Advertisement
০২ মে ২০২৪

বাহিনী কান ধরে উঠবোস করাইতিছে, থ শেখ সুফিয়ান

বৃহস্পতিবার বারবেলা। তারাচাঁদবাড়ের মোহন জানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথের কাছেই চেয়ার পেতে জাহাজ-ভিলার মালিক শেখ সুফিয়ান সদলবলে বুথ পাহারায়। গজরাচ্ছেন মাঝে মাঝেই। ‘‘ভোট তো করছে মিডিয়া আর সিআরপি। কেউ ছাড় পাবেনি। সব বুঝে লিব।’’

এ ভাবেই কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল বাহিনী। দেখাচ্ছেন ‘দাদার এজেন্ট’ শেখ শামিম মহম্মদ। ছবি: সুমন বল্লভ।

এ ভাবেই কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল বাহিনী। দেখাচ্ছেন ‘দাদার এজেন্ট’ শেখ শামিম মহম্মদ। ছবি: সুমন বল্লভ।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
নন্দীগ্রাম শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৬ ০৩:৫১
Share: Save:

বৃহস্পতিবার বারবেলা। তারাচাঁদবাড়ের মোহন জানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথের কাছেই চেয়ার পেতে জাহাজ-ভিলার মালিক শেখ সুফিয়ান সদলবলে বুথ পাহারায়। গজরাচ্ছেন মাঝে মাঝেই। ‘‘ভোট তো করছে মিডিয়া আর সিআরপি। কেউ ছাড় পাবেনি। সব বুঝে লিব।’’

হঠাৎই একটা ফোনে সুফিয়ান সাহেবের চোখ কপালে! গলা চড়ল, ‘‘কী, কান ধরে উঠবোস করাইতিছে? শামিম আর সাবিরকে ধরে লিয়েছে? মারতিছে? তুলে লিয়ে যাইছে?’’ ফোন নামিয়ে তাকালেন তিনি। প্রশ্ন করার আগেই বেরিয়ে এল উত্তর, ‘‘ভাবতে পারেন! মহম্মদপুরে সিআরপি আমাদের ছেলেদের বুথে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। লাঠি মেরেছে। এ সব মেনে নেওয়া যায়?’’

মেনে যে নেওয়া যায় না, তা কিছুক্ষণ আগে সুফিয়ান নিজে বুথেই টের পেয়েছেন। দাদা ভোট দিতে এসেছেন জেনে বেশ কয়েকজন বুথে হাজির। তাঁরা নাকি বয়স্কদের ‘হ্যাল্প’ করতে চান। কিন্তু বুথের মুখে এক জওয়ান তাঁর একে সিরিজে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘‘গরমি জাদা হো গ্যয়া। অউর জাদা গরম করনে কে লিয়ে মজবুর না করো। ইঁহাসে ভাগ যাও। নেহি তো...।’’

ও দিকে মহম্মদপুরে তো জেরবার অবস্থা! সেখানে পৌঁছে ৫৮ নম্বর বুথে দেখা গেল বেশ কয়েকজন গোর্খা জওয়ান টান টান। আচ্ছা এখানেই কি শামিম আর সাবিরকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সিআরপি? জানতে চাওয়া মাত্র ‘কোন চ্যানেল, কোন চ্যানেল’ বলে পিলপিল করে লোক জমে গেল। বলাই বাহুল্য, সবাই দাদার ভোটার। এলেন শেখ শামিম মহম্মদ এবং শেখ সাবির মহম্মদ। এবং বললেন, ‘‘আমাদেরই কান ধরে প্রথমে বুথের মধ্যে, তারপর রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। আমরা দাদার এজেন্ট। তাও কমান্ডোরা এসে মারল।’’ শুধু বললেনই না, শামিম তো কী ভাবে কান ধরে দাঁড়িয়েছিলেন তাও দেখিয়ে দিলেন। সাবির আবার জানতে চাইলেন, ‘‘রোদে দাঁড়িয়ে দেখাব?’’

বোঝা গেল, শুভেন্দু অধিকারীর খাসতালুকে লড়াই আসলে ভূত বনাম কেন্দ্রীয় বাহিনীর। আর বুথে বুথে ভূত তাড়ানোর জন্য
দিল্লির দাওয়াইটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল নন্দীগ্রামের নায়কের। কারণ, ভূমি আন্দোলনের ময়দান থেকে জেতাটা তাঁর কাছে বড় কথা নয়। জোট-নেতারাও তা বিলক্ষণ জানেন। তাই তো সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি বলেন,‘‘১৫৭ বুথে ভয়ে
এজেন্ট বসেনি। কিন্তু মানুষ নিজের ভোট নিজে দিয়েছে। ফলে চমক থাকবে ফলাফলে।’’

সেই চমক নিয়েই ধন্দে নন্দীগ্রাম। দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে শুভেন্দু নন্দীগ্রাম থেকে প্রায় ৭০ হাজার ভোটের ‘লিড’ পেয়েছিলেন। এ বার সেই ‘লিড’ ছাপিয়ে যাওয়ার পালা। যদি না পারেন, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর দলের দ্বিতীয় জননেতার জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে। সারদা থেকে নারদ— শুভেন্দুর নেতৃত্বে কোনও প্রভাব ফেলল কি না, তা বোঝা যাবে। যদিও তমলুকের এমপি’র দিদি সুদূর উত্তরবঙ্গে বসে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, অন্তত ১ লক্ষ ভোটে জিতবেন শুভেন্দু।

জেতা নিয়ে নিঃসংশয় হয়েও তাই দিনভর বুথে বুথে চক্কর কাটলেন নন্দীগ্রামে দিদির দূত। খুঁজে পাওয়া গেল না সিপিআই প্রার্থী কবীর শেখকে। যেখানে সিপিআই প্রার্থীর এজেন্ট নেই, সেখানে লক্ষ্মণ শেঠের ভারত নির্মাণ পার্টির এজেন্টে ছেয়ে ছিল নন্দীগ্রামের বুথ। আর তাঁদের সঙ্গে তৃণমূলী এজেন্টদের সে কী ভাব! একই সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া। কে জানে কোন জাদুতে শুভেন্দু-লক্ষ্মণের এজেন্টদের এত গলাগলি! ভোটের নন্দীগ্রাম এ-ও দেখল।

২০১১-র বিধানসভার পর পঞ্চায়েত ভোটে এখানে অধিকাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়েছিল তৃণমূল। ২০১৪-এর লোকসভায় নন্দীগ্রামের সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল না। তবে ভূত ছিল, এমনই অভিযোগ। তাতেও এসেছিল ৭০ হাজারের ‘লিড’। এ বার সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী, ভূতেদের ঘন ঘন তাড়া (কান ধরে ওঠবোস পর্যন্ত) এবং ভোট দিতে হাজরাকাটা থেকে ভেকুটিয়া, গড়চক্রবেড়িয়া থেকে সোনাচূড়ার লম্বা লাইন। নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, বিকেল ৬টা পর্যন্ত নন্দীগ্রামে প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে। কী হবে কেউ জানে না।

নন্দীগ্রামে আর মোরাম রাস্তা নেই। সব পাকা হয়েছে। এমনকী গ্রামের ভেতরের রাস্তাও কংক্রিট। কোথাও ত্রিফলা, কোথাও হাইমাস্ট। শহিদ পরিবারের অনেকেরই চাকরি হয়েছে। কৃষক বাজার হয়েছে।

তবুও ভাঙাবেড়িয়া সেতুর ঠিক যে জায়গা থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ গুলি চালিয়েছিল, সেখানে দেওয়ালে সাঁটা বি়জ্ঞাপন আরব দেশে ‘লেবার’ চাইছে। কাজ নেই নন্দীগ্রামে। ভরত মণ্ডল আর শেখ সেলিমদের মৃত্যু এখনও নাড়িয়ে দেয় নন্দীগ্রামকে। কিন্তু তারপরেও পেটের তাগিদে নাগপুরে দর্জির কাজ করতে ছোটেন গড়চক্রবেড়িয়ার শেখ মহসিন। জেদের ভোট দিতে তিনিও এসেছেন দেশে। তাঁর কথায়, ‘‘রাস্তা-আলো হয়েছে ভাল কথা। কিন্তু নন্দীগ্রামের ছেলেদের কাজ নেই। পড়া শেষ করে যাবে কোথায় তারা। বেশি কাজ মানে তো নেতাদের বেশি পকেট ভর্তির ব্যবস্থা।’’

ঝানু নেতা শুভেন্দু এ কথা ভালই জানেন। স্থানীয় নেতাদের কৃতকর্মের খেসারত এ বার তাঁর ব্যবধানে না প্রভাব ফেলে। তাই দিনভর চরকি সফরে শুভেন্দুর সঙ্গে আবু তাহের। নেই শেখ সুফিয়ান। বাড়ি আর নিজের বুথে ছাড়া তাঁকে খুব একটা সক্রিয় মনে হল না।

এ কথা তুলতেই সুফিয়ানের জবাব, ‘‘কী যে বলেন, আমাকেও যেতে বলেছিলেন শুভেন্দুবাবু। বললাম, হবে না। ভোটটা করাতে হবে।’’

ভোটটা যে কে কোথায় করাল, বলবে ১৯ মে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE