প্রথম প্রযোজনাতেই রুল-বইয়ের বাইরে বেরিয়ে, হৃদয় দিয়ে স্টেপ আউট করে খেলেছেন অনুষ্কা। নায়িকা গাড়ি চালাতে চালাতে ভিলেনকে পিষে মেরে দিচ্ছেন, ভিলেনদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ি ছোটাচ্ছেন, ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত শরীরে রোয়াকে বসে সিগারেট ধরাচ্ছেন—এ জিনিস বলিউডের রুল-বইতে নেই। সেখানে প্রতিশোধ শুধুই পুরুষের পবিত্র দায়িত্ব! বাঁধা ছকের গণ্ডি পেরিয়ে খেলাই এই ছবিকে জিতিয়ে দিচ্ছে।
ছবি কতটা ভাল, ফেস্টিভ্যাল সার্কিট বা জাতীয় পুরস্কারের উপযুক্ত কি না, সে সব কথা নিরর্থক। জাত্যভিমানের এই যুগে যখন নির্ভয়া-কাণ্ড নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করা হয়, কেউ কেউ পাল্টা দেখান ব্রিটেনেও মেয়েরা কী ভাবে ধর্ষণের শিকার হন, কেউ বা ভারতের থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিটেন, আমেরিকায় ধর্ষণের হার বেশি জানিয়ে তৃপ্তি বোধ করেন, সেই সময়ে খাপ পঞ্চায়েত নিয়ে এই ছবি জরুরি ছিল। হল থেকে বেরিয়ে পপকর্ন খেতে রুচি থাকে না।
ধর্ষণই সব নয়। কন্যাভ্রূণ হত্যা, পণের জন্য বধূহত্যা, খাপ পঞ্চায়েত, নাবালিকা পাচার...বহু ভাবেই এ দেশে মেয়েদের ওপর হিংসাত্মক অত্যাচার ঘটে। সভ্য দুনিয়া সে সব ভাবতেও পারে না। ছবি দেখতে যাওয়ার আগে এক ভদ্রমহিলা সতর্ক করেছিলেন, ‘খুব ভায়োলেন্ট ছবি। মাঝে মাঝে সহ্য করা যাচ্ছে না।’ লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারা, জান ধুকপুক করতে থাকলেও থেঁতলে দেওয়া...ইত্যাদি নানা সিকোয়েন্স রয়েছে। অস্বস্তিকর ও নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে। সেটাই পরিচালক নভদীপ সিংহের অন্যতম কৃতিত্ব। খাপ পঞ্চায়েত ও অনার কিলিং নিয়ে তৈরি ছবি কি অহিংসা প্রচার করবে?
হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েত, আরও ভাল ভাবে বলতে গেলে ২০০৭ সালে মনোজ-বাবলি হত্যাকাণ্ড এ ছবির বীজ। স্বগোত্রে বিয়ে করার কারণে হরিয়ানার কারোরা গ্রামে মনোজ ও বাবলিকে খাপ পঞ্চায়েতের লোকেরা পিটিয়ে খুন করে। প্রায় তিন বছর মামলা চলার পরে আদালত দোষীদের পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। অনার কিলিং-এর জন্য এ দেশে প্রথম মৃত্যুদণ্ড! বাণীগোপাল শর্মা নামে যে বিচারপতি এই রায় দেন, পরে তিনি হাইকোর্টের কাছে তাঁর নিরাপত্তা বাড়ানোর আবেদন করেন, শেষ অবধি চণ্ডীগড়ের কাছে পঞ্চকুলায় বদলি নেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তৈরি ছবি যদি এসি হলেও দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলে, সিনেমার জয়!
কারণ, সিনেমার বাস্তব খবরের কাগজের বাস্তবের চেয়েও জোরালো। আদালতের রায়ের পর হরিয়ানার খাপ নেতারা যখন রেল ও রাস্তা অবরোধ করছিলেন, কলকাতা শহরে আমরা বিরক্ত হয়েছিলাম। হরিয়ানা, রাজস্থানের গ্রামে এ সব হয়!
কিন্তু নভদীপ সিংহের কৃতিত্ব অন্যত্র। সন্ধ্যার ধূসর অন্ধকারে বোন ও ভগ্নিপতিকে গাড়িতে তুলে দাদা খুন করতে যাচ্ছে, পকেটে মোবাইল ফোন। ক্রমে রাত গাঢ় হয়। সকলের মোবাইলে টর্চ জ্বলে। পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল ‘অনার কিলিং’ শব্দ শুনেই অসহায় অনুষ্কাকে তাড়িয়ে দেয়, ‘না, না, আমি কিছু শুনিনি, চলে যান।’ বড় অফিসার বলেন, ‘গুড়গাঁওতে যেখানে শপিং মল শেষ হয়, সেখানে আপনাদের গণতন্ত্র, সংবিধান ইত্যাদির সীমাও শেষ হয়।’ খাপ পঞ্চায়েত আফ্রিকার অরণ্যে থাকে না। ফোর্থ গিয়ারে গাড়ি চালাতে জানে, মোবাইলে কথা বলে, আপনার-আমার মতোই বিশ্বায়নের শরিক, ভারতীয় বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর পরও অস্বস্তি হবে না?
দুই ভারত এই ছবিতে একাকার। অনুষ্কা ও নীল ভূপালম উচ্চবর্গের নাগরিক দম্পতি। আউটিং-এ দশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে বেরিয়ে পড়েন। হরিয়ানার গ্রাম, পুরুষরা খাটিয়ায় বসে মদ্যপানে ব্যস্ত। রেস্তোরাঁয় একটি মেয়ে এসে অনুষ্কার পায়ে আছড়ে পড়ে, ‘দিদি, আমাদের বাঁচাও।’ তার পরই কিছু যুবক এসে জোর করে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। সারা ছবি জুড়ে রাতের অন্ধকার, জাতীয় সড়ক থেকে নেমে হরিয়ানার বিবর্ণ হলুদ অন্ধকার গমখেতে গাড়ি ঢুকে যায়। দূরে রেললাইন বেয়ে ছুটে যায় আলোময় এক্সপ্রেস ট্রেন।
আলো, অন্ধকারের মতোই একসঙ্গে মাখামাখি হয়ে থাকে কসমোপলিটান ও খাপ-ভারত। অনুষ্কা শর্মা ছাড়াও এ ছবির আরও দুই প্রযোজক ‘উড়ান’খ্যাত বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে এবং ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’খ্যাত অনুরাগ কাশ্যপ। অনুষ্কা নায়িকা হিসেবে চমৎকার, ওই দুই প্রযোজকের ক্রিয়েটিভ ইনপুটসও হেলাফেলার নয়। হলে বসেই আঁচ করা যায়, প্রযোজকরা সকলে রেখে গিয়েছেন নিজস্ব সৃজন-স্বাক্ষর।
ছবির আর এক গুণ, মিনিমাল মিউজিক। অনুষ্কা যখন কোনও ভিলেনকে গাড়ি চাপা দিচ্ছেন, বাইক চালানো দুই ভিলেনকে দুরন্ত গতিতে লোহার রডের আঘাতে বাইক থেকে মেরে ছিটকে দিচ্ছেন, খুব ভয় হচ্ছিল। এর পরই ব্যাকগ্রাউন্ডে দুর্গাপুজোর আওয়াজ শোনা যাবে, নারীর শক্তিরূপিণী প্রকাশের ষোলো কলা পূর্ণ হবে। থ্যাঙ্ক গড, মহাপূজার বাজনা বাজেনি।
চমৎকার অভিনয় করেছেন বোনকে খুন করতে যাওয়া দাদা সতবীরের ভূমিকায় দর্শনকুমার এবং তাউজির চরিত্রে রবি ঝঙ্কাল। অনুষ্কার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন এঁরা।
আছেন আরও এক জন। দীপ্তি নাভাল। ছবির শেষে নীল, দর্শনকুমার, রবি সবাই মারা গিয়েছেন। ক্লান্ত শরীরে অনুষ্কা বল্লম টানতে টানতে এগিয়ে যান, লোহা ঘষটানির ধাতব আওয়াজ ওঠে। নায়ক ও খলনায়কদের মৃত্যুশেষে ভোর, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই নারী: দীপ্তি ও অনুষ্কা। রাতের হিংসাকল্লোল শেষে এক জন স্বামীহারা, অন্য জন পুত্রহারা।
ছবির অন্যতম দুর্বলতা, ব্রিটিশ ছবি ‘ইডেন লেক’-এর বাসি গন্ধ। সে ছবিতেও নায়ক-নায়িকা একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল, সমুদ্রতটে এক গ্যাং-এর অত্যাচারে নায়িকা পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করে। দেখা যায়, পুলিশ ওই গ্যাং-এর লোক। নায়িকা অতঃপর যে বাড়িতে আশ্রয় নেয়, সে গ্যাং-এরই নেতা। পরিচালক এই গল্পকেই ভারতের মাটিতে সাজিয়েছেন। মন্দ লাগছে না, কিন্তু বিখ্যাত ছবিটির প্রভাব কাটাতে পারেননি।
অতএব, দশে সাত। অনেকে ছবিটাকে রোড মুভি বলছেন, কিন্তু দুঃস্বপ্নের অন্ধকার-যাত্রা এই ছবির একমাত্র উপজীব্য নয়। অ্যাডভেঞ্চার নয়, ভয়ঙ্কর সামাজিক বাস্তবতাই আসল। হরর ছবিও নয়। ভূত এবং বিপাশা কেউই এখানে নেই।
শুধু অনন্য পারফরম্যান্স নিয়ে অনুষ্কা শর্মা আছেন!
আনাচে কানাচে
খেলাচ্ছলে: শহরে এক ফ্যাশন শো-তে শো-স্টপার গার্গী রায় চৌধুরী। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy