ঋতুপর্ণা, আজ আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একটা গল্প শুনলাম। একবার নাকি এ দেশে বসে বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানে যাওয়া নিয়ে বলেছিলেন, ‘এই তো কিছুক্ষণেই পৌঁছে যাচ্ছি।’ এটা কি গুজব না সত্যি?
ঋতুপর্ণা: (হাসি) বলেছিলাম। আধ ঘণ্টার ফ্লাইট আর যেতে আসতে এক ঘণ্টা। তাই বলেছিলাম।
আপনি শুধু শহর না, বর্ডার পেরিয়ে অন্য দেশে যাওয়া নিয়েও এমন কথা বলতে পেরেছিলেন?
ঋতুপর্ণা: (হাসি) এটাও একটা পারাপার। তবে ‘পারাপার’ শ্যুট করতে গিয়ে আমি অনেক দিন সেটে আগেও পৌঁছে গিয়েছি। এখন আর আমার টাইম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে বিতর্ক হয় না।
আপনারা নিশ্চয়ই বোঝেন যে দুই পারদর্শী অভিনেত্রী একসঙ্গে কাজ করলে প্রথমেই সব্বাই প্রশ্ন করবে পাওলি ভাল, না ঋতু ভাল? এটা জেনেও কী ভাবে কাজ করলেন?
পাওলি: প্রচুর দর্শক সে নিয়ে না ভেবে গোটা ছবিটা নিয়ে চর্চা করবে।
পাওলি, এখানে ডিপ্লোম্যাসি কিন্তু অ্যালাউড নয়...
পাওলি: না, ডিপ্লোম্যাসি করছি না। চিত্রনাট্যটা ভাল ছিল। পরিচালক সঞ্জয় নাগের ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ আমার পছন্দের ছবি। তাই জানতাম ও এই ছবিটা খুব ভাল করে করবে। ঋতুদি আমার থেকে অনেক বেশি সিনিয়র। কোনও কম্পিটিশন নেই। তাই প্রতিযোগিতা কোথায়?
এ প্রশ্ন ছবির নায়কদের নিয়ে উঠবে না। কারণ বাংলাদেশী অভিনেতা আহমেদ রেজা রুবেল এখানকার দর্শকের কাছে অত পরিচিত মুখ নন...
ঋতুপর্ণা: ব্রাত্য বসুর চরিত্রটার মধ্যে হিস্টিরিয়া রয়েছে। খুব বড় মাপের অভিনেতা হলে ওই বডি ল্যাঙ্গোয়েজ, বাচনভঙ্গি আনা যায়। রুবেলের চরিত্রটা খুব শান্ত। কিন্তু ভেতরে গ্রিভ্যান্স ছিল।
পাওলি: ব্রাত্যদা আর রুবেলদা দু’জনেই আউটস্ট্যান্ডিং। ছবিতে ব্রাত্যদা আর আমি যে চরিত্র করেছি সেই রকম চরিত্র বাংলা সিনেমায় এর আগে দেখা যায়নি। ব্রাত্যদা না হলে এই চরিত্র সম্ভব ছিল না। যে ক’টা কাজ ব্রাত্যদার সঙ্গে করেছি তার মধ্যে এই চরিত্রটা সেরা। রুবেলদার চরিত্রের মধ্যে দারুণ কনসিসস্টেন্সি রয়েছে। মিনিমাল অভিনয়।
অনেকেই তো বলেন ঋতুপর্ণা আর পাওলির মধ্যে হাল্কা ফ্রিকশন আছে...
পাওলি: তাই নাকি? আমরা কি নুড়ি পাথর যে আমাদের মধ্যে ফ্রিকশন থাকবে? আমি ইনসিকিওর নই।
ঋতুপর্ণা: আমি টিমওয়ার্কে বিশ্বাস করি। আমার সঙ্গে ওর তো সমস্যা নেই।
সত্যি? দু’জনেই লেক গার্ডেন্সে থাকেন। এক বছর আগে বলেছিলেন কেউ কারও বাড়িতে যাননি। ছবি করা হয়ে গেল। এত দিনে কেউ কারও বাড়িতে গিয়েছেন?
পাওলি: না। ঋতুদি এত ব্যস্ত। আমি তো ব্রাত্যদা বা সঞ্জয়দার বাড়িতেও কোনও দিন যাইনি।
ঋতুপর্ণা: পাওলির কিছু ব্যাপার ভাল না লাগলে সেটা আমি বলে দিতে পারি। যদি ভাল লাগে সেটাও বলতে পারি।
পাওলি: আমরা তো আরও একটা ছবি একসঙ্গে করছি। রাজাদার (সেনের) ছবি। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘মায়ামৃদঙ্গ’র ওপর ভিত্তি করে করা।
ঋতুপর্ণা: আমি সঞ্জয়দাকে বলেছিলাম যে ছবিতে আমাদের দু’জনকে নিয়ে দৃশ্য রাখা হোক। ইনসিকিওরিটি থাকলে বলতাম?
পাওলি: থ্যাঙ্কস ঋতুদি।
ছবি দেখে দু’জনের দু’জনকে কেমন লাগল?
ঋতুপর্ণা: জানতাম পাওলি খুব ভাল অভিনেত্রী। এখানে দেখে মনে হল ও অনেক বেশি পরিণত হয়েছে। খুব জটিল একটা চরিত্র। ছবির প্রথমে ও গ্রামের অল্পবয়েসি একটা মেয়ে। তার পর ওর বিয়ে হয়। পাওলির প্রকাশভঙ্গিতে তখন ভঙ্গুর ভাব। আর শেষে ওর বোস্টমী লুক। ওর চরিত্রের মধ্যে নানা রকমের টুইস্ট আছে।
আজকালকার বাংলা ছবিতে টুইস্ট ব্যাপারটা নতুন ট্রেন্ড। ‘চতুষ্কোণ’, ‘খাদ’ এখন ‘পারাপার’...
পাওলি: ছবিটা শেষ পর্যন্ত না দেখলে কেউ বুঝবে না যে এখানেও থ্রিলার এলিমেন্ট আছে। সব কিছুই খুব সাটল। আমাদের ছবিতে চমক আছে, কিন্তু সেটা আরোপিত নয়।
ঋতুপর্ণা: সেটাই। সঞ্জয়দা রূপক হিসেবে অনেক কিছু খুব সাটল ভাবে ব্যবহার করেছে। পাওলির চোখের ব্যবহার খুব ভাল।
পাওলি: ঋতুদি খুব ভাল অভিনেত্রী। কত ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছে। ‘পারাপার’য়ের চিত্রনাট্যটা খুব ভাল। ঋতুদির চরিত্রে (দামিনী) ঊর্মিলার (আমার) চরিত্রের মতো চড়াই-উতরাই নেই। তবে একটা শান্তভাব রয়েছে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে দামিনী সংসারের হাল ধরে। তখন ও খুব স্ট্রং। মাঝেমধ্যে স্টার্ন-ও। খুব ভাল অভিনেত্রী বলেই সেটা ও ফুটিয়ে তুলেছে। দামিনীর জন্য ঋতুদি হল পারফেক্ট চয়েস।
ঋতুপর্ণা: দামিনীর চরিত্রের মধ্যে একটা স্থিরতা আছে। সেটা প্রকাশ করাটা খুব ডিফিকাল্ট। সব সময় সোজা তাকিয়ে রয়েছি। আমার লাইফে যা চলতে থাকে, সেটা ফুটিয়ে তোলাটা খুব কঠিন।
অনেক সময় এত শান্ত ভাবে অভিনয় করাটা খুব ডিসপেটিভ হতে পারে। কেউ হয়তো অভিনয় করতেই পারল না। কিন্তু সবাই বলল কী দারুণ ন্যাচারাল অ্যাক্টিং! কোনও ছবি দেখে এটা আপনাদের মনে হয়েছে?
ঋতুপর্ণা: অভিনয় করা আর চরিত্রে মিশে যাওয়ার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ফারাক থাকে। কেউ যদি একদম অভিনয় না করে, সেটাকে ন্যাচারাল অ্যাক্টিং বলে চালাতে চায়, তা হলে তা বোঝা যায়। অনেক ক্ষেত্রে ছবির অন্য সাপোর্ট সিস্টেমটা এমন থাকে যে সেই অভিনয় দেখে মনে হয় যেন ফ্যান্টাস্টিক কাজ হয়েছে। একটা-দু’টো ছবিতে এ সব হতে পারে। সব ছবিতেই এটা করা যায় না।
পাওলি: এটা পরিচালকের ওপর নির্ভর করে। তবে একদম অভিনয় না করে দর্শকের চোখে ধুলো দেওয়া যায় না।
যদি বাস্তব জীবনে আপনাদের কোনও বন্ধুকে দামিনীর জায়গায় দাঁড়াতে হয়, যেখানে তার স্বামী এ ভাবে জেলে চলে যায়, তা হলে আপনারা ওকে কী উপদেশ দেবেন? বলবেন স্বামীকে ক্ষমা করে দাও?
ঋতুপর্ণা: দামিনী যা করেছে, আমিও তাই করতে বলতাম। যদিও জানি না এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেলে কোনও মহিলা কী ভাবে মানসিক ভারসাম্য রেখে চালিয়ে যেতে পারে...
দামিনীর স্বামী তো জেলে চলে যায় আর ছেলেমেয়েরা সারা জীবন পাড়া-পড়শিদের কাছে শুনে যায় তাদের বাবা একজন ধর্ষক...
ঋতুপর্ণা: ভাবুন তো কী সাঙ্ঘাতিক ট্রমা সেটা! এ রকম আমার হলে তো আমি আধমরা হয়ে যেতাম... প্যারালাইজড্।
আচ্ছা, কখনও যদি আপনাদের প্রেমিককে দ্যাখেন অন্য কোনও মহিলার জন্য বড় স্যাক্রিফাইস করছেন, মেনে নিতে পারবেন?
পাওলি: সত্যি প্রেমে পড়লে আমি সেই পুরুষকে ক্ষমা করে দেব। কারণ প্রেম মানে স্যাক্রিফাইস। প্রেম মানে ক্ষমা। পরিস্থিতির চাপে মানুষ বিভিন্ন ভাবে রিঅ্যাক্ট করে। ঘটনাটা ভুলব না। কিন্তু ক্ষমা করে দেব।
ঋতুপর্ণা: আমি সব সময় ক্ষমা করে দিই (হাসি)। আই ফরগিভ বিগটাইম।
ঋতুপর্ণার অনুভূতিকে কেউ মিসইউজ করলে কী ভাবে সামাল দেন?
ঋতুপর্ণা: (হাসি) আই অ্যাম স্টিল ডিলিং উইথ ইট। তবু আমি যদি মনে করি আমি ক্ষমা করব, তা হলে প্রথম স্টেপটা নিজেই নেওয়ার কথা ভাবি।
প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে না?
ঋতুপর্ণা: আমি প্রতিশোধপরায়ণ নই। চেষ্টা করি এমন কিছু করতে যাতে আমি নিজে স্যাটিসফায়েড হয়ে বাঁচতে পারি। স্বীকার করছি হতাশ লাগে। মনে হয় ইউজড হয়ে গেলাম। তবু নিজেকে বোঝাই যে এখানেই জীবন শেষ হয়নি। তখন আই জাস্ট এম্পটি মাই হার্ট। অপেক্ষা করি যাতে কেউ এসে আমাকে পরিপূর্ণতা দেবে (হাসি)। আমার এক দিদি স্কটল্যান্ডে থাকে। ও বলেছিল এ রকম কিছু হলে এম্পটি ইয়োর হার্ট। তার পর ওয়েট করো। কেউ এসে ঠিক আবার ভরিয়ে দেবে।