কোথা থেকে যে শুরু করি! বাবা নেই? না কি বাবা আছেন?
রাশিদ খান আমাদের কাছে ভীষণ ভাবে আছেন। ‘নেই’ হয়ে যাননি। থাকার জায়গাটা বদলেছেন, এই মাত্র। বাবাকে নিয়ে বলতে গেলে আমরা তিন ভাই-বোন কখনও ‘করতেন’, ‘খেতেন’ শব্দগুলো ব্যবহার করি না। বাবার জন্মদিনও প্রতি বছরের মতো এ বছরেও পালন করছি। বাবা দুর্দান্ত বিরিয়ানি রাঁধতেন। ও রকম বিরিয়ানি নামজাদা শেফেরাও রাঁধতে পারেন না। বাবার সেই বিশেষ রেসিপি দিয়ে আজ ওঁর জন্য বিরিয়ানি, শম্মি কাবাব রান্না হচ্ছে। বাবার বন্ধুরা আসবেন। সকলে মিলে বাবার কথা বলব। বাবা আবার ‘নেই’ কই?
গায়ক রাশিদ খান বাস্তবে কী যে ছেলেমানুষ, অভিমানী! আইস কেক পেলে গোটাই একা খেয়ে ফেলতেন। প্রত্যেক বছর রাত ১২টায় বাবা আমাদের নিয়ে কেক কাটতেন। কেউ যদি আইসক্রিম কেক উপহার দিতেন, বাবাকে আটকায় কে! কেক কেটে প্রথম টুকরো, দ্বিতীয় টুকরো খাওয়ার পর পুরোটাই নিজে খেয়ে ফেলতেন! আমরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, ‘একটা নতুন কেক কিনে নিয়ে এসো। ওটা তোমাদের জন্য!’
বাবাকে নিয়ে বলতে বসলে গল্প ফুরোয় না! শিল্পী বাবা। এই মুহূর্তে খুশিতে ডগমগ করছেন, হঠাৎই আবার রেগে গেলেন! দুষ্টুমি করলে তো কথাই নেই। সে সব বিষয়ে ভীষণ কড়া। কিন্তু চট করে সন্তানদের গায়ে হাত তুলতেন না। আবার পক্ষপাতিত্বের বেলায় বাবা সারা ক্ষণ দুই দিদির হয়ে কথা বলছেন। দিদিদের কিছু করলেই বাবার ধমক, ‘কেন ওদের গায়ে হাত তুলছিস!’ অথচ, দিদিরাও যে আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করেছে, আমার সে নালিশ কোথায় ভেসে যেত। ‘বাবা’ রাশিদ খানকে নিয়ে একটা মজার গল্প বলি। সাধারণত, অভিভাবকদের সঙ্গে স্কুলশিক্ষকদের বৈঠকে মা-ই যেতেন। একবার মায়ের কোনও কাজ থাকায় বাবা গিয়েছেন আমার সঙ্গে। টেবিলের ও পারে বসে থাকা শিক্ষিকা তো আনন্দে আত্মহারা। তিনি শিল্পী রাশিদ খানের সঙ্গে কথা বলছেন! প্রচুর আড্ডা হল। শেষে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার ছেলে কেমন পড়াশোনা করছে?’ শিক্ষিকা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ও তো মাত্র তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। এখনই পড়াশোনা নিয়ে ভাবার কিছু নেই।’ এই হচ্ছে শিল্পী বাবা।
এ বার বলি ‘ব্যক্তি’ রাশিদ খানের অভিমানের কথা। বাবার যত অনুযোগ, সব মাকে ঘিরে! সপ্তাহের পর সপ্তাহ কথা বন্ধ। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘তোদের মাকে জিজ্ঞাসা কর।’ মাকে বললে বলত, ‘তোদের বাবার কাছে জানতে চাইতে পারছিস না!’
আমরা শেষে হাত তুলে দিতাম। এই বাবা-ই আবার মায়ের ধর্মকে কী প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে। নিজের ধর্ম নিয়ে কোনও দিন মাথাব্যথা ছিল না। নিয়মিত কোরান পড়তে দেখিনি। বছরে দু’বার ইদের সময় মসজিদে যেতেন, নমাজ পড়তেন। আমার মা হিন্দু বলে তিনিই ঠাকুরঘর বানিয়ে দিয়েছেন। সেখানে নিয়মিত পুজো হয়। বাবা রোজ বাড়ি ফিরে হাত-পা ধুয়ে ওই মন্দিরে আগে জোড়হাতে দাঁড়াতেন। তার পর বাড়ির ভিতরে পা রাখতেন।
আরও পড়ুন:
অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন, তা হলে মা-বাবাকে নিয়ে, পারিবারিক কলহ নিয়ে এত গুঞ্জন কেন?
বিষয়টা আমরাও ভাবি। এক এক সময় মনে হয়, ভিন্ধর্মের দুই মানুষ সুখে এক ছাদের নীচে। অনেকেই সেটা হয়তো মন থেকে মেনে নিতে পারতেন না। সেই কারণেই হয়তো বাবার পারিবারিক জীবন নিয়ে এত গুঞ্জন। তবু বলব, ভাল-মন্দে গড়া এই বাবাকে আমি আগামী জন্মেও চাই। হ্যাঁ, রাশিদ খানের ছেলে হওয়ার চাপ থাকা সত্ত্বেও।
বাবার ঐতিহ্য সম্মানের সঙ্গে বহন করতে হবে। ‘বাবার মতো বড় মাপের শিল্পী হতে হবে’— এই আলোচনা সারা ক্ষণ হয়। কানেও আসে। কিন্তু মাথা ঘামাই না। আমি তো জানি, আর একজন রাশিদ খান হওয়া অসম্ভব।
জন্মদিনে আনন্দবাজার ডট কম মারফত বাবাকে সেই বার্তাই দেব। বাবা, তুমি আরও একবার ‘আমার বাবা’ হয়ে ফিরো। আমি আবার তোমার ছেলে হব । এ বারের মতোই দুষ্টু ছেলে, যাকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে জোরে বকে উঠবে। তোমার বকুনি না শুনলে আমি যে মানুষ হয়ে উঠতে পারব না বাবা!