Advertisement
E-Paper

নৌকোডুবির ৪০

মোহনবাগান-০। ইস্টবেঙ্গল-৫। মোহন সমর্থকদের সেই কাল ৩০ সেপ্টেম্বর। বা ইস্টবেঙ্গলের সোনার দিনের আজ চল্লিশ বছর পূর্তি! লিখছেন রতন চক্রবর্তীমোহনবাগান-০। ইস্টবেঙ্গল-৫। মোহন সমর্থকদের সেই কাল ৩০ সেপ্টেম্বর। বা ইস্টবেঙ্গলের সোনার দিনের আজ চল্লিশ বছর পূর্তি! লিখছেন রতন চক্রবর্তী

সেই শিল্ড ফাইনাল: শ্যাম থাপার শট নেটে। বাঁচাতে পারলেন না সুব্রত ভট্টাচার্য

সেই শিল্ড ফাইনাল: শ্যাম থাপার শট নেটে। বাঁচাতে পারলেন না সুব্রত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৫৫
Share
Save

চল্লিশ বছর পরও মোহনবাগান তাঁবুতে হাহাকার। আফশোস। সেই হারের বদলা না নিতে পারার যন্ত্রণা।

১৯৭৫-এর ৩০ সেপ্টেম্বরের ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের কাছে ঐতিহাসিক পাঁচ গোল খাওয়ার লজ্জার কথা উঠলে গঙ্গাপাড়ের
তাঁবুর বিখ্যাত লনে এখনও নেমে আসে অন্ধকার। মাথা নিচু হয়ে যায় রঞ্জিত রায়চৌধুরী, স্বাধীন মল্লিক, আনন্দ বসুদের। যাঁদের বেশির ভাগেরই একশো পঁচিশ বছরের ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ ৫০-৬০ বছরের।

‘‘৫-৩ করেছিলাম এক বার। কিন্তু ৫-০ তো হয়নি কখনও। ওটা এখনও ইস্টবেঙ্গলের লোকজন বলে যায়। উত্তর দিতে পারি না। খারাপ লাগে,’’ বিকেলে বয়স্কদের বাগান তাঁবুতে যে বিখ্যাত আড্ডাটা এখনও অক্ষত, সেখানে বসে বলছিলেন ১৯৫৮ সাল থেকে মাঠে আসা রঞ্জিতবাবু। পাশে বসে স্বাধীনবাবুর মন্তব্য, ‘‘জানি না মৃত্যুর আগে বদলাটা দেখে যেতে পারব কি না। ওটা তো আমাদের কাছে ঐতিহাসিক লজ্জা।’’ এঁরা সবাই নিজেদের মাঠে প্রিয় ক্লাবের হেনস্তা দেখার সাক্ষী ছিলেন সেই কলঙ্কের মঙ্গলবারে। যন্ত্রণার দিনের যে চল্লিশ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ বুধবার, তা-ও খেয়াল রাখেননি কেউ-ই।

বাগান তাঁবুতে ঢোকার মুখে দু’পাশে যে বেঞ্চগুলো আছে সেখানে নবীন প্রজন্মের বাগান সমর্থকদের ভিড়। যাঁরা ওই ঘটনার কথা শুনেছেন, দেখেননি। বড়দের আড্ডার বিষয় শুনে রাজু-বিপ্লবদের গলাতেও আফশোস। ‘‘ওটা দেখিনি। কিন্তু ডার্বি এলেই ফেসবুকে ওরা খোঁটা দেয় পাঁচ গোলের কথা লিখে। আমরা কি কখনও এর বদলা নিতে পারব না? আবার তো চার গোল হল এ বার।’’

হাহাকার। আফশোস। দুঃখ। গ্নানি। একাকার হয়ে যায় মুহূর্তে।

তা হলে আর হল না! হবে কখনও?

কে বলল হয়নি? প্রশ্ন শুনে ক্ষুব্ধ হন টুটু বসু। যিনি ক্লাব প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর বলেছিলেন বাঙালদের পাঁচ গোল দেওয়ার পর তিনি পদ ছেড়ে দেবেন। সেই টুটু বলে দিলেন, ‘‘আমি তো পাঁচ আঙুল দেখিয়ে বলেছিলাম বাঙালদের পাঁচ গোল দেব। সেটা তো দিয়ে দিয়েছি। যন্ত্রণার তো শেষ হয়ে গিয়েছে। বাঙালদের ওই গর্ব আর নেই।’’ কিন্তু ৫-০ আর ৫-৩ তো এক নয়? সেটা ক্লাবের প্রবীণ সদস্যরা মানলেও টুটুবাবু মানতে নারাজ। মুখে না মানলেও তিনি কিন্তু এখনও প্রেসিডেন্ট ক্লাবের। হয়তো ৫-০ র আশাতেই ছাড়েননি পদ।

বাগানের অন্ধকারের উল্টো ছবি লেসলি ক্লডিয়াস সরণির পাশের ক্লাবে।


জয়ের পর ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কোলে কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

টানা ছ’বার কলকাতা লিগ জেতার পর ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে অনেকটাই স্বস্তি। পাঁচ গোলের চার দশক পালনের কোনও অনুষ্ঠানের কথা জানানো হয়নি এখনও। তবে বিভিন্ন ফ্যান ক্লাব সেই গৌরব-কথার প্রচার শুরু করেছে সদর্পে।

কিন্তু সেই ইতিহাসের কথা তো মনে রাখতে চান না সে দিনের নায়করাই।

পাঁচ গোলের প্রসঙ্গ তুললে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে সুভাষ ভৌমিক বলে দিলেন, ‘‘ওই সব পাঁচ-টাচ গোলের কথা ভুলে গেছি। মাদকতা নিয়ে বেঁচে থাকুন সমর্থক আর কর্তারা। ওদের মনে থাকতে পারে। আমার কিছু নেই।’’

দেশের অন্যতম সফল কোচের কথাগুলো আরোপিত মনে হয়। ফুটবলার জীবনের প্রতিটি ঘটনা যাঁর মস্তিষ্কের কোটরে মজুত।
বলে যেতে পারেন নিরন্তর। তিনি এই বিষয় নিয়ে ভাবতেই নারাজ। ৫-০-র সেই দিনে ফুটবলার সুভাষ গোল পাননি। কিন্তু দু’টো গোল করিয়েছিলেন। পরে অবশ্য তাঁর কোচিং-এ ইস্টবেঙ্গল পাঁচ গোল খেয়েছিল এক বার। তবে সেটা ৫-০ হয়নি। ২০০৯-তে মোহনবাগান ৫-৩ হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে।

৫-০-র বদলা ৫-৩ কি না তা নিয়ে তর্কের তুফান উঠেছিল সর্বত্র। চায়ের দোকানে, রকের আড্ডায়। ফেসবুকে, টুইটারে। চার দশক পর পঁচাত্তরের পাঁচ গোলের কথা তুললে মনে হয়, বাগান সমর্থকরা দু’টোকে এক করতে রাজি নন। তাদের আশা পূরণ হয়নি। যন্ত্রণাটা রয়েই গিয়েছে।

গৌরব এবং কলঙ্ক—দু’টোর কোনওটাই নিক্তিতে তুলতে চান না বলেই হয়তো সুভাষ পুরোটাই ‘ভুলে’ গিয়েছেন বা ভুলে যেতে চাইছেন এখন। বারবার বলছিলেন, ‘‘এখন বিশ্ব ফুটবল দেখার পর ওসব পাঁচ-ছয় গোলের কোনও মূল্য নেই। ওটা একটা দিনের ব্যাপার। বরং ইস্টবেঙ্গলের টানা ছয় বার কলকাতা লিগ জেতাটা বড় ব্যাপার। যত্তোসব বস্তাপচা জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া।’’

কিন্তু নিউ আলিপুরের অভিজাত মহল্লা থেকে সল্টলেকের বিত্তবান এলাকায় গিয়েও চমকে যেতে হয়। সেই উজ্জ্বল মুহূর্তের উদযাপনের মুখে দাঁড়িয়ে সুভাষের কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দেন, ‘‘বিশ্ব ফুটবলে আকছার গোলের বন্যা দেখার পর ওটা এখন অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়।’’ সিরিয়ালের এক অভিনেতার বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়ার পথে পিকে গড়গড় করে বলে যান সে দিনের সোনালি সত্তর মিনিটে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে তিনি কী করেছিলেন, তাঁর গল্প। ‘‘আরে বাবা ৫-০ তো একটা ইতিহাস। আমার কোচিং-এ ছাত্ররা তৈরি করেছিল বলে একট গর্ব এখনও আছে। কিন্তু এখন ওটা নিয়ে আলোচনার কোনও মানে হয় না। বার্সেলোনা, চেলসি, ম্যান ইউ, আকছার পাঁচ-ছয় গোল দিচ্ছে, খাচ্ছে। গোল নয়, ট্রফি নিয়ে এখন সবাই মাথা ঘামায়। ’’

এবং কী আশ্চর্য পি-কের সঙ্গে সহমত চুনী গোস্বামীও। আজ আর সেই ৫-০ তাঁকে যন্ত্রণা দেয় না। ‘‘এখনকার আধুনিক ফুটবলের যুগে ওটা অচল আধুলি। ওটা হয়তো দুঃখ দেয়। তবে যন্ত্রণা দেয় না। একটা দিন কি ঘটেছিল, কোন অবস্থায় ঘটেছিল তাঁকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার কোনও মানে হয় না,’’ বলে দেন বাগানের ঘরের ছেলে।

চার দশক আগে ইতিহাস তৈরির দুই কারিগর পিকে-সুভাষ বা তাঁর বিপক্ষ শিবিরের চুনীর দৃষ্টিকোণের সঙ্গে এই প্রজন্মের কট্টর ইস্ট-মোহন সদস্য সমর্থকদের ভাবনা কতটা খাপ খায় তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠতেই পারে।

আড়াই সপ্তাহ আগে কলকাতা ডার্বির দিনের কথাই ধরা যাক। ইস্টবেঙ্গল তখন ৪-০ এগিয়ে। বাগানের স্টপার সঞ্জয় বালমুচু একটা গোললাইন সেভ করলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে আফশোসের যে সুনামি উঠেছিল তা কোরিয়ান ডু ডং-এর হ্যাটট্রিকের সুযোগ নষ্টের সময়ও ওঠেনি। মাঠ থেকে বেরোনোর সময় ইস্টবেঙ্গলের কিছু কর্তা আর সমর্থক দল বেঁধে এসে সাংবাদিকদের কাছে বলে গিয়েছিলেন, ‘‘দাদা কাল অন্তত লিখবেন আবার পাঁচ গোলের হাত থেকে ওরা বাঁচল।’’ যা শোনার পর মনে হয়েছিল, লিওনেল মেসি- রোনাল্ডোরা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ার পরও ডার্বি-আবেগ এখনও অম্লান। অমলিন তার ইতিহাসও।

না হলে আজকের প্রজন্মের শিল্টন পাল কেন চার গোল খাওয়ার পর নিজের ডিফেন্ডারদের মাঠেই ডেকে বলবেন, ‘‘ডিফেন্সটা জমাট রাখ। পাঁচ গোল যেন না হয়।’’ সচিন তেন্ডুলকরের টিমের হয়ে আইএসএল খেলতে এখন কেরলে রয়েছেন বাগান অধিনায়ক শিল্টন। পঁচাত্তরে সেই লজ্জার দিনের পর বাগান কিপার ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় মার খাওয়ার ভয়ে তিন মাস লুকিয়ে ছিলেন আত্মীয়দের বাড়িতে। শিল্টনের লুকোতে হয়নি ঠিক। কিন্তু কেরল থেকে ফোনে ভাস্করের উত্তরসূরি বাগান-কিপার বলছিলেন, ‘‘ওটা হলে লজ্জার শেষ থাকত না। পঁচাত্তরে আমার জন্ম হয়নি। ওই লজ্জার দিনের কথা বড়দের মুখে শুনেছি। ফেসবুকে ওই দিনের কাগজ কে যেন ট্যাগ করছিল। পড়েছিলাম।’’ যা শুনে মনে হয়, ইস্ট-মোহন চিরকালীন দ্বৈরথের প্রতি ইঞ্চির ইতিহাস নিয়ে এখনও তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন কট্টর সমর্থকরা।

ইস্টবেঙ্গলের সোনালি যুগের ফুটবল সচিব সুপ্রকাশ গড়গড়ি বা আঠাশ বছর ধরে লাল-হলুদের ম্যানেজার পদ সামলানো স্বপন বল। দু’জনেই চল্লিশ বছর আগে ৫-০ ম্যাচের দিন ছিলেন মোহনবাগান মাঠে। সুপ্রকাশবাবু মুম্বই থেকে ফোনে বললেন, ‘‘ব্রাজিলের সাত গোল খাওয়া মাঠে বসে দেখেছি। কিন্তু এ বারের কলকাতা ডার্বিতে যদি ছ’বার টানা লিগ জেতার সঙ্গে ৫-০ টাও হত তবে স্বর্গীয় সুখ পেতাম।’’ আর স্বপনবাবু? ‘‘প্রচুর ম্যাচ রিজার্ভ বেঞ্চে বসে পাঁচ-সাত গোলে জিততে দেখেছি টিমকে। ওদের হারানোটা আমার কাছে ধর্মপালনের মতো। আর পাঁচ গোল? ওরা তো ৫-৩ গোলে জিতে বলেছিল সমান-সমান। সে দিনই আসলে আমাদের ৫-০ টা ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল।’’ বলে দেন ওই ইস্টবেঙ্গল কর্তা।

এটা ঘটনা যে ডার্বির নব্বই বছরের ইতিহাসে গোলের নিরিখে পঁচাত্তরের শিল্ডের ওই ম্যাচকে এখনও সেরা স্কোর বলে সাজিয়ে রেখেছে উইকিপিডিয়া। ডার্বিতে কোনও ম্যাচ ৩-০ গড়ালেই কোনও এক দল সমর্থক আওয়াজ তোলেন ফের ৫-০ চাই অথবা বদলা চাই। হতে পারে সেটা আবেগের গামলায় ডুবে থাকা সদস্য-সমর্থকদের নির্মল তৃপ্তির উপাদান। হতে পারে উত্তেজনা-বিস্ফোরণের অন্যতম মাদকতা। হতে পারে সেটা ইতিহাস নিয়ে বাঙালির চিরকালীন মত্ততার একটা ধারাবাহিকতা— কিন্তু মানতেই হবে পঁচাত্তরের পাঁচ গোলের কথা এখনও বাংলার ঘরে ঘরে অনুরণিত হয়। আনন্দ দেয়, দুঃখ দেয়।

১৯৭৫-এর অক্টোবরের প্রথম দিন আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় দু’টো ছবি বেরিয়েছিল। তাঁর একটা দেখলে ব়়ড্ড নির্মম লাগে এখনও। চার গোল খাওয়ার পর ভেঙে পড়া তরুণ বাগান কিপার ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়কে টেনে তুলছেন সিনিয়র সুব্রত ভট্টাচার্য। পাশের ম্যাচ রিপোর্টে স্টাফ
রিপোর্টার শুরু করেছেন এই ভাবে, ‘‘বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না সেই ফলে চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানকে পরাজিত করে….’’

চল্লিশ বছর পর সেই দিনের উদযাপন মুহূর্তে এসে লিখতে হচ্ছে, ফুটবল বিশ্বায়নের এই যুগেও কলকাতা ডার্বি এখনও মেসি-রোনাল্ডোদের গোলার্ধে ঢুকতে পারেনি। বুদ্ধিতে যে আবেগের সত্যিই ব্যাখ্যা চলে না।

3oth september cursed 30 september ratan chakraborty eastbengal mohunbagan 40th anniversary five goal eastbengal five goal eastbengal vs mohunbagan eastbengal 5 mohunbagan 0 abpnewsletters anandaplus cover story ananda plus latest news

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}