Advertisement
১৬ মে ২০২৪

শিল্পীরা কাঁকড়ার জাত

ছোটবেলায় যাকে ‘ঘুমপাড়ানি গান’ মনে হত কেন তাতে ফিরলেন? উত্তর খুঁজলেন সুমনা দাশগুপ্ত। শেষে আপনিও রবীন্দ্রনাথে ফিরলেন বাজার ধরতে? আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। প্রথাগত শিক্ষা নেই বলে একটু ভয় পাচ্ছিলাম।

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

শেষে আপনিও রবীন্দ্রনাথে ফিরলেন বাজার ধরতে?

আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। প্রথাগত শিক্ষা নেই বলে একটু ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের কাজ তো মানুষের আরও কাছাকাছি এসে গেছে। পপুলার ফিল্ম বা পপুলার টিভি প্রোগামের মধ্যে দিয়ে। তো সবটা মিলিয়ে মনে হল এবার চেষ্টা করা যেতে পারে। আর ছোটবেলায় ফিরে যেতে চাইছিলাম।

মানে?

ছোটবেলায় মা হারমোনিয়াম বাজাত আর আমি গাইতাম। … মায়ের কাছে শেখা একটা গান ‘প্রাণের ঠাকুর’ অ্যালবামেও আছে। ‘কেন তোমরা আমায় ডাক’।

মিউজিক অ্যালবামের তো বাজার নেই, তা হলে?

তা ঠিক। তবে কিছু কিছু কোম্পানি এখনও আছে যারা সিডি লঞ্চ করছে। আগে যারা পাঁচ হাজার বা তিনহাজার সিডি লঞ্চ করত, এখন তারা পাঁচশো সিডি লঞ্চ করছে। বাজার ছোট হয়ে গেছে।

প্রায় বছর দেড়েক হল আপনি তো পাবলিকের নজরে নেই। তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ কোথায়? কেন আপনার ইন্টারভিউ কেউ নেবে বলুন তো!

কাজ নেই বলতে ফিল্মের গান নেই। আর সবাই যা করছে, আমিও তাই করছি। তারা অনুষ্ঠান করছে। আমিও করছি।

৯০-এর দশক থেকে গানের ক্যারিয়র শুরু। ২৫ বছর হল। জার্নিটায় কী পাননি?

পাইনি বলাটা ঠিক হবে না। মানুষ আমায় চেনে। আমার গান ভালবাসে। তবে আমার আসা-যাওয়াটা বরাবর উল্টো স্রোতে। নব্বইয়ের দশকে তখন রিমেকের জোয়ার। আমি কিন্তু অ্যালবাম লঞ্চের দিকে এগোয়নি। ভেবেছিলাম নতুন গান করব, যাতে লোকের ড্রইং রুমে ঢুকে পড়তে পারি। ওইসময় দেবুদা-র (দেবজ্যোতি মিশ্র) সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তাঁর হাত ধরে তিন-চার বছর কাজের পর অন্যদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলাম।

কিন্তু ‘জিঙ্গল’ দিয়ে ড্রইং রুম ঢুকেই পড়েছিলেন…

হ্যাঁ। তবে বিজ্ঞাপনকে খুব হেয় চোখে দেখা হত। বলা হত ‘‘ও মেনস্ট্রিম সিঙ্গার নয়, জিঙ্গল গায়।’’ শ্রাবন্তীদি-র (শ্রাবন্তী মজুমদার) ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। আমার কনটেন্ডাররা সবাই তখন ‘গোল্ড ডিস্ক’ প্রাপ্ত সিঙ্গার। দু’-তিনটে ‘জিঙ্গল’ জনপ্রিয় হওয়ার পর আমি প্রথম সিরিয়ালের টাইটেল গাওয়ার ডাক পাই। প্লে ব্ল্যাকের সুযোগ পাই।

অন্যের গলায় নাকি ডাব করতে হয়েছিল?

হ্যাঁ। একটা গল্প বলি। স্বপন সাহা-র একটা ছবিতে গান ডাব করার কথা ছিল হরিহরনের। ডাব করার আগে আমি গানটা গেয়েছিলাম। আমার গলা শুনে বুম্বাদা( প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) আর স্বপনদা (স্বপন সাহা) জানতে চেয়েছিলেন গলাটা কার? দেবুদা-কে (দেবজ্যোতি মিশ্র) ওরা বলে ওই ছেলেটাকে দিয়ে গান গাওয়াতে। এরপর ওই ছবিতে আমিও একটা গান গাই। বরাবর কাজটা করে গেছি। গলার জন্য মানুষ আমায় ভালবাসে। আই হ্যাভ দ্যাট এক্সট্রা টিঞ্জ ইন মাই ভয়েস।

কলকাতার অনেকেই তো মুম্বইয়ে কাজ পাচ্ছে। আপনি?

কেরিয়ারের শুরুতে আমি মুম্বই যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। সেটা বিরানব্বই সাল। কিন্তু ওখানে গিয়ে তো সারভাইভ করতে হত। সারাদিন হোটেলে গান গেয়ে বেড়ানো আর প্রোডিউসারবাজি আমার দ্বারা হত না। তিরানব্বইয়ের প্রথম দিকে বাবা মুম্বইয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। যাব বলে সব ঠিকঠাক। এর পরেই বাবা মারা যান। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে চাপল। পৈতৃক ব্যবসার বিষয়টা ছিল। আমার আর মুম্বই যাওয়া হল না।

তারপর আর মনে হয়নি…

না। ধীরে ধীরে এখানকার জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আর মুম্বই গিয়ে তো শূন্য থেকে শুরু করতে হত। রিস্ক নিতে হত। এখানে তখন একটা বেসিক জায়গা পেয়ে গিয়েছিলাম।

রূপঙ্কর (রূপঙ্কর বাগচি) তো লুক বদলে ফেলেছেন? এত দিন ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন, চেঞ্জ করতে ইচ্ছে করে না ?

না। কারণ আমি ও সবে আমল দিই না। আর মনে করি স্টেজে উঠে কেমন গাইলাম, কী গাইলাম, সেটাই আসল।

লোপামুদ্রা মিত্র একবার আনন্দ plusকে বলেছিলেন এখানে গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে প্রচুর হিংসে…

কাঁকড়ার জাত তো আমরা। আমিও। কোন মহলে নেই বলুন তো! তবে হ্যাঁ, এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে একটা ‘বোনহোমি’ সম্পর্ক তৈরি হত। কম্পিটিশন থাকা ভাল। কিন্তু এখন খুব বাজে কম্পিটিশন চলছে।

এ বছর ভাষা দিবসে নজরুল মঞ্চে সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠান করলেন। আলটিমেটলি হলটা কী?

এটা আমার মাথার ক্যাড়া। একেবারেই প্যাশন থেকে করা। এর আগেও আমি একাধিক ইভেন্ট অ্যারেঞ্জ করেছি। ‘সৌহার্দ্য’ বলে একটা প্রোগাম করেছিলাম। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে। ‘এক সন্ধেয় সন্ধ্যা’। উত্তম কুমারকে নিয়ে ‘প্রিয় উত্তম’। আরও আছে। এগুলো করতে গিয়ে অনেক সময় পকেটের পয়সা চলে গেছে।

আর করবেন না?

ইচ্ছে আছে করার। ইভেন্ট কনসিভ করাই যায় কিন্তু অনেকগুলো বিযয় থাকে। স্পনসরের ব্যাপার থাকে।

গজল তো আপনার প্রিয়। বাংলায় শ্রোতা পান এখনও?

না। কোনও দিনই বাংলায় গজলের শ্রোতা পাইনি। আমি গুলাম আলির সঙ্গে শো করেছি কলামন্দিরে। পঙ্কজ উধাসের সঙ্গে শো করেছি। এঁদের সঙ্গে স্টেজ শেয়ার করেছি, কিন্তু সেগুলো সবই উত্তর ভারতে।

আপনি তো অন্যভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন। আচ্ছা, সোমলতার রবীন্দ্রসঙ্গীত কেমন লাগে?

না। আমি প্রথাগতভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছি। আর শুধু সোমলতা কেন? লোপাও তো করছে। যাঁরা পিওরলি রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রোতা, তাঁদের কেমন লাগবে জানি না। কিন্তু সোমলতার অ্যারেঞ্জমেন্ট আমার খুব ভাল লাগে।

রেডিয়োয় আপনার গান তো বাজে না?

রেডিয়োয় কার গান বাজে? কেন, কী বৃত্তান্ত আলোচনা করতে গেলে দু’রাত্তির লেগে যাবে।

অবসাদ আসেনি কখনও?

না। এটা খুব সাঙ্ঘাতিক জিনিস। আমি স্কোপ দিই না। নিজে কাজ করি। নিজের মতো থাকি। শো করি। কোথাও খুব একটা দেখা যায় না আমায়। আমি স্রোতে গা ভাসাতে পারি না।

নিজের মতো থাকেন তো বুঝলাম, কিন্তু গান তো পাবলিকের জন্য। কী ভাবে শ্রোতার কাছে পৌঁছন?

আমার পারফর্ম্যান্স হচ্ছে আমার ইউএসপি। স্টেজে আমি সব নিয়ে বসি। গজল, রবীন্দ্রনাথ, কিশোর কুমার, আর ডি বর্মন, রক অ্যান্ড রোল, সব শোনাতে পারব পর পর।

তৃণমূলে গাইলেন কেন?

ওরা বলল তাই গাইলাম। এর সঙ্গে মতাদর্শের কোনও সম্পর্ক নেই। অন্য দল বললেও গাইতাম। এটা তো বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে তো আমি আগেও গেয়েছি।

ঢোলা পাঞ্জাবি, মাথায় ফেট্টির বাইরে অন্য পোশাক ট্রাই করেননি?

জানেন, বাড়িতে সারাক্ষণ এ জন্য আমায় গালাগালি করে। কিন্তু আমি এ সব নিয়ে ভাবি না। দিনের শেষে মানুষ মানুষকে চিনবে তার ব্যবহার আর কাজ দিয়ে। কী খেলাম, পরলাম তা দিয়ে নয়। আর সব কিছুর শেষে ভাল মনের মানুষ হওয়াটা খুব জরুরি।

এমন কিছু করতে ইচ্ছে করে যা আগে করেননি?

এখন আর করে না। আমি সাঙ্ঘাতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী নই। সব কিছু অ্যাচিভ করার একটা সময় থাকে। দিনের শেষে বাড়ির রান্নাঘরটা চালাতে হবে। এমন রিস্ক নিলাম যে লাইফটা শেষ হয়ে গেল। সে গোত্রে আমি পড়ি না। মুম্বই যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। হয়নি। আবার রবি ঠাকুরের গান নিয়ে সিডি করার ইচ্ছা ছিল। সেটা হয়ে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pratik Chowdhury interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE