Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কৃষিসভ্যতার আত্মাকে খুন করতে এসেছিল ন্যানো

আমি সোমালিয়াতে গেলেও এত সাবধানে হাঁটতাম না। সাধারণ এক ভাগচাষি, গায়ে জামা নেই, মাথায় একটা গামছা, ওই গামছাটাই আগুন-রোদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। আমি দাঁড়িয়ে আছি বেড়াবেড়ির একটি উঠোনে, আমার পিছনে সিঙ্গুরের পাঁজর, পরিত্যক্ত ন্যানো কারখানা।

সিঙ্গুর থেকে ফিরে সুবোধ সরকার
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৬ ১২:০৫
Share: Save:

আমি সোমালিয়াতে গেলেও এত সাবধানে হাঁটতাম না।

সাধারণ এক ভাগচাষি, গায়ে জামা নেই, মাথায় একটা গামছা, ওই গামছাটাই আগুন-রোদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। আমি দাঁড়িয়ে আছি বেড়াবেড়ির একটি উঠোনে, আমার পিছনে সিঙ্গুরের পাঁজর, পরিত্যক্ত ন্যানো কারখানা। ওই ভাগচাষি আমাকে একটা নতুন সত্য জানাল, ‘আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, আপনার পিছনে একটা নয়, দুটো শ্মশান।’ আমি বিস্মিত হয়ে পিছনে তাকালাম। পাঁচিল চলে গিয়েছে বরাবর, ছ’শো প্লাস চারশো একর, অর্থাৎ, এক হাজার একর জুড়ে পাঁচিল। তার ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে ভুবনবিখ্যাত সেই শ্মশান। আমি বললাম, ‘দু’টো কেন? শ্মশান তো একটাই।’ ভাগচাষিটি কান এঁটো করা একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘ওই যে আর একটা শ্মশান, ওটা পাশেই, কলাঝোপের পেছনে, ওই যে, ওটার নাম তালতলা শ্মশান, যুগ যুগ ধরে আছে।’

আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার দশ পা দূরে দাঁড়িয়ে ইতিহাস। এই সেই কারখানা যা ৩৪ বছরের বাম জমানার শেষ ওয়াটারলু। ওয়াটারলু তখন ছিল নেদারল্যান্ডসে, এখন সেটা বেলজিয়ামে। সিঙ্গুর তখন ছিল আলিমুদ্দিনে, এখন কালীঘাটে।

ভাগচাষির নাম নারান, মানুষটাকে খুব মন দিয়ে লক্ষ করছিলাম। রোগা চেহারা, মুখে না কামানো দাড়ি। কেমন যেন মায়া হয়। আমি বললাম, তুমি এখনও চাষ কর? সে এক গাল হাসি দিয়ে বলল, ‘চাষ না করলে খাব কী?’ ‘তোমার বাড়িতে কে কে আছে?’ ‘আমর দুই জন ছেলে, ছেলের বউ।’ আমি মনে মনে বললাম, একেবারে আদর্শ সংসার। ‘ছেলে কি তোমার সঙ্গেই থাকে না আলাদা?’ সে আবার এক গাল হাসি দিয়ে বলল, ‘আলাদা থাকবে? ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব না?’ আমি বললাম, ‘কেন এ ভাবে বলছ? আলাদা থাকলে তোমারও তো উপকার হতে পারে, ছেলেরও স্বাধীনতা থাকে।’ নারান আমাকে খুব একটা পাত্তা দিল না। বলল, ‘ও সব এখানে হবে না।’

আমি চারপাশে তাকালাম। সুফসলী মাঠ। বছরে তিন বার ফসল ওঠে। যখন যে রকম। দেখলাম চারপাশে বেগুন, পটল একেবারে দুই সহোদরার মতো এ ওকে জড়িয়ে ধরে আছে সারা মাঠ জুড়ে। এ যেন মাঠ নয়, জীবনানন্দ দাশের কবিতা। যেন এখানেও একদিন ধানসিড়ি নদী ছিল। সেই নদী মারা গিয়েছে। কিন্তু এত ফসল চারপাশে, এত সবুজ, এত প্রাণ, সত্যি যেন মাঠ নয়, কৃষিসভ্যতার আত্মা। সেই আত্মাকে খুন করতে এসেছিল এক গাড়ি, যার নাম ন্যানো। খুন করতে পারেনি।

নারান বলল, একটা সাড়ে চার বছরের মেয়েকে ওরা সইতে পারছে না, এত হিংসে। আমি কিছুটা আনমনা ছিলাম, বুঝতে পারিনি কথাটা। আমি বললাম, ‘নারান, কী বললে সাড়ে চার বছরের মেয়েটা, মানে?’ ‘এত সোজা কথা বুঝতে পারেন না, এই হল শহুরে বাবুদের দোষ। সোজা কথা বোঝেন না, কঠিন কথা বোঝেন। সাড়ে চার বছরের মেয়েটা মানে মমতা। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। কৃষাণ মাণ্ডি হয়েছে গো। ওটা বিরাট ভরসা। যখন ফসলের দাম পাব না, বড় রাস্তা পেরিয়ে মাণ্ডিতে যাব। ন্যানো হলে কী হত জানি না বাপু, কিন্তু কৃষাণ মাণ্ডি হয়ে আমাদের সংসারটা বেঁচে গিয়েছে।’

সারা সকাল, সারা মধ্যাহ্ন জুড়ে ঘুরে বেড়ালাম চায়ের দোকানে, পুকুরপারে, গাছতলায়, ক্ষেতে-খামারে। অনেকের সঙ্গে দেখা হল, যাঁরা অনিচ্ছুক নামে এখন বিখ্যাত। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও দেখা পেলাম না ইচ্ছুক চাষিদের। নারান বলল, ‘দিদি আমাদের জমি ফেরত দেবেন।’ আমি বললাম, ‘জমি তো এখন আদালতে ঢুকে পড়েছে। তা কি আর কারও হাতে আছে?’ নারান জানে সে কথা। কিন্তু সে জানাল, সে ভালবাসে দিদিকে আর দিদিও ভালবাসে তাঁকে। আমি অবাক হয়ে তাকালাম মানুষটার মুখের দিকে। কী ছেলেমানুষ, কী জেদি, কী বিশ্বাসী এক জন চাষি! সে তাকিয়ে আছে, ওয়াটারলুর দিকে। কিন্তু সে আসলে চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত, সে ফিরে পাবে তার জমি।

প্রথম চায়ের দোকানে আমি পেলাম কয়েক জন যুবককে। তাঁরা বললেন, তাঁদের কাজ চাই। একশো দিনের কাজ সব সময় হাতে আসে না। দ্বিতীয় চায়ের দোকানে সবাই মুড়ি-ঘুঘনি খাচ্ছিল, খুব ভাল খাবার, মুখে জল এনে দেয়। আমিও খেলাম। আমরা খেলাম। আমি দোকানিকে বললাম, ‘তুমি কি আগের থেকে ভাল আছো? দোকানি বলল, ‘আমি আগে এই দোকান থেকে যা পেতাম, এখনও তাই-ই পাই। কিন্তু আমার মেয়ে কন্যাশ্রী পেয়েছে, সে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল। আবার স্কুলে যাচ্ছে। সে বলেছে সে বড় হয়ে বিয়ে করবে।’

এই বার আমি তাঁকে এক জন বাবা হিসাবে বললাম, ‘শোনো কলকাতার কাগজে পড়লাম, তোমরা নাকি কন্যাশ্রীর টাকাটা পণ হিসাবে কাজে লাগাচ্ছ?’ বলল, ‘দেখুন এটা তো অসুখ, এ কি আর এক দিনে যাবে? আমিও তো বাবা। আমি চাইব আমার মেয়েটা পড়ুক। পড়ে একটা কাজ পাক।’

সারা সিঙ্গুর জুড়ে কিন্তু জোটের দেয়াল লিখন প্রায় চোখেই পড়ল না। কে বলবে এখানেও জোট হয়েছে? হয়েছে তো বটেই, কিন্তু কোথায় তার পোস্টার? কোথায় তার দেওয়াল লিখন? চোখেই পড়ল না। বেড়াবেড়ির গৃহবধূকে যখন রাস্তায় রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ন্যানো হলে আপনার কি হত?’ একেবারে দার্শনিকের মতো তাঁর উত্তর-‘আমার বাড়িটা ওরা কেড়ে নিত, কেড়ে নিয়ে গুদাম বানাত। আমি সেই গুদামের বাইরে তুলসী গাছের মাথায় জল ঢালতাম।’

কলকাতায় ফিরে আসার মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম একেবারে সেই গেটের সামনে যার ভিতরে দুটো শ্মশান। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে মনে হল, এত জায়গা থাকতে, বাংলায় এত জমি থাকতে কেন সে দিন এই সুফসলী ওয়াটারলুকে ওঁরা বেছে নিয়েছিলেন? জং ধরা গেটটার সামনে দাঁড়িয়ে আমি গেটটাকেই বললাম, ‘হেথায় তোরে মানাইছে না গো।’

ফেরার পথে আমার শুধু নারানের কথাটাই কানে বাজতে থাকে, ‘তালতলার শ্মশানে মা আছে।’ আমি বলেছিলাম, ‘তাতে কী হয়েছে?’

নারান বলেছিল, ‘ওই মা আমাদের বাঁচিয়েছে।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Singur Nano Subodh Sarkar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE