Advertisement
১০ মে ২০২৪

রিপোর্ট কার্ডে গোল্লা পড়বে না তো?

ধূপগুড়ির অনুকূল বর্মন অপেক্ষায় আছেন, সুবিচার পাবেন এই বিচার ব্যবস্থাতেই, এমন আশা নিয়ে। তাঁর কন্যাকে ছিঁড়ে খেয়েছিল সেই সব ‘হায়েনা’র পাল, যাদের বাইরেটা মানুষের, একইসঙ্গে রাজনৈতিক রঙে শাসক-ঘনিষ্ঠ।

কিন্নর রায়
শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

ধূপগুড়ির সেই নিগৃহীতার বাবা অপেক্ষায় আছেন, সুবিচার পাবেন এই বিচার ব্যবস্থাতেই, এমন আশা নিয়ে। তাঁর কন্যাকে ছিঁড়ে খেয়েছিল সেই সব ‘হায়েনা’র পাল, যাদের বাইরেটা মানুষের, একইসঙ্গে রাজনৈতিক রঙে শাসক-ঘনিষ্ঠ। মেয়েকে রেললাইনের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বাবা। মেয়ে তখন আর মেয়ে নেই। সে তখন রক্ত-মাংসের মৃত স্তূপ। তার অন্তর্বাস আবিষ্কার করেন ক্রন্দনরত পিতা। তখন ঘোর রজনী। সেই মানুষটি তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারেন না, কারণ শাসকদলের চাপ আছে। মাথার উপর সাজানো মামলার হুমকি আছে। তিনি তো শুধু একা ভুক্তভোগী নন মোকদ্দমা-চাপে, তার সঙ্গে তাঁর শ্যালক, তিনিও অভিযুক্ত। ৩ মার্চ ভোরে জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি পৌঁছেছিলাম ২২তম ধূপগুড়ি বইমেলা উদ্বোধন করতে। ৪ মার্চ সকালে সেই মানুষটির বাড়ি। মেয়েকে সেই ‘হায়েনা’রা খেয়ে ফেলার পর তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁর মাথা ন্যাড়া দেখেছিলাম। ঘটনার অনেক অনেক মাস পরে তিনি টাক মাথার দু’পাশে ছোট চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে। যাঁরা আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন ধূপগুড়ি শহর থেকে তাঁর শ্যালকের গ্রামে, তাঁরা বলছিলেন নিগৃহীতার বাবার লড়াইয়ের কথা।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ২৯৪টি আসনে ভোট। খেপে খেপে বেশ কয়েক দফায় ভোট হবে। আর এই ভোট নামের রাজনৈতিক সংগ্রামটিতে ইভিএম-এর বোতাম টিপে জবাব দেওয়ার সময় এসেছে সরকারি ভুয়ো তথ্য ও মিথ্যা ভাষণের। ‘সারদা’-সহ কোটি কোটি টাকার চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, টেট কেলেঙ্কারি, ‘সারদা’, ‘এমপিএস’, ‘রোজ ভ্যালি’ সমেত নানা সংস্থার আর্থিক বিশ্বাসঘাতকতায় প্রায় একশো মানুষের আত্মহনন, সেই সঙ্গে বহুজনের পথে বসা— এ দায় কে নেবেন? রায়গঞ্জ আর মাজদিয়াতে জেল ও বেলের ধাঁধাঁ-কাণ্ড ‘ছোট ছোট’, ‘লড়াকু’, ‘দামালদের’ উৎসাহিত করতে পারে, যারা এখনই হাত পাকাচ্ছে ভবিষ্যতের অনুব্রত মণ্ডল বা মনিরুল ইসলাম, নয়তো আরাবুল ইসলাম হওয়ার জন্য। এটা তাদের ট্রেনিং পিরিয়ড।


কামদুনি মামলার রায় শোনার পর দুই প্রতিবাদী কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, মৌসুমী ও টুম্পা।

এ রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীকে ‘নিও মার্কসিস্ট’ বলে কেউ কেউ ক্ষমতার চেয়ার মুছেছেন। ‘ক্ষমতা’, ‘দখল’, ‘পুনর্দখলের’ যে যে কুর্সিকে যাঁরা ২০১১-র আগে আরাধনা করতেন, তাঁদের কেউ কেউ ছুতো খুঁজছিলেন, ক্ষমতা বদলের পর কী ভাবে ক্ষমতারই চেয়ারের কাছাকাছি থাকা যায়। নিজেদের সমর্থনে এ সব কাজের জোরালো-সগর্জন সাফাইও দিচ্ছেন তাঁরা। বছর দশেক আগের পুরনো টিভি ফুটেজ, নিজের নিজের কথাবার্তার ছবি, কণ্ঠস্বর তাঁরা কি শোনেন, দেখেন? দেখে বিশ্বাস করেন? আর এক জন, যিনি এ রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীকে ‘শাড়ি পরা হিটলার’ বলেছিলেন, তিনি যেন তেন প্রকারেন বিধায়ক হওয়ার জন্য ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে এখন বলতে শুরু করেছেন, ‘নেত্রী যা বলবেন, তাই হবে।’ সেই সঙ্গে ভয় দেখাচ্ছেন ভোটারদের— এমন অভিযোগ জমা পড়েছে মাননীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে, অভিযোগ জমা দিয়েছেন তাঁরই ‘নতুন দল’-এর বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী। তিনি হুমকি দিয়েছেন, ‘মিলিটারি চলে গেলে তখন কী হবে? কে বাঁচাবে তোমাদের! এ সব কথা বলার আগে লজ্জা নামের উচ্চারণটিকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হয় আর তাতে গঙ্গার দূষণ আরও, আরও অনেক বাড়বে নিশ্চয়ই।

পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, গেদে, খরজুনা, মধ্যমগ্রাম, দাঁইহাট— সর্বত্রই নাকি ন্যায়বিচার পেয়েছেন নিহত নির্যাতিতাদের পরিবার। তাই কি? সবটা সত্যি কথা? পার্ক স্ট্রিটের সাহসিনী সুজেট জর্ডান তো তাঁর উপর হামলাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেখেই যেতে পারলেন না। মাটির অনেকটা নীচে কফিনের ঘোর কৃষ্ণ অন্ধকারের মধ্যে শুয়ে শুয়ে অনন্ত ঘুমে সুজেট কি শান্তি পেলেন, স্বস্তি? তা-ও কি জুটল তাঁর? তাঁকে তো কম অপমান করেননি শাসক দলের মাননীয়া সাংসদ। সুজেটের উপর ঘটে যাওয়া আক্রমণ, হিংস্রতা- অতি নিন্দনীয় শাস্তিযোগ্য ঘটনাটিকে তিনি নিছক ‘খরিদ্দারের সঙ্গে ঝামেলা’ বলে লঘু করতে চাইলেন। সমস্ত রাজ্য জুড়েই এখন লঘুকরণ মোচ্ছব। মাটি উৎসব, গোবিন্দভোগ উৎসব, পিঠেপুলি উৎসব— না, মানুষের তো আর কোনও সমস্যা নেই। চারশো বছরের কাজ হয়ে গেছে সাড়ে চার, পৌনে পাঁচ বছরে। এটাও তো বিশ্বরেকর্ড! একটা ‘বিশ্বরেকর্ড সরণি’, নিদেনপক্ষে ‘বিশ্বরেকর্ড ধরণী’ গড়লে কেমন হয়? ‘ধরা যাক দু’-একটা ইঁদুর এ বার’। তাই না? নিজেই নিজেকে মেডেল পরাচ্ছেন, খেতাব দিচ্ছেন শাসক। শাসকদলের সকলের হাতেই একটি করে রিপোর্ট কার্ড। মাননীয়া নেত্রী দিয়েছেন। সেখানে কেউ একশোয় নব্বুই, কেউ একশোয় একশো, কেউ আবার একশোয় একশো দশ। এ রাজ্যের জনগণ সেই সব রিপোর্ট কার্ডে বড় একটা গোল্লা বসিয়ে লাল কালির দাগ না দিয়ে দেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kinnar roy West Bengal Assembly Elections 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE