Advertisement
E-Paper

মারলে পুলিশ বাঁচাবে তো

ঘুমের মধ্যে সহিমিনার হাতটা নিজের অজান্তেই কাকে যেন খোঁজে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। ভোটের দিন ডোমকলে হরিডোবা গ্রামে বোমায় নিহত তহিদুল মণ্ডলের মেয়েটাও এত দিনে বুঝে গিয়েছে, তার আব্বা আর কখনও ফিরবে না। ভোটের কথা শুনলেই ভয়ে শিউরে ওঠে সেই মেয়ে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ০২:৫১
কড়া পাহারা স্ট্রং রুমের সামনে। — নিজস্ব চিত্র

কড়া পাহারা স্ট্রং রুমের সামনে। — নিজস্ব চিত্র

ঘুমের মধ্যে সহিমিনার হাতটা নিজের অজান্তেই কাকে যেন খোঁজে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়।

ভোটের দিন ডোমকলে হরিডোবা গ্রামে বোমায় নিহত তহিদুল মণ্ডলের মেয়েটাও এত দিনে বুঝে গিয়েছে, তার আব্বা আর কখনও ফিরবে না। ভোটের কথা শুনলেই ভয়ে শিউরে ওঠে সেই মেয়ে।

ওঠারই কথা। দোকান-বাজার, বাড়ির রোয়াক, পাড়ার মাচা— সর্বত্র ফিসফিস আলোচনা, ফল বেরোলেই ফের গণ্ডগোল শুরু হবে। ভোটের পরেই বিক্ষিপ্ত গোলমাল হয়ে গিয়েছে নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু এলাকায়। সেই তুষের আগুন এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে। ফলে আতঙ্কের প্রহর গুনছে সাধারণ মানুষ।

সোমবার টিভি চ্যানেলগুলি ভোট পরবর্তী সমীক্ষা দেখানোর পরেই বেশ কিছু এলাকায় মারধর-হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এসেছে তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। যদিও পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের আশা, আজ, ফল প্রকাশের পরে কোনও অশান্তি হবে না। তবে উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে বলে আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।

সাধারণ মানুষ অবশ্য তত আশ্বস্ত হতে পারছে না। ভোট মিটে যাওয়ার পরে খড়গ্রামে বোমা বিস্ফোরণ, কৃষ্ণনগরে জোট প্রার্থীর এজেন্টকে এলাকাছাড়া করে দেওয়ার হুমকি, নাকাশিপাড়ায় মহিলাকে মারধর, কল্যাণীতে বিরোধী দলের সমর্থকের বাড়িতে সাদা থান আর বোমা পাঠিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি— অশান্তির অভিজ্ঞতা তো কম নেই।

ভোট মিটতেই হরিণঘাটায় জোট প্রার্থীর এজেন্টের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই জল গড়িয়েছিল বহু দূর। তার জেরে জোটকর্মীদের হাতে মার খেয়েছিলেন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি চঞ্চল দেবনাথ। তার পরে পাল্টা সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়কের বাড়িতে চড়াও হয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী বঙ্কিম ঘোষ-সহ সিপিএম নেতাদের মারধর করা হয়। এর পর থেকে হরিণঘাটা বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় চাপা উত্তেজনা রয়েছে।

মঙ্গলবারই কৃষ্ণনগরের ভালুকায় জোট প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সঞ্জীব শেখকে মারধর করে তৃণমূলের লোকেরা হুমকি দিয়েছে, এলাকা থেকে পাততাড়ি না গুটোলে ১৯ মে-র পরে তাঁকে ঘরছাড়া করা হবে। দিন চারেক আগে ফরাক্কায় আধোয়া গ্রামে কংগ্রেস কর্মী, পার্শ্বশিক্ষক সামসুল হককে মারধর করে তৃণমূলের লোকেরা। ফরাক্কার তৃণমূল প্রার্থী মোস্তফা হোসেন এবং কংগ্রেস প্রার্থী মইনুল হকের বাড়ি এই আধোয়া গ্রামে। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিকেরা পর্যন্ত মনে করছেন, ফল যা-ই হোক, এখানে গোলমাল অবধারিত।

সালারের কান্দরাতে ভোটের সপ্তাহখানেক পরে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া পঞ্চায়েত সদস্য গোলাপি বিবি প্রহৃত হন। অভিযোগ, তাঁকেও ভোটের ফল বেরলে দেখে নেওয়ার আগাম হুমকি দিয়ে
রেখেছে কংগ্রেস। সালার এবং ভরতপুরে তৃণমূলের প্রার্থী ঘোষণার সময় থেকে ব্যাপক গোষ্ঠী কোন্দল চলছে। ভোটের ফল যাই হোক না কেন, এখানে তৃণমূলের বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই বাধার সম্ভাবনা প্রবল। কান্দি ও খড়গ্রামে কংগ্রেস-তৃণমূলের ঠান্ডা লড়াই চলছে। ফল প্রকাশের পর যা প্রকাশ্যে চলে আসার আশঙ্কা রয়েছে। খুন-জখম হতে পারে এই আশঙ্কায় নদিয়ার শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল থেকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ, সব হাসপাতালেই ডাক্তার ও নার্সদের ছুটি বাতিল করে জরুরিকালীন প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

ভোটের দিন তৃণমূলের লোকজন স্বামীর কাছ থেকে ভোটার স্লিপ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করায় স্ত্রী প্রতিবাদ করেছিলেন। তার পর থেকে ওই মহিলা এবং তাঁর পরিবারকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল শাসক দলের লোকজন। মঙ্গলবার তাঁকে মারধর ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে। রাতেই তাঁকে বেথুয়াডহরিতে নাকাশিপাড়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।

ইতিমধ্যেই নদিয়ার হাঁসখালি, বগুলা, রানাঘাট, কল্যাণী, হরিণঘাটা, চাপড়া-সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যদিও তৃণমূল নেতারা তা মানতে নারাজ। নদিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি অসীম সাহা মনে করছেন, তৃণমূল জিতলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার জন্য, হারলে বদলা নিতে বিরোধীদের উপরে হামলা করতে পারে। সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন, তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত। মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের সভাপতি মান্নান হোসেনের অভিযোগ, কংগ্রেসের তরফ থেকে প্ররোচনা রয়েছে।

গোদের উপরে বিষফোঁড়া— আজ, বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশের পরই ফিরে যাবে আধা সেনা। ভোটের সময়ে মেরুদণ্ড ফিরে পাওয়া পুলিশ এ বার কী মূর্তি ধারণ করবে, তা নিয়ে বহু জনেরই প্রশ্ন রয়েছে। তার উপরে, গণনাকেন্দ্রে মোতায়েনের জন্য বেশির ভাগ থানা থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ পুলিশ কর্মী তুলে নেওয়া হয়েছে। দুই জেলাতেই বেশির ভাগ থানায় ওসি, আইসি-সহ দু’জন অফিসার আর দুই থেকে চার জনের বেশি কনস্টেবল ছাড়া কোনও পুলিশকর্মীই থাকছেন না। পুলিশ কর্তারা অবশ্য বলছেন, গণনাকেন্দ্রের আশেপাশেও উত্তেজনা থাকবে। সেই জন্য সেখানে বেশি পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। গণ্ডগোল মোকাবিলার জন্য ‘কুইক রেসপন্স টিম’ থাকছে।

মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের তরফে অবশ্য জানানো হয়েছে, কোথাও গণ্ডগোল ঘটতে দেওয়া হবে না। সর্বদলীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ফল প্রকাশের পরে পাঁচ দিন জেলায় কোনও রকমের সভা-সমিতি করতে পারবে না রাজনৈতিক দলগুলি। যে ডোমকলে ভোটের বলি হয়েছিলেন তহিদুল, সেখানে ফল প্রকাশের পরে আরও কিছু দিন রেখে দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। পুলিশ সেখানে টহল দিচ্ছে। ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী, জেলা তৃণণূল সভাপতির ছেলে তথা যুব তৃণমূল সভাপতি সৌমিক হোসেন বলেন, ‘‘এখানে কোনও গণ্ডগোল হবে না। কারণ, এখানে আমরাই জিতব।’’ কিন্তু, হারলে কী হবে, তার কোনও জবাব দেননি তিনি।

ভোট পরবর্তী সমীক্ষা সত্যি করে তৃণমূল জিতে ফিরলে সর্বত্র সৌমিক হোসেনের মতো ‘দাপুটে’ নেতারা যে হাত গুটিয়ে বসে ‘শান্তির ললিত বাণী’ তা শিশুরাও বুঝতে পারছে। পুলিশ-প্রশাসন তা সুষ্ঠু ভাবে সামাল দিতে পারবে কি না, সেটাই কেউ হলফ করে বলতে পারছেন না।

assembly election 2016 TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy