Advertisement
২৫ মার্চ ২০২৩

‘কহানি’র নাম সৌমিত্র

কী ভাবে ঘটল সৌমিত্র-বিদ্যার ফোনালাপ? ইন্টারভিউ হয়ে যাওয়ার পর ওঁরা বললেনই বা কী? একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্তকী ভাবে ঘটল সৌমিত্র-বিদ্যার ফোনালাপ? ইন্টারভিউ হয়ে যাওয়ার পর ওঁরা বললেনই বা কী? একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত

ছবি:সুব্রত কুমার মণ্ডল

ছবি:সুব্রত কুমার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

প্রথম যখন অ্যাসাইনমেন্টটা দেওয়া হয়েছিল মনে হল এ যেন কালীপটকা হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে বলা হচ্ছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আছেন গল্ফগ্রিনে। আর বিদ্যা বালন মুম্বইতে। কিন্তু বিদ্যাকে দিয়ে না কি সৌমিত্রর সাক্ষাৎকার নেওয়াতে হবে।

Advertisement

জানুয়ারি মাস। তাই এপ্রিল ফুল জোক বলেও উড়িয়ে দেওয়া গেল না। অগত্যা একটা এসএমএস পাঠিয়ে রাখা হল বিদ্যাকে। এমনিতে এসএমএস-এ বিদ্যার উত্তর আসে মাঝরাত নাগাদ।

কিন্তু সেদিনটা ব্যতিক্রম। মিনিট দশেকের মধ্যেই উত্তর এল। তিনি রাজি! ‘কিন্তু কবে? অ্যান্ড হাউ? আয়্যাম ইন মুম্বই...’

বলা হল কনফারেন্স কল-এ যদি সাক্ষাৎকার নেন। অথবা আমরা থাকব গল্ফগ্রিনে। আর ফোনের স্পিকার অন করে তাঁদের কথা রেকর্ড করে নেওয়া হবে...

Advertisement

জানতে চাইলেন কবে হবে সাক্ষাৎকারটা। সেই সঙ্গে অনুরোধ। প্রশ্নগুলো তৈরি করতে সাহায্য চাই। বলাই বাহুল্য সে সাহায্য করতে বিন্দুমাত্র আপত্তির প্রশ্নই নেই।

আনন্দplus বিভাগে গিয়ে বিদ্যা রাজি হয়েছেন বলতে পেরে বেশ আনন্দ হল। পরের ফোনটা সৌমিত্রবাবুকে। আইডিয়াটা শুনে উনিও আপত্তি করলেন না। ডায়েরি দেখে তারিখটা ঠিক করবেন বললেন।

এ দিকে সাক্ষাৎকারের সাক্ষী হয়ে থাকার আনন্দটাও যেমন দারুণ, এই প্রস্তুতিপর্বের অংশ হতে পারাটাও কম আবেগঘন ছিল না। একদম পেশাদার সাংবাদিকের মতো সব হোমওয়ার্ক করলেন বিদ্যা। কী ভাবে, কী অর্ডারে প্রশ্ন করলে ঠিক হবে তা নিয়েও তাঁর চিন্তার শেষ নেই। অ্যান অ্যাক্টর প্রিপেয়ার্স, না আ জার্নালিস্ট প্রিপেয়ার্স বিদ্যাকে দেখে তা নিয়ে ধন্ধে পড়ে যাওয়ার জোগাড়।

এমনিতে সৌমিত্র-প্রসঙ্গ এলেই বিদ্যা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ফিরে যান কলকাতার শু্যটিংয়ের দিনে। লাহাবাড়িতে বিদ্যা শু্যটিং করেছিলেন সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে। সে সব স্মৃতি ঘুরেফিরে পাক খেতে থাকে বিদ্যার মনে।

ঠিক হয় জানুয়ারির মাঝামাঝি বিদ্যা লস অ্যাঞ্জেলেসে বেড়াতে যাওয়ার আগেই সাক্ষাৎকারটা নেওয়া হবে। সৌমিত্রবাবু সময় দিলেন দুপুর ১টায়। যদিও গল্ফগ্রিনের বাড়িতে পৌঁছতে হবে সওয়া বারোটা নাগাদ।

এ দিকে বিদ্যার ম্যানেজার আগের দিন রাতে বলে পাঠিয়েছিলেন যেন একটা ফুলের তোড়া নিয়ে যাওয়া হয় সৌমিত্রদার জন্য। তাতে লিখে দিতে হবে ‘ভাল থেকো, জ্যাঠামশাই’। মেসেজটা পড়ে বুঝতে দেরি হল না যে আজও বিদ্যার ‘ভাল থেকো’র রেশটা কাটেনি। আজও তিনি ‘আনন্দী’। আর সৌমিত্র তাঁর জ্যাঠামশাই!

ফুলের বোকে আর জন্মদিনের কেক নিয়ে পরের দিন গল্ফগ্রিনের বাড়িতে দুপুরবেলা হাজির আমরা। স্নান সেরে, লাঞ্চ করে সৌমিত্র তখন তৈরি। লাল-সাদা জার্বেরা দেওয়া বোকের মাঝখান দিয়ে উঁকি মারছে বিদ্যার সেই ‘ভাল থেকো’ মেসেজ। দেখে সৌমিত্রর চোখ চিকচিক করে উঠল। কে জানে? হয়তো ওই বার্তার মধ্যে তিনি পেলেন এক অভিনেত্রীর সম্মানজ্ঞাপনের সাধ আর গুণগ্রাহী এক নায়িকার উষ্ণতার ছোঁয়া...

“আচ্ছা, এই বাংলাটা কি ও নিজে লিখেছে?” উত্তরে বলা হল হাতের লেখাটা বিদ্যার না হলেও ভাষাটা ওঁর নিজের। ভাললাগার অভিব্যক্তি বলতে সৌমিত্র-র ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি।

ঠিক হল বাড়ির বাইরের বাগানে কেক কাটা হবে। বহু দিনের অব্যবহৃত সাদা গার্ডেন চেয়ার পরিষ্কার করা হল। পিঠে তখন শীত-দুপুরের নরম রোদ। কেকের বাক্সটা নিজেই খুললেন।

দুটো মোমবাতি। দুটোই ফুঁয়ে নেবালেন। এ যেন আশির চৌকাঠে দাঁড়ানো এক কিশোর। ছবি তুললেন অনেকক্ষণ ধরে। তার পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ বার আমাদের যাওয়া উচিত। ফোনটা আসবে তো...’

বাগান পেরিয়ে নিয়ে গেলেন দোতলা একটা বাড়িতে। আগে ওখানে একটা লাইব্রেরি ছিল। একতলায় ১০ বাই ১৫ ফুট একটা ঘর। এক সময় এখানে বসে লেখালিখি করতেন। এখন এখানে ছবি আঁকেন। টেবিলের ওপরেও ছড়ানো ছেটানো রং-তুলি। দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা তাঁর আঁকা সব ওয়াটার কালার।

ঠিক একটা নাগাদ ফোন এল বিদ্যার ম্যানেজারের। বিদ্যার মোবাইলটা গণ্ডগোল করছে। একটা ল্যান্ডলাইন নম্বর পাঠাবেন। ওখানে ফোন করে কথা বলতে হবে।

মিনিট দুই পরে নম্বরটা এল এসএমএস-এ। ততক্ষণে সৌমিত্র রেডি। ফোন করাতেই বিদ্যা ওপার থেকে বললেন তিনি অসম্ভব নার্ভাস। ততক্ষণে ফোনের স্পিকার অন করে দেওয়া হয়েছে। সৌমিত্র নিজেও শুনতে পাচ্ছেন বিদ্যার কথা। মিটিমিটি হেসে নিজেই ফোনটা হাতে নিয়ে আশ্বস্ত করলেন বিদ্যাকে: ‘তুমি যে ভাষায় স্বচ্ছন্দ সে ভাষাতে কথা বললেও চলবে’।

শুরু হয় দুই অভিনেতার কথোপকথন। পোড় খাওয়া সাংবাদিকের মতো বিদ্যা একের পর এক প্রশ্ন করে চললেন। মন দিয়ে শুনে সেগুলোর উত্তর দিলেন সৌমিত্র। বিদ্যার মুখে তিনি ‘আজও কী হ্যান্ডসাম’ শুনে খানিকটা ব্লাশ করলেন। “কাম অন...” বলে এড়িয়ে গিয়ে নিজের ভুঁড়ির গপ্পো জুড়লেন।

মাঝে মধ্যে কথা বলতে বলতে তুলি টেনে নিলেন। কাল্পনিক আঁকিবুকি কাটলেন সাদা কাগজে। আফসোস হল, ইসস্, যদি একটু রং গোলা থাকত... যদি কথা বলতে বলতে ডুবিয়ে ফেলতেন তুলিটা...

মোট ১৮-টা প্রশ্ন করার কথা ছিল। এত দিন সাক্ষাৎকার দিতে দিতে বিদ্যাও শিখে গিয়েছেন সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় মুড, কথাপ্রসঙ্গ বুঝেই প্রশ্ন করা উচিত। সে ভাবেই দু’একটা প্রশ্ন কেটেছেঁটে, আগে পরে করে জিজ্ঞেস করলেন।

তাতে ফল হল ভাল। বেশ সাবলীল একটা আড্ডা শুরু হল। বিদ্যার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন সৌমিত্র। আর উত্তর দিতে গিয়ে নিজেও কখনও কখনও পাল্টা প্রশ্ন করছেন বিদ্যাকে।

এক ঘণ্টা পর যখন সাক্ষাৎকার শেষ হল, তখন দু’জনেই খুশি। “আসলে ব্যাপারটা কী জানেন? এখানে প্রীতিস্পর্শ ছিল। যাকে আমি অ্যাডমায়ার করতে পারি, তার কাছ থেকে এই প্রশ্নগুলো শুনে খুব ভাল লাগল... খুব ডাউন-টু-আর্থ মেয়ে।”

প্রসঙ্গ উঠল বিদ্যার ‘ভুবন সোম’ দেখা নিয়ে। বিদ্যার প্রজন্মের বলিউডের বহু নায়িকাই কিন্তু ওই ছবিটা দেখেননি। সেখানে বিদ্যা শুধু দেখেছেন তাই নয়, তা নিয়ে রীতিমতো চর্চা করেছেন শুনে সৌমিত্র বেশ খুশি। বললেন, “হ্যাঁ, ভাল লাগল জেনে যে ও এই সব ছবি দেখেছে। আর সত্যি তো, যার মধ্যে সংস্কৃতি নেই, সে সংস্কৃতি দিতেও পারে না। যে যাই বলুন, ওই তফাতটা রয়েই যায়। আপনি হয়তো তুলসী চক্রবর্তীকে দেখে ভাববেন উনি তো মাত্র ক্লাস থ্রি অবধি পড়াশুনো করেছেন। উনি আবার মানুষকে কী সংস্কৃতি দেবেন? কিন্তু লোকে ধরতে পারে না এত ব্যতিক্রমী এক মানুষের সংস্কৃতিটা আসে অন্য পথে। যায়ও অন্য পথে। ওটাকে ‘এমুলেট’ করা যায় না। ওঁর কালচারটা কিন্তু জীবন থেকে নেওয়া। ওই ডিএনএ-টা একদম আলাদা।”

এত সময় দিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে অফিসে ফেরার পালা। কিন্তু তার আগে আবার ফোন। ফোনের ওপারে বিদ্যা। বললেন, “ভাবতে পারবেন না আমি কী নার্ভাস ছিলাম! সকালবেলা আবার মোবাইলটা খারাপ হয়ে গেল। তখন আরও টেনশন। নিজে হাতে প্রশ্নগুলো লিখে নিয়েছিলাম। তার পর কথা যেদিকে গেল, ঠিক সেই মতোই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করলাম। আর উনি কী সুন্দর ভাবে উত্তর দিয়ে গেলেন। এই দিনটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আই হোপ, হি ইজ হ্যাপি।”

সৌমিত্রবাবুর প্রতিক্রিয়া জানাতেই বিদ্যা আপ্লুত। বললেন, “মান্নাদার সঙ্গে দেখা করার অভিজ্ঞতাও আমার সারা জীবন মনে থাকবে। আর এদিনটা। আনন্দplus-কে অসম্ভব ধন্যবাদ আমাকে এ রকম একটা প্রস্তাব দেওয়ার জন্য। আমি কৃতজ্ঞ।”

মনে হল তখন বলি এই ভাল লাগাটাই হল আমাদের তরফ থেকে বিদ্যাকে বিলেটেড বার্থডে গিফ্ট!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.