Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মানব প্রবৃত্তির আলোয় ফিরে এল ‘হয়বদন’

‘স্মৃতি, স্মৃতি, আরও স্মৃতি’— গোটা মঞ্চ জুড়ে সেই স্মৃতি ও বর্তমান, শরীর ও মন এবং যৌনতার প্রকাশ দেখল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস। সৌজন্যে, দিনাজপুর থিয়েটার কোম্পানি প্রযোজিত ‘হয়বদন’ নাটক। নারীর যৌনতার প্রকাশ বাংলা রঙ্গমঞ্চে তুলনায় কম— এমন অভিযোগ বোধহয় এই নাটকটি দেখার পর আর করা সম্ভব নয়।

‘হয়বদন’ নাটকের একটি দৃশ্য।—নিজস্ব চিত্র।

‘হয়বদন’ নাটকের একটি দৃশ্য।—নিজস্ব চিত্র।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:১১
Share: Save:

‘স্মৃতি, স্মৃতি, আরও স্মৃতি’— গোটা মঞ্চ জুড়ে সেই স্মৃতি ও বর্তমান, শরীর ও মন এবং যৌনতার প্রকাশ দেখল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস। সৌজন্যে, দিনাজপুর থিয়েটার কোম্পানি প্রযোজিত ‘হয়বদন’ নাটক। নারীর যৌনতার প্রকাশ বাংলা রঙ্গমঞ্চে তুলনায় কম— এমন অভিযোগ বোধহয় এই নাটকটি দেখার পর আর করা সম্ভব নয়। দেবদত্ত-পদ্মিনী-কপিলের ত্রিকোণ প্রেমের সমীকরণের পাশপাশি নাটকের উপকাহিনি হিসেবে ঘোড়ামুখো মানুষের কথা যেন মানব সভ্যতারই আঁতে ঘা মারতে চায়।

নাটকে কাহিনির স্থান ধর্মপুর। গোটা নাটকটি এগিয়ে চলেছে অধিকারী মশাইয়ের (কথক) বয়ান অনুসারে। দর্শক পুরো কাহিনিকে ৩টি ভাগে ভাগ করতে পারেন। প্রথম ভাগে দেখা যায়, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন ক্ষমতার অনুগ্রহ লাভের প্রার্থনা, এককথায় যা নান্দীমুখের মতো শোনায়। নান্দী শেষে মঞ্চে ঘোড়ামুখোর প্রথম আবির্ভাব। কথকের কাছে সে পুরোপুরি মানুষ হয়ে ওঠার উপায় জানতে চায়। সমস্যা সমাধানে কথক তাকে চিত্রকূট পাহাড়ে দেবীর কাছে প্রার্থনা করতে বলেন। নাটকের দ্বিতীয় ভাগটিই প্রধান। দেবদত্ত ও কপিল যাথাক্রমে তাঁদের বিদ্যা ও শারীরিক সৌষ্ঠবের জন্য ধর্মপুরে খ্যাত। ‘ওরা দু’জন প্রাণেরই দোসর’। হঠাৎ পদ্মিনী নামে এক সুন্দরী নারীকে কেন্দ্র করে শুরু হয় দু’জনের টানাপড়েন। দেবদত্তের স্ত্রী পদ্মিনী সোচ্চার ভাবেই কামনা করে কপিলের শরীর। কালক্রমে দু’জনেই আত্মহত্যা করে। পরে যদিও মা কালীর আশীর্বাদে প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু পদ্মিনীর ‘স্বেচ্ছাকৃত ভুলে’ দেবদত্ত ও কপিলের ধড় ও মাথার অদলবদল ঘটে। পদ্মিনী বেছে নেয় কপিলের শরীর ও দেবদত্তের মাথাওয়ালা পুরুষটিকেই। এরপরই তিন জনের দৈনন্দিন জীবনচর্চার মধ্যে ঈর্ষা, যৌনতা, ত্যাগ, সুবিধেবাদ-সহ মানুষের বিভিন্ন প্রবৃত্তিগুলিকে খোঁচা দিয়ে বের করে আনতে চান নির্দেশক। শেষমেশ তিন জনেই যেন এগিয়ে চলে এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে, সে পরিণতির নাম মৃত্যু। নাটকের তৃতীয় তথা শেষ ভাগে দেখা যায়, ঘোড়ামুখো সম্পূর্ণ ভাবেই ঘোড়ায় রূপান্তরিত। সে জন্য আক্ষেপও নেই তার। এই রূপান্তরে খানিকটা হলেও যেন সাহায্য করে পদ্মিনীর শিশুপুত্র।

কন্নড়ে নাটকটির মূল রচয়িতা গিরিশ কারনাড। যথা সম্ভব মূলানুবাদই করেছেন শঙ্খ ঘোষ। থমাস মানের বিখ্যাত ‘দ্য ট্রান্সপোসড হেডসে’র ছায়া এই নাটকের পরতে পরতে। নাটকের স্থান-কালের উপস্থাপনায় বেছে নেওয়া হয়েছে প্রাচীন ভারতীয় সমাজকেই।

সম্প্রতি দিনাজপুর থিয়েটার কোম্পানি কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ‘পঞ্চম বৈদিকে’র নাট্যোৎসব উপলক্ষে তাদের দল নিয়ে আসে। অর্পিতা ঘোষের নির্দেশনায় ও দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের অভিভাবকত্বে দিনাজপুরের ছেলেরা মঞ্চে অত্যন্ত সাবলীল ভাবেই চরিত্রগুলি ফুটিয়ে তুলেছেন। কৌশিক, তথাগত, শতরূপা, মনীষাদের পাশপাশি নটবর চরিত্রে রবীন রায়ের অভিনয় বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে নাটকের নৃত্যশৈলীগুলি। নাচের তালিম দিয়েছেন কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়।

নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা, গান ও সর্বোপরি মুখোশের ব্যবহারে বিশেষ করে উঠে আসে দিনাজপুরের বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি। কর্নাডের মূল নাটকটিতে থাকা ‘যক্ষে’র গান বাংলায় যেন রূপ পেয়েছে দিনাজপুরের নিজস্ব ‘খন গানে’। মঞ্চ সজ্জায় ব্যবহার করা হয়েছে কুশমণ্ডির মহিষবাথানের বাঁশের কাজ ও মোখাশিল্পকেও। দীর্ঘদিন ধরে কর্মশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দিনাজপুরের ছেলেদের মঞ্চে এনেছেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় ও অর্পিতা ঘোষ। থিয়েটার কোম্পানির তরফে সুনির্মল জ্যোতি বিশ্বাস বলেন, ‘‘স্থানীয় ছেলেদের মূল ধারার মঞ্চের সঙ্গে যোগ করিয়ে দিতে চেয়েছি আমরা।’’ সুনির্মলবাবু জানান, শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালে। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় কলকাতার রবীন্দ্রসদনে। তারপর স্টার থিয়েটার, আসানসোল-সহ বিভিন্ন জায়গায় মোট ২৪ বার নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে।

নাটকটি দর্শকের কাছে পরিচিত। তবুও ফের তাকে মঞ্চে আনা হল কেন? দেবেশবাবু বলেন, ‘‘এ যাবত নাটকটি মঞ্চস্থ হলেও তার পরিকল্পনায় নাগরিক জীবনেরই পরিচয় উঠে এসেছে। আমাদের নাটকটি করার মূল উদ্দেশ্য ছিল দিনাজপুরের নিজস্ব লোক আঙ্গীককে মঞ্চে ফিরিয়ে আনা। এ ক্ষেত্রে দিনাজপুরে ‘খনে’র সঙ্গে কারনাড ব্যবহৃত ‘যক্ষ’ গানের বিশেষ মিল থাকায় আমাদের নাটক নির্দেশনার ক্ষেত্রেও সুবিধে হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE