সবে একটু তন্দ্রা এসেছিল। ভারী গলার হুঙ্কারে তা কেটে গেল— ‘‘অউর আগে বড়েগা তো গোলি চলেগা।’’ আধো-অন্ধকারে দেখলাম, গেটের সামনে থেকে দ্রুত পালিয়ে গেল একটা মোটরবাইক। মুখ ঘুরিয়ে চম্পট দিল একটা গাড়িও।
কুলটি কলেজে শিক্ষাকর্মীর চাকরি করি। এ বারের ভোটে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পেয়ে গিয়েছিলাম দুর্গাপুর পশ্চিম কেন্দ্রের ডিভিসি মোড় লাগোয়া ভগৎ সিংহ শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের বুথে। ডিসিআরসি কেন্দ্র থেকে ভোটের জিনিসপত্র বগলদাবা করে বিকেল ৫টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বুথে। থাকার জায়গা যে রাজপ্রাসাদ হবে না, সে তো জানাই ছিল। কিন্তু দুর্গাপুরের মতো ঝাঁ-চকচকে শহরে এই পরিস্থিতি, ভাবিনি। আলো ঝলমলে রাস্তা থেকে কিছুটা দূরেই এঁদো গলিতে ভোটকেন্দ্র। পাশে কাঁচা নর্দমা। ১০x১৬ বর্গফুটের একটি ঘর। সেখানে পাঁচ জন কর্মীকে নিয়ে রাত কাটানোর বন্দোবস্ত।
সকাল-সকাল বাড়ি থেকে বেরোতে হয়েছিল। তার পরে সারা দিনে বেশ ধকল গিয়েছে। বুথে পৌঁছে বেশ জলতেষ্টা পাচ্ছিল। এই ব্যবস্থাটা আগে করতে হবে মনে করে সেক্টর অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, পানীয় জল কোথা থেকে মিলবে। তিনি যা দেখালেন, চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। শৌচাগারের দেওয়ালের কল দেখিয়ে তিনি জানালেন, খাওয়ার জলও সেখান থেকেই নিতে হবে। অগত্যা বুথ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় দু’শো মিটার দূরে একটি খাবারের দোকান থেকে জলের বোতল কিনে এনে তেষ্টা মেটাতে হল। ওই দোকান থেকে সেই রাত ও পরের দিন দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও করে ফেললাম।
কাগজপত্রের কাজ সারতে বেশ রাত হয়ে গেল। রুটি-তরকারি খেয়ে চটা ওঠা মেঝেতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। তবে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল পিঁপড়ে। তার মধ্যেই এক সময়ে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। তখনই হঠাৎ কানে এল কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের ওই হুঙ্কার। এত রাতে বুথের সামনে গাড়ি-মোটরবাইকের আনাগোনা দেখে আতঙ্ক চেপে বসেছে। তবে অভয় দিলেন জওয়ানেরা। বললেন, ‘‘নিশ্চিন্তে থাকুন, কোনও ভয় নেই।’’
আমাদের নির্বাচন কমিশনের ওয়েব ক্যামেরাম্যান যুবকটি এসেছিলেন বারাসত থেকে। তিনি জানালেন, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে তাঁর মা খুব ভয় পাচ্ছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর এমন দাপট থাকলে কীসের ভয়! বাকি রাত অবশ্য আর ঘুম আর এল না। সকাল ৭টা বাজতেই ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গেল। বুথে মোট ভোটার শ’তিনেক। শুরুতেই ভাল লাইন পড়ল।
সকালে দেখলাম, এক প্রতিবন্ধী ভোটার কষ্ট করে বুথে ঢুকছেন। এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘‘আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’’ উত্তর এল, ‘‘নিজের ভোট নিজে দিতে এসেছি। সাহায্যের কী দরকার!’’ আমারও সব ভয়-ভীতি যেন দূর হয়ে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy