Advertisement
০২ মে ২০২৪

বেগুনি ভাজা বা বেড়ালের সঙ্গে খুনসুটি, এক ভিন্ন ভোটের গপ্পো

বাজারের মধ্যেই একটি ক্লাব। ক্লাবের সামনে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে মস্ত বড় সাপ! না আসল নয়। নাগরাজের মূর্তি! উল্টো দিকে, মিষ্টির দোকানে গরম রসগোল্লা কিনতে ভিড়। পিঠোপিঠি স্টেশনারি দোকান, গালা মাল বিক্রেতা। খদ্দের সবই চেনাজানা। কে, কখন, কী কিনতে আসতে পারে তা-ও দোকানির জানা। বাজারের বাঁ দিকে গলি চলে গিয়েছে থানার দিকে। সেখানে ছোট্ট পাইস হোটেলের কাউন্টারে গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছে বুড়ো বেড়াল।

কুমারগ্রামে রায়়ডাক নদীর সৌন্দর্যই অনেকটাই অনাবিষ্কৃত। ছবি: শম্ভু গুপ্ত।

কুমারগ্রামে রায়়ডাক নদীর সৌন্দর্যই অনেকটাই অনাবিষ্কৃত। ছবি: শম্ভু গুপ্ত।

কিশোর সাহা
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ১১:৪৪
Share: Save:

বাজারের মধ্যেই একটি ক্লাব। ক্লাবের সামনে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে মস্ত বড় সাপ! না আসল নয়। নাগরাজের মূর্তি! উল্টো দিকে, মিষ্টির দোকানে গরম রসগোল্লা কিনতে ভিড়। পিঠোপিঠি স্টেশনারি দোকান, গালা মাল বিক্রেতা। খদ্দের সবই চেনাজানা। কে, কখন, কী কিনতে আসতে পারে তা-ও দোকানির জানা। বাজারের বাঁ দিকে গলি চলে গিয়েছে থানার দিকে। সেখানে ছোট্ট পাইস হোটেলের কাউন্টারে গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছে বুড়ো বেড়াল। মাঝেমধ্যে তাঁকে সস্নেহে খুঁচিয়ে খুনসুটি করছেন দোকান মালিক। বাজারে টিভির দোকানও আছে। টিভিও চলছে। তাতে কোথাও কার্টুন চ্যানেল! কোথাও অ্যানিমাল প্ল্যানেট। কোথাও কারও ভোট নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার দেখা মেলাই ভার। সকলেরই ভাবসাব এমন যেন, ভোট নিয়ে অযথা ভেবে কী হবে, সব কিছুই তো পূর্বনির্দিষ্ট হয়ে আছে।

জায়গার নাম কুমারগ্রাম বাজার।

ডুয়ার্সের দিকে এটাই ভারতের শেষ বড় জনপদ।

যার গা ছুঁয়ে এক দিকে বইছে সঙ্কোশ। আর এক দিকে রায়ডাক। ১৪-২০ কিলোমিটার গেলেই ভুটান। ভোট ঘোষণার দিন ভরসন্ধ্যায় পৌঁছে গিয়েছিলাম সেখানে। কারণ, ভোটের ঘোষণা, প্রার্থী তালিকা, বিরোধী জোট নিয়ে বড় শহরে তো নানা কাণ্ড ঘটে। কলকাতা, শিলিগুড়ি কিংবা দুর্গাপুরে তো হইহই ব্যাপার! রইরই কাণ্ড যত চ্যানেলে! তাই কৌতূহল ছিল এক্কেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় কী প্রতিক্রিয়া হয়। জীবনযাপনের মধ্যে কি কোনও উদ্দীপনা আনে ভোটের ঘোষণা! কিংবা জোটের ঘোষণা! অথবা প্রার্থী তালিকা!

সন্ধ্যার মুখে আলিপুরদুয়ারের অদূরে সলসলাবাড়ি পেরোতেই চার লেনের মহাসড়কে ওঠা গেল। ২০১৪ সাল থেকে ওই এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হয়ে হয়েছে। মহাসড়কের সুবাদেই বদলে গিয়েছে দু’ধারের গ্রামের চেহারা। জমজমাট ব্যাপারস্যাপার। দূর থেকে রাস্তার ধারে সারি সারি আলোর মালা দেখলে কখনও মনে হয় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাচ্ছি। টোল গেটের অদূরে বাজারে তেলেভাজার কয়েকটি দোকান।

খানিকক্ষণের বিরতির সময়ে বেগুনি বিক্রেতা সুচিত্রা বর্মনের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হল। ভোটের দিন ঘোষণার কথা বলা গেল। এপ্রিল-মে মাস জুড়ে ভোট হবে। কুমারগ্রামেও ১৭ এপ্রিল ভোট। নিবিষ্ট মনে সব শোনার পরে শালপাতায় বেগুনি দিয়ে বিট নুন, চাট মশলা ছিটিয়ে প্রৌঢ়া বললেন, ‘‘গেল বছরের আগের বছর না একটা ভোট দিলাম। আর একটা ভোট কি এসেই গেল! এইটা কীসের ভোট?’’ জবাব শোনার পরে বললেন, ‘‘আর একটা দেব নাকি! চাইলে ধনেপাতার বড়াও ভেজে দিতে পারি।’’

না, মাসি, এদিকে ভোট নিয়ে মাতামাতি হয় না? আস্তে করে জানতে চাইলাম।

হয় তো। তবে তা নিয়ে ভাবব কখন! সেই ভোরে উঠে বেগুন, কুমড়ো, ধনেপাতা জোগাড় করতে ছুটি। কোনও দিন মোচা আনতে যাই হোথায় চুনিয়াঝোরার দিকে। সব জোগাড়ের পরে বাড়ি ফিরে চার বিঘার খেতের দেখাশোনা করি। রান্নাবান্না করে পুকুরে স্নান করে খেতেই বেলা গড়িয়ে যায়। বিকেল হতেই কুমড়ো, বেগুন ফালি করি। বেসন মাখি। উনুন ভ্যানে চাপিয়ে তা ধরাতেই সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। রাতে বাড়ি ফিরে স্বামী-স্ত্রী মিলে হিসেব করে খেতে ১২টা বেজে যায়।

তা হলে ভোটের মিটিং-মিছিলে যাও না!


কুমারগ্রাম ডাকবাংলোয় ঝোলানো রয়েছে চুনিয়াঝোরার এই ছবিই। ছবি: কিশোর সাহা।

বড় মিটিং হলে যাই তো। সেখানে দোকান বসানোর ব্যবস্থা করে দেন নেতারা।

সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু, পছন্দ-অপছন্দ বলে তো একটা ব্যাপার আছে। কোন দলকে পছন্দ?

আর পছন্দ-অপছন্দ। সে সব কথা থাক। দোকানে ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। সামাল দিতে হবে। সামনের বৈশাখে বড় মেয়েটার বিয়ে। অসমের শ্রীরামপুরে ছেলের বাবার বড় পাইস হোটেল আছে।

আচ্ছা। এ বার কুমারগ্রামে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন এক জন বড় পুলিশ অফিসার। শুনেছেন?

তৃণমূল মানে মমতা তো! ওঁকে ভাল্লাগে। কিন্তু, ওই দলের অনেকে যেন কেমন। পোষায় না।

মানে!

আর কথা বলতে পারছি না। অনেক খরিদ্দার। এটা বলে দিতে পারি, হুটহাট সব কিছু পাল্টানোর অভ্যাস আমাদের গেরামের বেশি লোকজনের নাই।

কথা না বাড়িয়ে রওনা হয়েছিলাম। শামুকতলা রোড হয়ে বারবিশা। সেখান থেকে কুমারগ্রাম। রাত ৮টাতেই সুনসান বাজারর। থানার পাশের ডাকবাংলোয় বসে ঝিঁ ঝিঁ-র আওয়াজ শুনি। পাশেই একটা পাইস হোটেলে দেখি দোকান মালিক ইয়া মোটা একটা বেড়ালের সঙ্গে খুনসুটি করে চলেছেন। লোকজন মেলা বার। তাঁর সঙ্গেই কিছুক্ষণ কথা হোক। যত ভোটের কথা বলি। ততই উনি বেড়ালের গল্প করে চলেন।

ব্যাপারটা এ রকম।

ভোট তো এসে গেল।

বেড়ালটা দেখেছেন! এটার বয়স কিন্তু ১৪ বছর। খুব ন্যাওটা আমার। হোটেলে থাকে। কোনও দিন চুরি করে কিছু খায়নি। না খেয়ে থাকবে তবু এঁটোকাটায় মুখ দেবে না।

এখানে তো এ বার জলপাইগুড়ির এএসপি তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন।

বেড়ালটা ভীষণ ভদ্র মশাই। এমন বেড়াল মেলা ভার!

বলছিলাম, ভোট নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।

বেড়ালটা সুন্দর খেলাও দেখাতে পারে।

অগত্যা রণে ভঙ্গ দিয়ে থানার দিকে এগোতে হল। রাত ১০টাতেও কুমারগ্রামের মতো প্রত্যন্ত থানা জমজমাট। কারণ, সঙ্কোশ লাগোয়া এলাকায় ‘হাই অ্যালার্ট’ জারি হয়েছে। অসম থেকে তাড়া খেয়ে ভুটানের গ্যালেফুতে ঘাঁটি গাড়া এক বড়ো জঙ্গি নাকি কুমারগ্রাম হয়ে উত্তরবঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করতে পারে। তাই ভুটানের কালীখোলার রাস্তায় পুলিশ, সিআরপি, এসএসবি-র টহলদারি চলছে রাত ১২টাতেও।

পর দিন, শনিবার কুমারগ্রাম বাজারে ঘোরাঘুরি করলাম। সাতসকালে হাট বসেছে। বাড়ির দাওয়ার গাছ থেকে পেঁপে ছিঁড়ে এনেছেন দাসুবালা সিংহ। তিনটে পাকা পেঁপে কিনলাম মাত্র ১০ টাকায়। যা শিলিগুড়ি কিংবা কলকাতায় অন্তত ৫০ টাকা। এক একটা প্রমাণ আকারের কচি লাউয়ের দাম সাকুল্যে ১০ টাকা। সুমি রাভা খেতের উচ্ছে নিয়ে বসেছেন। ৪০ টাকা কেজি। কচি লাউশাকের আঁটি পাঁচ টাকা করে।

ঘণ্টা তিনেক ঘোরাঘুরি করে জনা কুড়ি ক্রেতা-বিক্রেতার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলাম। যা বুঝলাম, তা হল, সব যেমন চলছে, তেমনই চলবে। বেশ কয়েক জন তো স্পষ্টাস্পষ্টি বলেই দিলেন, ‘নতুন করিয়া বেশি ভাবিয়া লাভ কী!’’

পুরনোকে আঁকড়ে থাকার অভ্যেস অবশ্য কুমারগ্রামের নতুন কিছু নয়। দেড় লক্ষ ভোটার। কুমারগ্রাম ও শামুকতলা দুটি বড় জনপদ। চা বাগানের সংখ্যা ১৩। তার মধ্যে দুটি বন্ধ। গ্রাম পঞ্চায়েত ১৮টি। বেশির ভাগই এখন তৃণমূলের দখলে রয়েছে। কিন্তু এমএলএ সেই আরএসপি-র। বাম জমানা থেকেই আরএসপি-র রমরমা। চা বাগানগুলিতে আরএসপি-র ঘাঁটি বড়ই শক্ত। তাই ২০১১ সালে আরএসপি-র হয়ে দশরথ তিরকে জিতেছিলেন। পরে দল ছেড়ে তিনি তৃণমূলে গিয়ে লোকসভা ভোটে জিতে আলিপুরদুয়ারের সাংসদ হয়েছেন। কিন্তু, উপনির্বাচনে কুমারগ্রামে জিতেছেন আরএসপি-র সেই মনোজ ওঁরাও। যিনি ফের প্রার্থী।


হোটেলের কাউন্টারে বসে থাকা এই সেই বেড়াল। ছবি: কিশোর সাহা।

কুমারগ্রাম বাজার, কুলকুলি হাট, রায়ডাকের পাড়ের জনবসতি কিংবা সঙ্কোশ চা বাগানের শ্রমিক কোয়ার্টার্স, সর্বত্র যা চলছে চলুক গোছের মনোভাব দেখলাম। ঘোরাঘুরির সময়েই শুনলাম, এলাকায় চুনিয়াঝোরা, সিকিয়াঝোরা, রায়ডাকঝোরা, পাগলাঝোরার মতো কত সুদৃশ্য, মনোরম জায়গা রয়েছে। যেখানে পর্যটনের কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে। ধারসি, রায়ডাক, সঙ্কোশ, গদাধরের মতো নদীগুলির ধারেও কত জায়গা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। মানু রাভা, অতুল নার্জিনারির মতো কলেজ পড়ুয়ারা বললেন, ‘‘এক্সপ্রেসওয়ে হয়েছে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। রাস্তাঘাটও আগের চেয়ে ভাল। এখন কাজকর্মের কিছু ব্যবস্থা হোক। কৃষিভিত্তিক কিছু কারখানা হতেই পারে। পর্যটনকেন্দ্র হোক না চুনিয়াঝোরায়। তা হলে আমাদের আয়-ব্যয়ের হাল কিছুটা পাল্টাতে পারে। তখন না হয় আমরাও পাল্টানোর কথা ভাবব।’’

চুনিয়াঝোরায় যাওয়া হয়নি। কিন্তু, ডাকবাংলোয় বিশাল করে বাঁধানো ছবিটা চোখে পড়ল বার হওয়ার সময়ে। যেন ছোটখাট জলপ্রপাত। ঝোরার জল আছড়ে পড়ছে অনেকটা নীচে। মন ভাল করে দেওয়ার মতো ছবি। সেই আশির দশকে ন্যাফের অনিমেষ বসুর ছবিটা কুমারগ্রামের ডাকবাংলোর ড্রইংরুম যেন আলো করে রয়েছে। ডাকবাংলোর কোনও সংস্কার নেই। চুনিয়াঝোরারও।

তাই হয়তো ভোট এলেও উদ্দীপ্ত হয় না কুমারগ্রাম।

কেউ ভাল করে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার স্বপ্নে বেগুনি ভেজেই চলেন। কেউ শাক-সব্জি বিক্রি নিয়েই মেতে থাকতে চান। আবার কেউ ভোটের কথা তুললেই বেড়ালের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kishore saha assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE