কথা ছিল গুরুগম্ভীর আলোচনা না, নির্ভেজাল আড্ডা হবে। সেই মতো আড্ডা শুরু হল শহরের এক অভিজাত ক্লাবে। নিম্বু পানি আর ব্ল্যাক কফির কম্বিনেশনে। নিউ ইয়র্কের সাদামাঠা রোজকার জীবনের বিপরীতে বই প্রকাশের ভয়ঙ্কর ব্যস্ততাময় সেলিব্রিটি বুক-ট্যুর, যা পরিব্যাপ্ত ভারত থেকে চিনে— টুকরো টুকরো সেই সব মুহূর্ত উঠে আসতে থাকল আড্ডায়। আর তার পরে কখন, অজান্তেই আড্ডার সুর মিশে গেল তাঁর নতুন বইয়ের সঙ্গে। খরা, বন্যা, ভূমিকম্পের অভিঘাত নাড়া দিয়ে গেল ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়ানো এক সভ্যতার শরিকদের।
Amitav, ইংরেজিতে আপনার নামের এই বানান লেখেন তো? খুব অন্য রকম কিন্তু, মানে বাঙালিরা এ ভাবে ‘অমিতাভ’ লেখে না।
এখানে আমার কোনও ভূমিকা নেই, এটা আমার বাবার সিদ্ধান্ত। বানানটা টিপিক্যাল হিন্দি যাতে না হয় সেটা আটকাতে গিয়ে ওই একটু কম্প্রোমাইজ করে-টরে এ রকম একটা বানান করেছিলেন।
তা ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক Amitav ঘোষ কি বাঙালি?
(হেসে ফেলে) একদম বাঙালি, বানান একটু অন্য রকম হলে কী হবে!
বেশ, আপনি শুক্তো খান?
অবশ্যই খাই, অসম্ভব ভালবাসি শুক্তো খেতে।
শেষ কবে খেয়েছেন মনে আছে?
(একটু ভেবে) নাহ, সেটা মনে নেই। তবে খুব ভালবাসি এটা ঠিক।
ইলিশ মাছ খান?
কী কাণ্ড! খাব না কেন?
কাঁটা বাছতে পারেন?
আরে! কী ভাবছেন বলুন তো আমায়? অবশ্যই পারি। তবে একটা বক্তব্য আছে। বাঙালি কি না তার পরীক্ষা নিতে গেলে ‘ইলিশ খেতে পারেন কি না’ জানতে চাওয়ার থেকে জরুরি সেই মানুষটা পাঁকাল মাছ খেয়েছে কি না, শোল-মুলো খায় কি না — এগুলো জানতে চাওয়া। ইলিশ, রুই, কাতলা করে করে আমরা অন্য মাছগুলো হারিয়ে ফেলেছি। আর অতিরিক্ত চাহিদার চাপে ইলিশের মতো মাছ এখন বিপন্ন। যদি আমাদের পছন্দ-অপছন্দগুলো নিয়ে একটু সচেতন হতাম!
এগ্রিড! আপনি কলেজ স্ট্রিটে পুরনো বইয়ের দোকানে ঘুরেছেন?
অবশ্যই। ছোটবেলায় এত বইয়ের দোকান ছিল না তো, কলেজ স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের লেন্ডিং লাইব্রেরি, গোল পার্কের ফুটপাথই ভরসা ছিল তখন।
আর উত্তমকুমারের ছবি?
বহু দিন দেখা হয়নি। তবে দেখেছি তো বটেই।
আপনার জার্নিটা দুন স্কুল, সেন্ট স্টিফেন্স, অক্সফোর্ড। এটাও বাঙালির চেনা রুট নয়। বাঙালি প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, জেএনইউ অবধি সামলাতে শিখেছে। কিন্তু আপনার রুটটা বড় বেশি আন্তর্জাতিক! ওই বাঙালি নয় যা, আবার!
এখানেও আমার কোনও ভূমিকা নেই। আমার বাবারা প্রবাসী তো, বাবার কাছে শুনেছি ১৮৫৬ থেকে ওঁরা ছাপরা জেলার বাসিন্দা। বাড়িতে অনর্গল ভোজপুরি বলা হত। সেখানে টিপিক্যাল বাঙালি ব্যাপারটা, মানে... (একটু থেমে), তবে আমার মা’রা আবার পুরো বাঙালি। ঢাকা, ফরিদপুর। পরে কলকাতায় সেটল করেন। মামার বাড়ির জন্যেই আমার কলকাতাকে ঘিরে এই টানটা। বাবার আর্মির চাকরি সূত্রে আমার এক-দেড় বছর বয়সেই কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হলেও মেনকা সিনেমার কাছে মামার বাড়ির টানটা ভুলতে পারিনি।
মেনকায় সিনেমা দেখেছেন কখনও?
বহুবার! ‘পড়োশন’ দেখেছিলাম সবাই মিলে…
সুনীল দত্তের ‘পড়োশন’?
সুনীল দত্ত ছিলেন না কি? না না, দাঁড়ান তো গুগল করে দেখি। (কোনও কারণে ফোনে পাতাটা লোড না হওয়ায় বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন)। সুনীল দত্ত না কিন্তু, কোনও এক জন কমেডিয়ান।
হ্যাঁ, মেহমুদ। কিশোর কুমারের ‘মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি মে’...
হ্যাঁ। কিন্তু সুনীল দত্ত না, দাঁড়ান আমি পরে দেখে কথা বলব আপনার সঙ্গে এটা নিয়ে। আরও একটা ছবি মেনকায় দেখেছিলাম, রাজেশ খন্নার ‘আরাধনা’।
রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল ‘রেসিডেন্ট রাইটার’ হিসেবে?
অসাধারণ সম্মান ওটা। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকা— অসামান্য অভি়জ্ঞতা।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে আলোচনার সুযোগ হল?
উনি একদিন আমাকে আর আমার স্ত্রীকে লাঞ্চে ডাকলেন, অনেক গল্প হল। ওঁর মেয়ে শর্মিষ্ঠাও ছিলেন সেখানে। অসাধারণ মানুষ, এত পড়াশোনা করা, এত ডাউন টু আর্থ, এত বুদ্ধিমতী। আমাদের সঙ্গে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে ওঁর।
আগেকার দিনে রাজা-বাদশারা সভাকবি বা লেখকদের যোগ্যতাকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে তাঁদের অন্যান্য বড় দায়িত্ব দিতেন। তা আপনাকে ধরুন সেই ভাবেই দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হল...
(হো হো করে হেসে) বাপরে! ওভার মাই ডেডবডি! কোনও দিনও না!
সে কী! এত খারাপ প্রস্তাব এটা?
(হাসতে হাসতে) প্রতিষ্ঠান ব্যাপারটা আমার সঙ্গে ঠিক যায় না। আমাকে এ ধরনের বা এর কাছাকাছি বিভিন্ন ধরনের কাজের কথা বলা হয়েছে আগে, আমি শুনেই না করে দিয়েছি। আমার দ্বারা এ সব হয় না।
বেশ। এই যে এত পুরস্কার, এর মধ্যে কোনটা পেয়ে মনে হয়েছিল এক্ষুনি প্রিয়জনকে জানাতে হবে অনুভূতিটা কেমন?
পদ্মশ্রী পেয়ে বোধহয়। আমি নিজে, আমার আত্মীয়স্বজন, কাছের সবাই অসম্ভব খুশি হয়েছিলাম।
সেটা কি রাষ্ট্রীয় সম্মান বলে?
(একটু ভেবে) সাহিত্য অকাদেমি পেয়েও অসম্ভব খুশি হয়েছিলাম। (স্বগতোক্তির ধরনে) সেই ১৯৯০ সালে, (একটু থেমে, হেসে ফেলে) আসলে ওই বছরেই আমার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের কয়েক মাস পরেই সাহিত্য অকাদেমির খবরটা আসে।
এ তো ওয়েডিং গিফট পুরো!
হা হা! যা বলেছেন। আরও একটা পুরস্কারের কথা বলব, ‘দ্য গ্লাস প্যালেস’ মায়ানমারের স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ হওয়ার পরে সে দেশের জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল। ম্যান্ডলে, ইয়ানমারে সাহিত্যসভার আয়োজন করেছিলেন ওঁরা। মায়ানমারের সেরা সাহিত্যিকরা উপস্থিত ছিলেন সেখানে, সঙ্গে অগুনতি মানুষ। অনুবাদ হওয়া একটা বই নিয়ে উন্মাদনাটা মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। এখনও মায়ানমারের সব জায়গায় বইটা পাওয়া যায়। আমাকে ওখানকার মানুষ বলেছেন এই বইটা না পড়লে বর্মার ইতিহাসের এই দিকটা তাঁরা জানতে পারতেন না। আর আমাদের পরিবারের সঙ্গে মায়ানমারের বহু পুরনো যোগাযোগ। রেঙ্গুনের দুর্গাবাড়ির সঙ্গেও আমাদের পরিবারের দীর্ঘকালের সম্পর্ক। ওই পুরস্কারটা আমার কাছে খুব স্পেশাল।
আমার এক বান্ধবীর স্বপ্ন ছিল সে ইস্তানবুলে গিয়ে ওরহান পামুকের সঙ্গে ঘর বাঁধবে। পামুককে নিয়মিত চিঠিও লিখত সে। আপনার এ রকম কোনও নাছোড় অনুরাগী জোটেনি?
না না (প্রবল হাসতে হাসতে)। ভাগ্যিস! আমি খুব সাদামাঠা মানুষ। বই প্রকাশের আগের এই আমি, যাকে দেখে সেলিব্রিটি মনে হয়, সেটা মোটেও আমি নই। আপনি যদি নিউ ইয়র্কের বাড়িতে আমাকে দেখতেন। রীতিমতো অস্বস্তিকর রকমের অন্য একটা আমি।
প্রচারের আলো থেকে দূরে নিজের মতো?
একদম। এই যে এত দৌড়াদৌড়ি, মিটিং, ইন্টারভিউ— এগুলো আমি নই। আমি নিজের লেখালেখি নিয়ে থাকা, নিজের হাতে বাজার করা সাধারণ একটা মানুষ। তবে পাঠকদের অনেকের সঙ্গেই নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। চিঠি লেখেন অনেকে, অনেকে বিভিন্ন ইভেন্টে এসে আলাপ করে বলেন, আমার লেখা তাঁদের খুব অন্ধকার সময়ে কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। ভাল লাগে এঁদের কথা শুনতে, এই মানুষগুলোকে জানতে। তবে আপনার বান্ধবীর মতো কেউ কখনও কিছু লেখেনি। (হেসে ফেলে) ভাগ্যিস লেখেনি। তবে এক বার একটি মেয়ে, বছর ১৪ বয়স হবে, সে কেরল থেকে লিখেছিল—‘আপনার ‘দ্য শ্যাডো লাইনস’ পড়েছি, আমাকে ত্রিদিবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন, ওর ছবি পাঠান।’ এই যে কল্পনার চরিত্রকে এতটা রক্তমাংসের ভেবে ফেলা, সেটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল খুব।
এই যে পামুক, মুরকামি, সারামাগো, মার্কোয়েজ— এঁরা সবাই নিজের নিজের ভাষায় লিখে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছেন আর আমাদের দেশে ইংরেজি লিখতে না পারলে খ্যাতি পাওয়া যায় না...
দেখুন তুরস্ক, কলম্বিয়া ইত্যাদি দেশের মতো ভারত কিন্তু একটা ভাষার দেশ না, সেটাও বুঝতে হবে। এখানে অনেক ভাষা এবং তার আলাদা আলাদা সাহিত্য...
এবং তাই আপনারা যাঁরা ইংরেজিতে অলরেডি ভাল লেখালেখি করছেন তাঁদের লেখাকে ভারতীয় সাহিত্য তকমা দিয়ে ছাপানোটা সহজ, অন্য ভাষাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে?
সেন্স অব ইক্যুয়িটির তো খুব দরকার এখানে, আমি সব সময় সেটা মানি। পশ্চিম তো সব সময়ে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে ব্যস্ত। তবে ভাল অনুবাদ করতে পারাটাও প্রাথমিক শর্ত হতে হবে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাল অনুবাদ...
অবশ্যই দরকার ছিল। কিছুই তো করা হয়নি এঁদের কাজ নিয়ে। তবে এই ট্রেন্ডটা পাল্টাচ্ছে এবং আমার বিশ্বাস অনুবাদ সাহিত্য খুব বড় একটা জায়গা করে নেবে ভবিষ্যতে। কোন ভাষায় লেখা হয়েছে সেটা আর মাথায় রাখা হবে না। এই তো আমি বিভিন্ন জায়গায় সুনীলবাবুর অনুবাদ করা লেখা আর আমার বই পাশাপাশি দেখি, দু’জনেরই পদবি ‘জি’ দিয়ে বলে পাশাপাশি রাখে। এখন বিশ্ব সাহিত্যের অধিকাংশ ভাল লেখাই তো অনুবাদ— এলেনা ফেরান্টে, উমবার্তো একো। ভারত থেকে একটা, জাস্ট একটা, এ রকম পাথ ব্রেকিং অনুবাদ দরকার।
আপনার কোনও আক্ষেপ আছে?
এটা খুব আশ্চর্য একটা ব্যাপার যে আমি জাস্ট কয়েক দিন আগেই এটা নিয়ে ভাবছিলাম আর আপনি সেই প্রশ্নটাই করলেন। (হঠাৎ হেসে ফেলে), ভারতীয়রা কিন্তু এই প্রশ্নটা শুনলেই বলে, আমার কোনও আক্ষেপ নেই।
আপনি কী বলেন?
আই থিঙ্ক আই হ্যাভ বিন ভেরি লাকি। যে কাজটা একমাত্র করতে পারি সেটা মানুষে পছন্দ করেছে, সম্মান দিয়েছে। আর কী চাই! তবে তাই বলে কি আক্ষেপ নেই? ‘এই গাড়িটা না কিনলেই হত’ গোছের আক্ষেপ প্রচুর আছে (আবার হাসি)।
শেষ প্রশ্ন। অমরত্বে বিশ্বাস করেন?
(গম্ভীর হয়ে গেলেন) কী রেখে যাচ্ছি আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে যে অমরত্বের প্রত্যাশা করব? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তরুণরা তাদের অভিভাবকদের প্রশ্ন করেছিল যে এই ধ্বংস আটকাতে তোমরা কী করেছিলে? আজ পৃথিবী যে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাতে আমাদেরও একদিন একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy