঝার জন্য বিজ্ঞানীদের প্রয়াস কিন্তু শুধু মত বিনিময়ের মডেলে থেমে নেই। বরং আর কিছু সামাজিক ক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যার তত্ত্বগুলি কাজে লাগছে দেখা যায়।
সামাজিক বৈষম্যই কি অনিবার্য সত্য?
গ্যাসের অণুর গতিবেগের ক্ষেত্রে ম্যাক্সওয়েলের সূত্র থেকে পাওয়া যায়, খুব কম বা খুব বেশি গতিবেগ, দু’টোরই সম্ভাবনা কম। মানবসমাজে অর্থ ও অন্যান্য সম্পত্তির বণ্টনও যে অনেকটা এমনই হতে পারে, সে কথা গত শতাব্দীর তিনের দশকে লেখা পাঠ্যবইয়েই লেখক মেঘনাদ সাহা এবং বি এন শ্রীবাস্তব উল্লেখ করেছিলেন। তার মানে, খুব গরিব বা খুব বড়লোক, এমন মানুষের সংখ্যা কম।
যদিও আদতে সেটি ঠিক নয়। মানবসমাজে গরিব মানুষের সংখ্যা অবশ্যই বেশি এবং বেশির ভাগ অর্থ বা সম্পত্তি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতেই রয়েছে। এটি ‘পারেতো সূত্র’ নামে সুপরিচিত। মূলত সেই গ্যাসের আণবিক তত্ত্বের সঙ্গে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ করে একটি প্রস্তাবিত মডেল থেকে পারেতো সূত্র পাওয়া সম্ভব। এটা প্রথম দেখিয়েছিলেন কলকাতার তিন পদার্থবিদ। বিকাশ চক্রবর্তী, অর্ণব চ্যাটার্জি এবং শুভ্রাংশু শেখর মান্না।
এই মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা আরও গভীর কিছু প্রশ্নের উত্তর পেতে আগ্রহী।
সত্যিই কি এমন সমাজ গড়ে ওঠা সম্ভব যেখানে অর্থের বণ্টন সমান ভাবে হবে? গরিব, বড়লোকের পার্থক্য সম্পূর্ণ ঘুচে যাবে? নাকি সামাজিক বৈষম্যই একটা অনিবার্য সত্য? এমন বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষিতে মানুষের আচার আচরণ বিষয়ক গবেষণায় আজ গোটা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশের অনেক বিজ্ঞানীও জড়িত। এই সব ধাঁধার জট খুলতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন।
ইতিমধ্যেই ‘সামাজিক ঘটনায় পদার্থবিদ্যার ভূমিকা’ বা এক কথায় যাকে বলা হয় ‘সোশিওফিজিক্স’, সেই বিষয়টা কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে ঢুকে গিয়েছে। আগামী দিনে এর আরও বিকাশ ঘটবে এমনটাই আশা করা যায়।
লেখিকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক।