Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাসের কণ্ঠস্বর শুনিয়েছেন ঋত্বিক

ধর্মীয় বাতাবরণকে রেখে ঋত্বিক আধুনিক মানুষকে বিচার করেছেন, এটাই তাঁর কৃতিত্ব। এমন এক নারীর ছবি আঁকলেন তিনি যিনি সর্বকালের মুহূর্তগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশ্লেষণে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়ধর্মীয় বাতাবরণকে রেখে ঋত্বিক আধুনিক মানুষকে বিচার করেছেন, এটাই তাঁর কৃতিত্ব। এমন এক নারীর ছবি আঁকলেন তিনি যিনি সর্বকালের মুহূর্তগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশ্লেষণে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত

ঋত্বিক ঘটক। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

ঋত্বিক ঘটক। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ১২:০০
Share: Save:

ঋত্বিক ঘটককে অন্য ভাবে দেখার সময় হয়েছে এ বার। এত দিন আমরা ঋত্বিককে উদ্বাস্তু জীবনের ব্যাখ্যাকার হিসেবে, দেশবিভাগের মনন ঘেরা সমাজসচেতন চলচ্চিত্রকার হিসেবে জেনে এসেছি। কিন্তু আজকের প্রজন্মের কাছে এই দেশভাগের নস্ট্যালজিয়া বলে আদৌ কিছু আছে বলে তো আমার মনে হয় না। তা হলে কী ভাবে দেখব আমরা ঋত্বিককে?

ঋত্বিকের ছবি চিনিয়ে দেবে সেই অজানা ঋত্বিককে। টেলিফটো লেন্সে যদি আমরা ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতাকে দেখি তা হলে দেখব ঋত্বিক একই সঙ্গে দু’টো গল্প বলছেন। ‘দাদা আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম’ এই সংলাপ যেমন বাস্তবের নীতা চক্রবর্তীকে প্রকাশ করছে আবার একই সঙ্গে তা কুমারসম্ভবকেও দর্শকদের ভাবনায় মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমরা ভাবতে অভ্যস্ত নীতার মৃত্যু যক্ষ্মা রোগে হয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে যক্ষ্মায় মৃত্যুর মধ্যে বাস্তবতা কোথায়? তবে? ঋত্বিকের আকাশপথের ক্যানভাস নিশ্চয়ই আমাদের কিছু জানাতে চায়।

ছবির দৃশ্যে নীতা বসে আছে, তার হাতে একটি চিঠি, তার প্রেমের একমাত্র স্বীকৃতিপত্র। ছবিতে ক্রমশ নীতাও বুঝতে পারে তাকে আত্মত্যাগের একটি প্রতিমূর্তি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সকলকে ভাল রাখার ভার যেন তারই কাঁধে, যা পুরুষতন্ত্রের একটি ট্র্যাপ। নীতার এই মন তার জীবনকে দেখতে চাওয়ায় এক ধরনের শূন্যতার জন্ম দেয়। মনের গভীর উদ্বেগ থেকে জাত একটা যন্ত্রণা জন্ম দেয় ফিমেল হিস্টেরিয়ার। যক্ষ্মা নয়, ফিমেল হিস্টেরিয়ার স্বীকার হয়ে নীতা মিলিয়ে যায়। নীতার বাবা, দাদা বা সনৎ(নীতার প্রেমিক) যে যার জীবনে ব্যস্ত। নীতা একা! নীতার ভাবারও কোনও জায়গা আর নেই! সে কেবল রিক্তই নয়, তার দাঁড়াবারও কোনও পথ সে দেখতে পায় না... সে জানে না এত কামনা, এত বাসনা কোন পথে মেশে! নীতা শূন্যে ফেরে... এই সময়টাকেই যেন বলা যায় অবদমনের ফিরে আসা বা রিটার্ন অফ দ্য ডিপ্রেসড্।


‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা

নীতাকে দিয়ে ঋত্বিক যে বয়ান তৈরি করতে চাইলেন তখন ভারতবর্ষে এ নিয়ে কেউ ভাবত না। নীতার পাপ কী? সে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না। নীতা কি তবে উপনিষদের সেই গার্গী? যাকে যাজ্ঞবল্ক ধমকে কোনও প্রশ্ন না করে চুপ করে থাকতে বলেছিলেন? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের দ্রষ্টব্য হওয়াই যেন একমাত্র কাজ। অথচ, নীতা সে পথে তো হাঁটেনি! উল্টে নিজেকে অদৃশ্য রেখে সে দেখার আলোয় ভেসে যেতে জানে। এই স্বেচ্ছায় ভাসা তো পুরুষের অধিকার। ছবির একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই একটা বেড়ার ফাঁক থেকে বাইরের পৃথিবীকে দেখে নীতা, অথচ দর্শক তাকে দেখতে পায় না। নিজে থেকে সে একটা নিজের পৃথিবী তৈরি করে নিতে জানে। কোথাও একটা নিয়ন্ত্রকের জায়গায় সে নিজেকে নিয়ে গিয়েছে! যার ফলে পুরুষতন্ত্র তাকে শাস্তি দিয়েছে। এই শাস্তি এসেছে যক্ষ্মা রোগের হাত ধরে। যক্ষ্মা এমন একটা অসুখ যা নারীকে ক্রমশ অব্যবহার্য করে তোলে। নীতা নিজেই ছবিতে বলছে, ‘যা ডোম কাকের মতো চেহারা হয়েছে’। এক জন নারীকে জব্দ করার জন্য তার শরীরকে যদি যৌনতা বর্জিত করে দেওয়া যায় তার চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? ছবিতে নীতার মৃত্যুকে সরাসরি আমরা দেখি না। দেখি ক্যামেরা ঘুরছে পাহাড়, ঝর্না, অরণ্যের সুর নিয়ে। এই অরণ্য, ঝর্না, পাহাড়িয়া অঞ্চল প্রত্যেকটাই কিন্তু যৌনতার প্রতীক, বাসনার প্রতীক। নীতা সেই বাসনাকে স্বীকার করে দেবী থেকে মানবীতে পদার্পণ করে বাঁচতে চায়।

নীতা কোথায় যায়? অদৃশ্য হয়ে যায়! আমাদের ধর্মীয় ব্যবস্থায় কে বা কারা অদৃশ্য হয়ে যায়? চলে যায়? এই যে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর পরে চলে যাওয়া, এই চার দিনের জীবন নাট্য, আসলে তাকে কুমারসম্ভবের রেফারেন্সে ধরা যায়। ছবিতে নীতার জন্ম জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন। তাকে টেলিফটো লেন্সে রাখাও হয় হিমালয় কন্যা হিসেবে। সে এক দিকে যেমন জগজ্জননীর অংশ, অন্য দিকে আজাদগড়ের উদ্বাস্তু কলোনির এম এ সেকেন্ড ইয়ার ড্রপ আউট এক মেয়ে। কুমারসম্ভবের প্রেক্ষাপটে নীতার জীবন দিয়ে ঋত্বিক বুঝিয়ে দিতে চাইলেন শংকর আর পার্বতীর মিলন পুরাণে সম্ভব, তা আজ আর সম্ভব নয়। ধর্মীয় বাতাবরণকে রেখে ঋত্বিক আধুনিক মানুষকে বিচার করেছেন, এটাই তাঁর কৃতিত্ব। এমন এক নারীর ছবি আঁকলেন তিনি যিনি সর্বকালের মুহূর্তগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেন।

ধরা যাক ‘সুবর্ণরেখা’। ঋত্বিকের চরিত্রের নামগুলো সব মিথিক্যাল। সীতা, ঈশ্বর, কৌশল্যা। ছবির শেষ মুহূর্তে ঈশ্বর চক্রব্র্তী বেশ্যালয়ে তাঁর বোন সীতার ঘরে প্রবেশ করে। সীতা আত্মহত্যা করে। এই আত্মহত্যা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু আত্মহত্যার পরেই ছবিতে একটা স্বর শোনা যায়— ‘হে রাম’। কে বলেছিল এই কথা? মৃত সীতা বলতে পারে না এই কথা। পুরুষ হিসেবে ঈশ্বর চক্রবর্তী বা দালালও বলেনি এই কথা। এটা ইতিহাসের কণ্ঠস্বর। ঋত্বিকের ছবিতে যেন আমাদের নাড়া দিয়ে যায়। বলে যায়, রামচন্দ্র একদা অগ্নিপরীক্ষার নামে যে অন্যায় কাজটি করেছিলেন সেটা আজও হয়ে যাচ্ছে। ঈশ্বর আজও সীতার ঘরে ঢোকার ফলে সীতাকে সতীত্বের চরম পরীক্ষা দিয়ে যেতে হচ্ছে। ঋত্বিক একইসঙ্গে পুরাণ আর বর্তমানকে ব্যাখ্যা করছেন।

এই পুরাণ আর বর্তমানকে মিশিয়ে দেখাতে ঋত্বিকের ছবিতে শব্দ নিয়ে ঘটে গিয়েছে নিঃশব্দ বিপ্লব। যেমন, ‘যুক্তি তক্ক গপ্প’ ছবিতে নচিকেতা আর বঙ্গবালার মিলন যদি দেখি, সেখানে দেখব শারীরিক মিলনে শরীরের কোনও স্পর্শই নেই, কেবল গাছের মাঝে ঘন শ্বাসাঘাতকে ব্যবহার করা হয়েছে মিলন চেনাতে। আর কাদের মিলন? ‘নচিকেতা’, যা একমাত্র ভারতীয় চরিত্র যে যমলোক থেকে ফিরতে পেরেছে, আর ‘বঙ্গবালা’ যা বাঙালির আইকন। তাদের মিলনে খোলা পিঠ, চুল কিছুই দেখানো হয়নি! অথচ আমরা জানি, বাংলা ছবির যৌন দৃশ্য মানেই তো শরীরের নানা খোলা অংশ।

সত্যজিত্ রায় মনে করতেন ভারতীয় সঙ্গীত ভারতীয় সিনেমার জন্য উপযুক্ত নয়। তাতে নাটকীয় উপাদান আনা যায় না। বরং পশ্চিমের বিটোফেন বা মোৎজার্টের সঙ্গীত ছবিকে সমৃদ্ধ করে। ঋত্বিক ঘটক এ মতের পক্ষে ছিলেন না। তিনি পশ্চিমের গোদারের মতো ছবিতে দৃশ্য আর শব্দকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-তে হংসধ্বনিকে যে ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য! রাগ হংসধ্বনি যেন আলপনার মতো পুরো ছবিটাতে ছেয়ে আছে। ঋত্বিকের এই চেষ্টাগুলোর দিকে আমরা খেয়াল করিনি।


‘মেঘে ঢাকা তারা’য় অনিল চট্টোপাধ্যায় এবং সুপ্রিয়াদেবী

আমরা বলেছি ঋত্বিক রবীন্দ্র ভক্ত হলেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সে ভাবে কিছু করেননি। এটা ভুল! ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’ আসলে রবীন্দ্রনাথের একটা অসমাপ্ত প্রকল্প। এটা তো আমরা এড়িয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬-২৭ যখন জার্মানিতে ছিলেন তখন তাঁকে প্যাশন প্লে লিখতে বলা হয়। তিনি কাজে হাত দিয়েও শেষ করেননি। অথচ সেই সূত্রেই ‘চাইল্ড’ বা ‘শিশুতীর্থ’ তৈরি হয়। এই ‘শিশুতীর্থ’কে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখা করার চেষ্টাই তো সুবর্ণরেখায় দেখা যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাত কত হইল?’ এটা আসলে ঋত্বিকের ‘রাত কত হল’ই তো! ছবি শেষও হয় ‘জয় নবজাতকের চিরজীবিতের’ দিয়ে। শতবর্ষ পরে ঋত্বিক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপে মিলিত হন।

ঋত্বিক কিন্তু বাস্তবের পুনর্নির্মাণ চেয়েছেন। অনেক শিল্পই তাই করে। শব্দের ক্ষেত্রে, পুরাণ সংযোজনের ক্ষেত্রে তার প্রকাশ ঘটেছে। পুরাণ সংযোজন কোনও হিন্দু পুনরুত্থান নয়! আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাহিনি পরম্পরাকে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে রেখে তাঁকে পরীক্ষা করেছেন ঋত্বিক, বা ওঁর যা কাজ এক ধরনের নাশকতার জন্ম দেওয়া সেটাই দিয়েছেন।

লুইস বুনুয়েল, ফেদরিকো ফেলিনি, গোদার এই কাজই যখন করেন তখন আমরা তার প্রশংসা করি। ঋত্বিকের দুর্ভাগ্য যে তিনি বাঙালি ছিলেন, ফলে তাঁকে আমরা ভুলে থাকি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE