Advertisement
E-Paper

ঘিরে ধরে ডিলান যখন

এক ভিন্ জগতের কবি-গায়ক-গীতিকার-বাউল। বব ডিলান। তাঁর নোবেল রাগাচ্ছে, কাঁদাচ্ছে, ভাল লাগাচ্ছে নচিকেতা চক্রবর্তী-কে জখমি। আগুনে আধপোড়া। খেটে খাওয়া মানুষের নীরবতাকে গানে বলেছিলেন যে মানুষ, তাঁকে স্বীকৃতি দিল সারা বিশ্ব! তৃতীয় বিশ্বের মানুষ, খেতে না পাওয়া মানুষ, আর আমার মতো গাইয়েরা (পড়ুন বাঈজি) এখন বড্ড আহা, উঁহু করছি।

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০৪
‘মিস্টার ট্যাম্বোরিন ম্যান’: বব ডিলান

‘মিস্টার ট্যাম্বোরিন ম্যান’: বব ডিলান

জখমি। আগুনে আধপোড়া। খেটে খাওয়া মানুষের নীরবতাকে গানে বলেছিলেন যে মানুষ, তাঁকে স্বীকৃতি দিল সারা বিশ্ব! তৃতীয় বিশ্বের মানুষ, খেতে না পাওয়া মানুষ, আর আমার মতো গাইয়েরা (পড়ুন বাঈজি) এখন বড্ড আহা, উঁহু করছি। আমাদের দেশ থেকে আর কে নোবেল পেতে পারেন তার লিস্টিও দেখছি বাঙালি ইতিউতি তৈরি করে ফেলেছে। থাক সে কথা। সে নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।

যাক! বাঈজিরা তা হলে সাহিত্যিকের মর্যাদা পেতে পারে।

আমরা তো জেনে এসেছি যাঁরা গান বাঁধেন, সুর দেন, গানের মধ্যে দিয়ে সমাজ সচেতনতার কথা বলেন তাঁদের সাহিত্যে কোনও অবদান নেই। তিনিই সাহিত্যিক যিনি সোজা-সহজ বিষয়কে জটিল করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন। তিনি কখনও ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’, ‘টাইমস দে আর আ চেঞ্জিং’ গেয়ে সাধারণ মানুষকে কাঁদাতে পারবেন না। ডিলান পেরেছিলেন।

ওঁর গান শুনতে শুনতে মনে হয় ডিলানকে তৈরি করেছিল সময়? নাকি ডিলান সময়কে নিজের লিরিকে বেঁধে ফেলেছিলেন? ওঁর দাপুটে কলম বরাবরই হেঁটেছে উল্টো রাস্তায়। উনিশশো ছেষট্টি সালে বামপন্থীরা তো ডিলানকে বিশ্বাসঘাতকও বলেছিল।

আমেরিকার রক অ্যান্ড রোলের রাস্তা থেকেও সরে এসেছিলেন ডিলান। কিছুতেই খিদে মেটেনি তাঁর। আসলে তিনি তাঁর সেই গানের মতোই — ‘হোয়েন আই অ্যাম অ্যালোন উইথ ড্রিমস অব ইউ, দ্যাট ওন্ট কাম ট্রু’।

স্বপ্ন আসবে, কিন্তু পূর্ণ হবে না। প্রেম আছে, কিন্তু মানব না। যে লড়াইয়ে হার, সেটাই লড়ব। অযাত্রায় নৌকো ভাসিয়ে ফলের আশা না করেই তিনি গান দিয়ে লড়াই করেছেন।

ভোগবাদী সমাজ, বর্ণবৈষম্য, যুদ্ধ, সন্ত্রাস, সব কিছুর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে ডিলানের প্রতিবাদী স্বর। তাঁর গানের খাতায় বারবারই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উদযাপনের আগুন। আজ মনে হচ্ছে সেই উদযাপনের আগুন নোবেল কমিটিকেও ছুঁয়ে দিল। ভাবা যায়!

কবিতা, উপন্যাস, বা প্রবন্ধ নয়। গানের লিরিক কি সাহিত্যের উঠোনে সম্মান পেতে পারে? এটা ভাবতেই অনেক সময় লেগেছে নোবেল কমিটির। সাত বার মনোনীত হয় ডিলানের নাম।

আর আমাদের দেশ? হে মোর দুর্ভাগা দেশ!


বব ডিলান

ডিলানের নোবেল আসলে আমাকে যতটা খুশিতে ভরিয়ে দিয়েছে ঠিক ততটাই রাগিয়ে তুলছে।

নব্বইয়ের দশকে নতুন গানের ধারা নিয়ে লোকে পিএইচ ডি করে। রোজ কত ফোন আসে আমার কাছে। গান নিয়ে কথা বলতে হয়। সেই কথা শুনে লম্বা, লম্বা থিসিস লিখে লোকে ডক্টরেট ডিগ্রিও পেয়ে যায়। অথচ যাঁর বা যাঁদের গান নিয়ে করছে, ডক্টরেট তো দূর, তাঁদের মিনিমাম সম্মানও জোটে না। একজন লেখক আমার ‘ডাক্তার’ গান শুনে উপন্যাস লিখে ফেললেন। সেখান থেকে বাংলা ছবিও হল। অথচ আমার কোনও সম্মান জুটল না। এমনটাই হয়ে এসেছে। ওদের দেশে নোবেল না পেলে রবীন্দ্রনাথ তো পোস্টার লিখতেন! এমনই হাল। কম পিছনে লেগেছিলেন সজনীকান্ত দাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়!

রবীন্দ্রনাথ বিদেশিদের কাছ থেকে নোবেল না পেলে তাঁর কদর ক’জন দিতেন, তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। আজও আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথকে বোঝেন টেন পার্সেন্ট মানুষ। পাঁচটা পরপর কবিতা বলতে বলুন দেখবেন বেশির ভাগ লোক তোতলাচ্ছে। তবে নোবেল পাওয়া মানেই উনি বিশাল কেউ সেটা সবাই বুঝে ফেলেছে।

আমরা নাকি খুব সাধারণ মানুষের গান গাই। কোনও এক সময় জনৈক সাংবাদিক লিখেছিলেন আমার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শুনে অনেক ছেলেমেয়েই বাবা-মাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। ভাল কথা, আমি ‘পপুলার’। ব্যস ওই অবধি! এর বেশি কিছু জোটেনি।

মনে পড়ছে ছেলেবেলার কথা। বন্ধুরা মিলে লুকিয়ে সিগারেট খেতে খেতে শুনছি বব ডিলান, পল রবসন, পিট সিগার — চিনছি পৃথিবী। ‘হাউ ডাজ ইট ফিল/ হাউ ডাজ ইট ফিল/ টু বি উইদাউট আ হোম/ লাইক আ কমপ্লিট আননোন/ লাইক আ রোলিং স্টোন...

ডিলানের এই কথাগুলো শুনে মনে হয়েছে এত দিন যা দেখেছি, যা শুনেছি, তা জোর করে বোঝানো হয়েছে, তা বোধহয় সাজানো। ডিলান যেন গিটার হাতে অন্ধকার গলির রূঢ় বাস্তবটাকে সামনে এনে দিয়েছেন। তা হলে কি আলো পাওয়ার এটাই পথ?

নয়তো নর্দমায় মারা গেছেন যে কবি, তাঁকে নিয়ে কেউ গান বাঁধার কথা ভাবতে পারে! আসলে তিনি তাঁর গান ‘বিয়ন্ড দ্য হরাইজেন’-এর মতোই। এক ভিন্ জগতের কবি-গায়ক-গীতিকার-বাউল। ডিলানের এই নোবেল আমাকে রাগাচ্ছে, কাঁদাচ্ছে, ভাল লাগাচ্ছে, তেমনি একটা বিশ্বাসের কথাও বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।

আমার এখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে নোবেল-এ লিরিকের সম্মান লাভের পর আমাদের দেশেও পরিস্থিতি হয়তো একটু বদলাবে। এই যে আমাদের মতো অনেকেই যেমন দিনযাপনের গানকে প্রতিবাদের হাতিয়ার করে রাস্তায় নেমে পড়েন, তাঁরাও হয়তো এ বার কোনও তেলবাজি না করেই যোগ্য সম্মান পাবেন।

‘দাদাসাহেব ফালকে’ — ‘কলকে’ বা জাতীয় পুরস্কার সবই তো দেখলাম কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। চাইতে হবে তবে মিলবে।

ডিলানকে অবশ্য চাইতে-টাইতে হয়নি। আর সত্যি কথা বলতে এই জিপসি কবির তেজ কোনও পুরস্কারে আরও রক্তিম হয়ে উঠবে এমনটা আশা করাই ভুল।

তবে ডিলান যে দারুণ কণ্ঠশিল্পী তা কিন্তু নয়। তিনি কথা বেঁধেছিলেন সুরে। যে কথা আমাদের। রক অ্যান্ড রোল-এর রমরমায় তিনি গিটারে বাঁধলেন মাটির গান। শিকড়কে টেনে বার করলেন গান-পাড়ায়। খুব সুরে যদি গান গাইতে বসতেন তা হলে আমাদের মতো খেপা গাইয়েদের বুকে তাঁর গান এমন বাজত না।

আজও রাত্রিবেলা একা লাগলে ডিলানকে কাছে টেনে নিই। মন রাখি তাঁর রাতের গানে। ছায়ার গানে। যুদ্ধের গানে। এই ভোগবাদী শূন্য সমাজকে আজও বারবার ধাক্কা দিচ্ছেন ডুলুথের খনি অঞ্চল হিবিংয়ে বেড়ে ওঠা সেই কিশোর। আমরা বুঝছি তো?

ডিলান — আমাদের প্রজন্মের স্বপ্ন ছোঁয়া স্বর।

আজ যদি দেখতে পেতাম গুরু!!!

জড়িয়ে ধরতাম।

bob dylan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy