Advertisement
E-Paper

রবি ঘোষের হাস্যরস, শর্মিলার রহস্যময়তা, কানের ‘দিনরাত্রি’তে মুগ্ধ অ্যান্ডারসন

কান চলচ্চিত্রোৎসবে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র প্রদর্শন নিয়ে আনন্দবাজার ডট কমে লিখলেন পরিচালক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়।

বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৫ ১৪:২৭
Director Bauddhayan Mukherji shares experience on special screening of Satyajit Ray’s movie ‘Aranyer Din Ratri’ at the Cannes Film Festival

সোমবার সন্ধ্যায় কান চলচ্চিত্রোৎসবে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র প্রদর্শনে ওয়েস অ্যান্ডারসন, শর্মিলা ঠাকুর, সিমি গারেওয়াল। ছবি: সংগৃহীত।

করুণ মুখে মোনা প্রশ্ন করল, “কানে এসে আমরা অরণ্যের দিনরাত্রি না দেখে ফিরে যাব?”

এই প্রশ্নের একটা ছোট্ট নেপথ্য কাহিনি রয়েছে। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমা দেখতে গেলে আগে থেকে টিকিট বুক করতে হয়। রোজ সকাল সাতটায় উঠে ‘ফাস্টেস্ট ফিঙ্গারস ফার্স্ট’ খেলতে হয় কানের অনলাইন টিকিট সাইটে। চার দিন পরে টিকিট পাওয়া যায়। প্রতিদিন সকাল ৬.৫৮-য় শুরু হয় কাউন্টডাউন। ৭টায় খোলে বুকিং সাইট।

প্রতিদিন সকালে আমাদের বুলেভার্ড কার্নোর বাড়ি যেন হয়ে ওঠে শ্রীহরিকোটা। বুক ঢিব ঢিব করে, যে ছবি দেখতে চাইছি সেটা দেখতে পাব কি না এই নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ে। ঠিক ৭টার পর বড়জোর দু’মিনিট। তার মধ্যেই সব টিকিট শেষ।

Director Bauddhayan Mukherji shares experience on special screening of Satyajit Ray’s movie ‘Aranyer Din Ratri’ at the Cannes Film Festival

কান চলচ্চিত্রোৎসবে ‘অরণ্য়ের দিনরাত্রি’র পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।

১৯ মে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র টিকিট বুক করতে আমরা ১৫ মে সকালে অ্যালার্ম দিয়ে উঠলাম। কিন্তু মোনা টিকিট বুক করার আগেই সব টিকিট শেষ। করুণ মুখে মোনা প্রশ্ন করল এসে, “অরণ্যের দিনরাত্রি না দেখে ফিরে যাব?”

ফোন করলাম শিবেন্দ্রকে। শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুর ‘ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর কর্ণধার। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’কে নবরূপে বিশ্বের সামনে আনার নেপথ্যে এই মানুষটির অবদান অনেক। শিবেন্দ্র সত্যিই অদ্ভুত এক মানুষ। নিঃসন্তান। ঠিক করেছেন জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে যাবেন সিনেমাকে। সেই সূত্র ধরেই সৃষ্টি ‘ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর। ২০১২ সালে মার্টিন স্করসেসি ঠিক করেন, উদয়শঙ্করের ‘কল্পনা’ ডিজ়িটাল রেস্টোরেশন বা পুনরুদ্ধার করবেন। কিন্তু কিছুতেই আসল নেগেটিভের নাগাল পাচ্ছিলেন না। নাজেহাল হয়ে শিবেন্দ্রকে ফোন করেন। ‘কল্পনা’র নেগেটিভ উদ্ধারের প্রক্রিয়া নাড়িয়ে দেয় শিবেন্দ্রকে। ঠিক করেন, বিজ্ঞাপন বানানো ছেড়ে, রাজস্থানে নিজের ভিটে দুঙ্গারপুরের যাবতীয় ‘ঐতিহ্য’ ভাইয়ের হাতে সঁপে বাকি জীবন পৃথিবীর দৃশ্য-শ্রাব্য ঐতিহ্যকে রক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। সে দিন থেকেই পুরনো ছবির নেগেটিভ পুনরুদ্ধার করে তাকে ডিজ়িটাল রেস্টোরেশন করে, স্রষ্টার কাজকে অমরত্ব দেওয়ার পণ করেন। শিবেন্দ্র ও তার ‘ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর রেস্টোরেশনের তালিকায় নতুন সংযোজন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’।

Director Bauddhayan Mukherji shares experience on special screening of Satyajit Ray’s movie ‘Aranyer Din Ratri’ at the Cannes Film Festival

বুনুয়েল থিয়েটারে শুরু হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র প্রদর্শন। ছবি: বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে

এই পুনরুদ্ধারের নেপথ্যে এক নিরলস প্রচেষ্টার কাহিনি রয়েছে। ২০২০ সালে কোভিড লকডাউনের মধ্যে শিবেন্দ্র কলকাতায় যান। দেখা করেন প্রযোজক পূর্ণিমা দত্তের সঙ্গে। পূর্ণিমাদেবীর কাছে রাখা আসল ক্যামেরা আর সাউন্ড নেগেটিভ পাঠানো হয় ইতালির বোলোনা শহরে— ‘লা ইমাজ়িনে রিট্রোভেটা’য়। এখানে হাই রেজ়োলিউশন স্ক্যানিং করা হয়। তার পর শুরু হয় ফোর-কে ডিজ়িটাল রেস্টোরেশন। নেগেটিভের উপর জমা ধুলো-ময়লা, দাগ পরিষ্কার করা হয়। ছবিকে ‘স্টেবিলাইজ়’ করা হয়। ‘ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট’-এর সংগ্রহশালায় রাখা ম্যাগনেটিক ট্র্যাকের সাহায্যে ছবিটার ২ নম্বর রিলের বেশ খানিকটা মেরামত করা হয়। এই কাজে শিবেন্দ্রকে সাহায্য করেন সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়। লক্ষ রাখা হয়, যাতে সত্যজিতের নির্মাণ থেকে এক বর্ণও বিচ্যুতি না ঘটে।

১৯ মে ২০২৫, সোমবার, প্যালের বুনুয়েল থিয়েটার। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা বেজে ৪৫ মিনিটে ৫৫ বছর আগে তৈরি এক বাংলা ছবি দেখতে হাজির আমি, এই প্রজন্মের এক বাঙালি পরিচালক। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ যখন তৈরি হয় তখন আমার জন্ম হয়নি। কিন্তু ছবিটা আমি দেখেছি একাধিক বার। সিনেমা বুঝতে শেখার আগেই দেখে ফেলেছি, বুঝতে শিখে আবার দেখেছি।

Director Bauddhayan Mukherji shares experience on special screening of Satyajit Ray’s movie ‘Aranyer Din Ratri’ at the Cannes Film Festival

ছবির মূল পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।

কানের প্রেক্ষাগৃহে তিলধারণের জায়গা ছিল না। দর্শকাসনে বিশ্ববন্দিত পরিচালক আলেহান্দ্র ইনারিত্তু আর প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক দারিয়াস খোন্দজি। সঙ্গে আমাদের রিমা দাস, তিলোত্তমা সোম ছিলেন। রাত ৮টা নাগাদ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপস্থাপন করতে মঞ্চে এলেন ‘ফিল্ম ফাউন্ডেশন’-এর বোর্ড সদস্য এবং স্বঘোষিত সত্যজিৎ-ভক্ত ওয়েস অ্যান্ডারসন। চার পাতার ভূমিকা লিখে এনেছিলেন, পড়ে শোনালেন। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’কে ‘সাইকোলজিক্যাল মিডসামার নাইট স্পেল’ বলে আখ্যা দিলেন তিনি। বললেন, ‘‘এই সিনেমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। আমি আজ সিনেমার একজন ভক্ত হিসাবে কথা বলছি। এই ছবিটি আমি প্রথম দেখেছিলাম ২৫ বছর আগে, নিউ জার্সির এক বলিউড সিনেমার দোকান থেকে আনা ঝাপসা নকল ডিভিডি-তে।’’ স্বীকার করলেন ‘মেমরি গেম’-এর দৃশ্যটি তিনি নিজের একটি ছবিতে (অ্যাস্টেরয়েড সিটি) নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন। ওয়েসের পাশে তখন অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর এবং সিমি গারেওয়াল। রয়েছেন ‘দ্য ফিল্ম ফাউন্ডেশন’-এর এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর মার্গারেট বড্ডে। ছিলেন শিবেন্দ্রও।

ছবি দেখানো শুরু হল স্থানীয় সময় রাত ৮টা ১৩ মিনিটে। তার পরের ১১৫ মিনিট শুধুই মুগ্ধতার, গর্বের, আনন্দের। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ শ্রেণি সচেতনতা, বাঙালি পুরুষের স্বার্থপরতা, ষাটের দশকে নরনারীর সম্পর্ক, আদিবাসীদের প্রতি শহুরে মানুষের উন্নাসিকতা— বিভিন্ন দিক উঠে আসে। রবি ঘোষের অনবদ্য হাস্যরসে মাঝেমাঝেই উদ্বেলিত প্রেক্ষাগৃহ। চার বন্ধুর পারস্পরিক সম্পর্ক, শর্মিলা ঠাকুরের ব্যক্তিত্বের রহস্যময়তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন দর্শকেরা। তাঁরা পেলেন ঝকঝকে ছবি, ৫.১ মিক্স, নতুন করে লেখা সাবটাইটেল— সব কিছু ঠিক তেমনই, যেমনটি বোধহয় চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।

Director Bauddhayan Mukherji shares experience on special screening of Satyajit Ray’s movie ‘Aranyer Din Ratri’ at the Cannes Film Festival

শমিত ভঞ্জ ও সিমি গারেওয়ালের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করছেন সত্যজিৎ রায়। ছবি: সংগৃহীত।

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মুক্তির সময় সবার যে পছন্দ হয়েছিল ছবিটি, তেমন নয়। নিউ ইয়র্কের পলিন কেল, ‘ফিনানশিয়াল টাইম’-এর ডেভিড রবিনসন ভূয়সী প্রশংসা করলেও ‘ভিলেজ ভয়েস’-এর উইলিয়ম পল তীব্র সমালোচনা করেছিলেন ছবিটির। কিন্তু ৫৫ বছর পরে প্যারিসের বুনুয়েল থিয়েটারে ছবির প্রদর্শন শেষ হওয়ার পর ২ মিনিট ধরে শর্মিলা, সিমিকে দর্শক যে ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ জানালেন তা বোধহয় প্রমাণ করে, সৃষ্টি গ্রহণযোগ্য হয় সৃষ্টির নিয়মেই, দর্শকের অফুরান ভালবাসায়। আর সেখানেই সৃষ্টির সার্থকতা। সেখানেই সৃষ্টি কালজয়ী হয়, পায় অমরত্ব।

Director Bauddhayan Mukherji shares experience on special screening of Satyajit Ray’s movie ‘Aranyer Din Ratri’ at the Cannes Film Festival

কানের উৎসবে সস্ত্রীক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়। ছবি: ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।

প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আমি আর মোনা হাঁটতে থাকলাম ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা ধরে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে তখন। বেশ খানিকক্ষণ বাদে মোনা বলে উঠল, ‘‘৫৫ বছর ধরে অনেক কিছু পাল্টেছে, জানো। লিঙ্গ-রাজনীতি বদলেছে, আমাদের সচেতনতা বদলেছে। আজ বোধহয় কোনও পুরুষ কোনও মহিলাকে প্রথম আলাপে ‘আপনাকে খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে’ বলার সাহস পাবে না। আর প্রত্যুত্তরে কোনও মহিলা আজ আর বোধহয় ক্যান্ডি খাওয়াতে চাইবে না।

আমরা হাঁটতে থাকলাম। যানজট, কোলাহল পেরিয়ে আমরা দু’জন— সত্যজিতের দেশের দুই দর্শক, চুপ করে হাঁটতে থাকলাম। কানে দিন পেরিয়ে রাত হয়েছে একটু আগে।

Sharmila Tagore Simi Garewal Satyajit Ray
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy