মোদীর ভোট দিদির ঘরে!
আর তারই ঝড়ে উড়ে গেল জোটের জোর। ভোট পরবর্তী মূল্যায়নে নেমে হারের নেপথ্যে এমন বিশ্লেষণকেই খাড়া করছেন বীরভূমের বাম ও কংগ্রেস নেতারা। লোকসভা ভোটে জেলায় ১৮ শতাংশেরও বেশি ভোট বিজেপি পেয়েছিল। তার অনেকটাই এ বার জোটের ঘরে তোলার আশায় ছিলেন জোটের নেতারা। কিন্তু তাঁদের সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছেন দিদি। ভোটের ফল প্রকাশের পরে দেখা যাচ্ছে, ওই ১৮ শতাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটেই তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছে। উল্টে, গেরুয়া শিবিরে তেমন কোনও ফাটলই ধরাতে পারেনি জোট। দিনের শেষে নিট ফল দাঁড়িয়েছে, গত বিধানসভার থেকেও ৭.০৯ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে নিয়ে একাই ১১টির মধ্যে ৯টি আসনই দখল করে নিয়েছে তৃণমূল।
ঘটনা হল, ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে জোট করে এই জেলা থেকে ৪৭.০৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তৃণমূল ও কংগ্রেস। ৯টি আসনে লড়ে তৃণমূল পেয়েছিল ৬টি আসন, দু’টিতে লড়ে কংগ্রেস ২টি। প্রবল মমতা-ঝড়েও বীরভূমে তিনটি আসন ধরে রাখতে পেরেছিল বামেরা। পরে উপনির্বাচনে বামেদের ঘরে আসে নলহাটিও। সে বার ভোট শতাংশের দিক থেকে বামেরা ৪২.২৭ এবং ৬.৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। তিন বছরের মাথায় লোকসভা ভোটে অব্যাহত থাকে বামেদের রক্তক্ষরণ। প্রায় ১২ শতাংশ ভোট কমে বামেরা পৌঁছয় ৩০ শতাংশে। তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভেঙেও প্রায় এক শতাংশ ভোট হারিয়ে কংগ্রেস মোটের উপর নিজের ভোট ধরে রাখে। একক ভাবে ৩৮.৮৬ শতাংশ থেকে তৃণমূল পৌঁছয় ৪১.৫৪ শতাংশে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বীরভূমের ইতিহাসে এই প্রথম প্রায় তিন গুণ ভোট বাড়িয়ে বিজেপি দখল করে ১৮.২৯ শতাংশ ভোট।
এই ১৮ শতাংশ ভোটের দিকেই এ বার নজর ছিল সবার। মোটের উপর ধরাই হয়েছিল, লোকসভার ভোটের এই হার কোনও ভাবেই ধরে রাখতে পারবে না বিজেপি। বিধানসভা ভোটে কারা বেশি করে সেই ভোটে ভাগ বসাতে পারবে, তার উপর অনেকটাই নির্ভর করছিল বাকি দলগুলির ভাগ্য। ভোটের ফল প্রকাশের পরে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি-র সেই ভোট-ব্যাঙ্কে সব থেকে বেশি থাবা বসিয়েছে তৃণমূলই। দিদির দল গত লোকসভার থেকে যে ৭.০৯ শতাংশ বেশি ভোট ঘরে তুলেছে, তার মধ্যে ৭.০২ শতাংশই এসেছে সরাসরি বিজেপি-র ঘর থেকে। কারণ, গত লোকসভার (৩৭.৭৬ শতাংশ) তুলনায় এ বারের বিধানসভায় জোটের ভোট (৩৭.৮১ শতাংশ) মোটের উপর একই রয়েছে। অর্থাৎ লোকসভা ভোটে যে সব মানুষ নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আস্থা দেখিয়েছিলেন, তাঁরাই এ বার দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন দিদিকে! আর এই ‘উলটপুরাণ’ই সব ছক উল্টে দিয়েছে জোটের নেতাদের।
কেন উলটপুরাণ?
বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরছেন জোটের নেতারা। প্রথমত, কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য হলেও লোকসভায় যাঁরা বিজেপি-র প্রতি আস্থা রেখেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই আদতে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের কাজে ক্ষুব্ধ হয়েই ওই ভোট দিয়েছিলেন। জেলা সিপিএমের এক নেতার কথায়, ‘‘তাই ধরা হয়েছিল, বিধানসভা ভোটেও তৃণমূল-বিরোধী সেই ভোট জোটের ঘরে ঢুকবে।’’ দ্বিতীয়ত, লোকসভা ভোটের সেই মোদী হওয়া আর ছিল না। সব মিলিয়ে ওই ১৮ শতাংশ ভোটের একটা বড় অংশ কাছে টানতে পারলেই শাসকদলের যাবতীয় হিসেব গুলিয়ে যাবে বলে ভেবেছিলেন জোটের নেতারা। কিন্তু, বাস্তবে জোটের এই অঙ্ক খাটেনি। বরং ঘটেছে উল্টোটাই। আর তারই সূত্রে এক ধাক্কায় গত লোকসভাতেও মাত্র আড়াই শতাংশ ভোট বাড়ানো তৃণমূল এ বারে পৌঁছে গিয়েছে ৪৮.৬৩ শতাংশে।
উদারহণ হিসেবে সাঁইথিয়ার কথা উঠছে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বামেদের দখলে থাকা এই কেন্দ্রে সিপিএম জয়ী হয়েছিল ২০১১ সালেও। গত লোকসভার ফলের নিরিখে এই কেন্দ্রে বাম ও কংগ্রেসের থেকেও ২৬ হাজার ভোটে এগিয়েছিল তৃণমূল। বিজেপি পায় ৪০,৭৭২টি ভোট। এ বার গত লোকসভার নিরিখে শাসকদল ১৯,৩৬৮ এবং জোট (সিপিএম) ৭,২১৭ ভোট বেশি পেয়েছে। অন্য দিকে, বিজেপি ১৬,৪৪৩টি ভোট কম পেয়েছে। অর্থাৎ বিজেপি যে ভোট হারিয়েছে, তার পুরোটাই শাসকদলের ঘরে ঢুকেছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা।
বস্তুত, অঙ্ক না মেলার যুক্তি খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত বাম-কংগ্রেস নেতারাও। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সিউড়ির পরাজিত প্রার্থী রামচন্দ্র ডোমের জবাব, ‘‘শুধু এই জেলাই নয়, গোটা রাজ্যেই এমনটা ঘটেছে। যে অঙ্ক ভাবা হয়েছিল, তা মেলেনি। তবে লোকসভার প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ভোট কী করে দু’বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠানেই ঢুকে গেল, তার কারণ এখনই বলা সম্ভব নয়। এ নিয়ে দলের অন্দরে পর্যালোচনা শুরু হয়েছে।’’ সিপিএমের নেতারা বিশদ ব্যাখ্যায় না গেলেও পাল্টা যুক্তি খাড়া করেছেন কংগ্রেসের জেলা সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মি। তাঁর বরং দাবি, ‘‘উন্নয়নের মিথ্যা প্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছেন। তৃণমূলের ঘৃণ্য রাজনীতি ও অপকীর্তি সম্পর্কে মানুষকে বোঝানোর ক্ষেত্রে আরও সজাগ হতে হবে।’’
বিরোধীদের যাবতীয় যুক্তিকে খারিজ করেছে তৃণমূল শিবির। জেলায় সব থেকে বড় ব্যবধানে জেতা চন্দ্রনাথ সিংহের বরং দাবি, বিজেপি-র লোকসভায় পাওয়া ভোটের বড় অংশ তৃণমূলের ঘরে ঢুকেছে— সব ক্ষেত্রে তেমনটাও ঘটেনি। আর যেটুকুই ঘটেছে, তা-ও শুধুমাত্র উন্নয়নের কারণেই হয়েছে বলে বোলপুরের পুনর্নিবাচিত এই তৃণমূল বিধায়কের দাবি। তাঁর কথায়, ‘‘লোকসভা ভোট ছিল কেন্দ্রে সরকার গঠনের ভোট। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে হারাতে অনেকেই বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু বিধানসভার ক্ষেত্রে বাকিদের মতো সেই মানুষগুলিও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে দিদির প্রতিই আস্থা রেখেছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy