Advertisement
E-Paper

জীবন-মরণের আলোছায়ায়

ছবির শীর্ষনাম আর এই ভূমিকাটুকু পড়লে মনে হবে, এ যেন আলিফার সহজ পাঠের গপ্পো। তা পুরোপুরি ভুল নয়। দীপ চৌধুরীর প্রথম বাংলা ছবি ‘আলিফা’র ক্যানভাস রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, সমসাময়িক।

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৩১

নরকাসুর পাহাড়ে আলিফার একচালা বাড়ি। আলি ও ফতিমার মেয়ে, ফৈজলের দিদি আলিফা। পাহাড়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে তার কল্পনাবিলাসী ডাগর চোখদুটো জরিপ করে নীচের না-দেখা শহরটাকে। আব্বার মনভোলানো তারাদের গল্পে তার অনুসন্ধানী মন তৃপ্ত হয় না। আব্বা-আম্মার মরচে পড়া সম্পর্কের তিক্ততায় তার অনভিজ্ঞ চোখ খোঁজে কে ঠিক, কে ভুল। আলিফার বয়স বেশি নয়। হবে হয়তো বছর বারো।

ছবির শীর্ষনাম আর এই ভূমিকাটুকু পড়লে মনে হবে, এ যেন আলিফার সহজ পাঠের গপ্পো। তা পুরোপুরি ভুল নয়। দীপ চৌধুরীর প্রথম বাংলা ছবি ‘আলিফা’র ক্যানভাস রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, সমসাময়িক। মানুষ ও প্রকৃতির চিরন্তন দ্বন্দ্ব, শহর-গ্রামের টানাপড়েন, দুর্বিনীত বন আধিকারিকের শোষণ-নিপীড়ন... বৃহত্তর এই মানচিত্রের নিউক্লিয়াস আলিফা ও তার পরিবার। বাবার কর্মহীনতা, মায়ের বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, বাবা-মায়ের জ্বলতে থাকা সম্পর্কের আঁচে পুঞ্জীভূত অভাব-অভিযোগের পাহাড় আর স্কুলে পড়ার এক চিলতে স্বপ্ন... আলিফার আকাশে মেঘপিয়নের আহ্লাদ নেই। বরং আগন্তুকের মতো শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকে মৃত্যু।

সমাজের খেটে খাওয়া নিচুতলার মানুষের বাঁচা-মরার রোজনামচা সেলুলয়েডে নতুন নয়। নিষ্পাপ চোখে রূঢ় বাস্তবের কাদামাখা রং বাংলা ছবি আগেও দেখেছে, হালফিলও দেখেছে। তবে পরিচালক দীপের কৃতিত্ব, সেই চেনাজানা গল্পকেই উত্তর-পূর্বের ভৌগোলিক মানচিত্রে দাঁড়় করানোয়। তার সঙ্গে বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব সংকটের মতো গুরুতর সমস্যাকে জুড়ে দেওয়ায়। আর সেই প্লটে মানুষের মৌলিক চাহিদা, সাধ-সাধ্যের দ্বন্দ্বকে আবেগের সুতোয় বেঁধে দেওয়ায়।

ছবির বিষয়বস্তুর জন্যই বোধহয় প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন দীপ। গল্পটিও তাঁর লেখা। তবে নিমার্ণশৈলী ত্রুটিমুক্ত নয়। কয়েকটি দৃশ্য অনাবশ্যক মন্থর। দ্বিতীয়ার্ধে আব্বা-আম্মার ঝগড়ায় আলিফা যেন হারিয়ে যায়। তবে ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে আলিফার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার পরিচালকের সুচিন্তিত পরিকল্পনাও হতে পারে।

আলিফার বাবার চরিত্রে বাহারুল ইসলাম ও মায়ের চরিত্রে জয়া শীল অনবদ্য। থিয়েটার শিল্পী বাহারুলের এটি প্রথম ছবি। তবে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। জয়া ও বাহারুলের রাগ-ক্ষোভ, হাসি-কান্না, আর্তি-চিৎকারের শরীরী ভাষা ও অভিব্যক্তি চেনা চরিত্রেও নতুন তাৎপর্য যোগ করেছে। আলিফার চরিত্রে পাকিজা হাসমিও মন্দ নয়। তার চোখের সারল্য ছবির প্রেক্ষাপটে যথোপযোগী। আলির বন্ধু সইফুদ্দিনের চরিত্রে সত্য রঞ্জনও মানানসই।

নাহিদ আহমেদের ক্যামেরার কাজ অসামান্য নয়। তবে কয়েকটি ফ্রেম মনে রাখার মতো। তার মধ্যে অবশ্যই ছবির শেষ দৃশ্যটি। তূণভর্তি তির নিয়ে আলিফার ভাই ফৈজল হেঁটে চলে জঙ্গলের পথে। বড় বড় ঘাসের ভিড়ে তার ছোট্ট দেহ ঢাকা পড়লেও দিদি-হারানো ভাইয়ের দৃঢ়চেতা মনোভাবকে হারানো সহজ নয়। তেমনই দাগ কাটে আলিফার শূন্য দোলনাকে জড়িয়ে অসহায় আলির মাটিতে লুটিয়ে পড়া কান্না।

সাহিত্যের সোনার জুটি অপু-দুর্গার প্রতিচ্ছবি আলিফা ও ফৈজলের মধ্যেও মেলে। কারণ তাদের সামাজিক অবস্থানে সাদৃশ্য। আলিফা একটি রূপকও বটে। সচ্ছল হোক বা অসচ্ছল... সব পরিবারেই বেঁচে থাকে আলিফা, স্বপ্নের আশকারা। অপ্রত্যাশিত বাস্তবের কুঠারাঘাতে যারা খসে পড়ে। ঠিক তারা খসার মতোই।

আলিফা

পরিচালনা: দীপ চৌধুরী

অভিনয়: জয়া শীল, বাহারুল ইসলাম,
পাকিজা হাসমি

৬/১০

Alifa Bengali Film national award winning film Deep Chowdhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy