শিল্ড ফাইনালের পরের দিন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতা
সেপ্টেম্বরাইটিস! এ রোগের কোনও ওষুধ বেরোয়নি আজ পর্যন্ত। সেপ্টেম্বরে ইস্টবেঙ্গলের মুখে পড়লেই কাঁপতে কাঁপতে চার-পাঁচটা গোল খেয়ে কচুকাটা হওয়া। ১৯৩৬... ১৯৭৫...২০১৫। প্রথমটা অবশ্য সেপ্টেম্বর ছিল না। যাই হোক, মোটামুটি একটা ক্রমপর্যায় ঠিক হয়ে গেছে—চল্লিশ বছর অন্তর। ২০৫৫-র সেপ্টেম্বরে ইস্টবেঙ্গল আবার হারাবে মোহনবাগানকে। চার-শূন্য না পাঁচ-শূন্য? একটু চেষ্টা করলে ৬ তারিখেই আর গোটা দু’য়েক গোল খাওয়া যেত। ভূতের রাজার কাছ থেকে যদি একটা বরই ম্যানেজ করা যেত: ৩১ অগস্ট হাততালি দিয়ে ডোন্ট কাম সেপ্টেম্বর, বললেই দুনিয়ার সমস্ত ক্যালেন্ডারে অক্টোবর চলে আসবে।
দশ বছর বয়স থেকে মোহনবাগান সাপোর্টার। ছেচল্লিশ বছর ধরে মেম্বার। আর পারা যায় না। ফেল করা ছাত্রকে বন্ধুর স্তোকবাক্য ‘দুঃখ করিস না, ফেলিওর্স আর দ্য পিলার্স অব সাকসেস’ শুনে ছাত্রটির সুরসিকা মা বলেছিলেন, ‘আর পিলারে দরকার নেই বাবা, অনেকগুলো তো হয়ে গেল।’ মোহনবাগানেরও তাই।
পঁচাত্তরে শিল্ড ফাইনাল দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। চুনী গোস্বামী, প্রদীপ চৌধুরীকে হিংসে করি, ওঁরা সে দিন মাঠে ছিলেন না। এখনও চোখের সামনে ভাসে মোহনবাগান গ্যালারির উদ্দেশে পাঁচ আঙুল দেখিয়ে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীরব আস্ফালন আর মোহনবাগান-ফেরত সুভাষ ভৌমিকের সেই হাত নেড়ে বিধ্বস্ত মোহনবাগান টিমটাকে গোল করতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। হ্যাঁ, ওই খেলার জেরেই চাকরি খোয়াই, তবে সে প্রসঙ্গ অন্যত্র।
এখন যেটা বলছি, তা হল সে দিন পাঁচ গোল দিয়েও এত কলরব, এত নাচানাচি করেনি ইস্টবেঙ্গলিরা। কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল গোলগুলো ফটাফট করে ফেলে। খানিকটা ‘স্বপ্নো নু মায়া নু মতিভ্রমো নু’- গোছের অবস্থা আর কী। কিন্তু এ বারের চার গোলের লিগের জয়টা নিয়ে বেশ বাড়াবাড়ি রকমের আদিখ্যেতা হয়েছে। অবশ্যই মিডিয়ার কল্যাণে। অভাগা যে দিকে চায়, লাল-হলুদ দেখিতে পায়। রঙিন ছবি, পরিসংখ্যানের ছড়াছড়ি সর্বত্র। সাক্ষাৎকারেরও। হিরো ওয়ারশিপ। এ সব চলল পুজো অবধি। মোহনবাগান (অমল দত্তের ম্যাচটা বাদে) একটাও গোল করতে পারে না। ব্রাজিল সাত খানা খেয়ে তবু একটা শোধ করেছিল। খোদ ইস্টবেঙ্গলই সোভিয়েত ইউনিয়নে একটা খেলায় তেরোটা হজম করেও একটা ফেরত দিয়েছিল। মোহনবাগান সেটাও পারে না। রবীন্দ্রনাথও তো তাঁর প্রিয় মোহনবাগানকে পাঁচ শূন্যয় হারিয়ে দিয়েছেন: ‘স্মৃতিরত্নমশায় মোহনবাগানের গোলকীপারি ক’রে ক্যালকাটার কাছ থেকে একে একে পাঁচ গোল খেলেন।’ (সে)
কিন্তু পরিসংখ্যানের বন্যায় যে কথাটাকে ভাসিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, তা হল মিথ্যে তিন রকম— শুধু মিথ্যে, ডাহা মিথ্যে আর পরিসংখ্যান। সাধে কি আর স্যর নেভিল কার্ডাস স্কোরবোর্ডকে ‘গাধা’ বলেছিলেন? পরিসংখ্যানের আড়ালে অদৃশ্য কাহিনিগুলো জানলে মূল্যায়নের সুবিধা হয়। পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালে অরুণ লাল ঘোষ ভুল করেছিলেন আনকোরা গোলরক্ষক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়কে খেলিয়ে— সে কথা আজ বলছেন। নিয়মিত প্রশান্ত মিত্রকে প্রথমে নামাননি। চার গোল খাওয়ার পর... কিন্তু তখন তো অল ইজ ওভার। ম্যানেজার কেষ্ট সেন অনুরোধ করা সত্ত্বেও অভিজ্ঞ শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নামাননি। তেমনই এ বার সঞ্জয় সেন বাধ্য হয়েছিলেন সাতটা নতুন ছেলে নিয়ে দল নামাতে। উপায় ছিল না। শুধু দেহে-মনে বিধ্বস্ত সবুজ-মেরুন সমর্থকরা চাপা পড়ে যাচ্ছে। ডং-এর গোল দু’টো ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল। দ্বিতীয়টার পর টিভি চ্যানেল ঘুরিয়ে ‘স্মৃতিটুকু থাক’ দেখছিলাম।
জানি না, এর মধ্যে আর কেউ উমাকান্ত পালধির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন কি না। উমাকান্ত পেরেছেন, আমি পারিনি। কিন্তু চল্লিশ বছরের দগদগে ঘায়ে এক বস্তা নুন ঢেলে দিল একদা ১৬/২ ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট-এর এক বাসিন্দা এবং তার তালিম পাওয়া বাইশ বছর বয়সি কোরীয় ছেলেটা। পঁচাত্তরের বিপর্যয়ের জেরে চাকরি হারিয়েছিলাম। এ বার কী হারিয়েছি? আমি তো এখন এক নির্ভেজাল প্রোলেতারিয়েত, যার দারিদ্র ছাড়া আর কিছু হারাবার নেই।
ঠিক করেছিলাম, মোহনবাগান যত দিন না ইস্টবেঙ্গলকে ৫-০ বা ৬-০ হারাতে পারছে, তত দিন আর মোহনবাগানের কোনও প্রতিযোগিতামূলক খেলা দেখব না। তাই ম্যাচ কভারও করব না।
কিন্তু এই নির্বোধ জেদ নিয়ে তো আর চাকরি করা চলে না। আনন্দবাজারের স্পোর্টস এডিটর তখন খ্যাতনামা সাহিত্যিক মতি নন্দী। তিনি নাছোড়বান্দা—সঙ্গত ভাবেই—আমাকে দিয়ে মোহনবাগান ম্যাচ করাবেনই, আমিও নানা ভাবে ডজ করে বেরিয়ে যাই। এক দিন এই রকম ভাবে আমাকে কী একটা ম্যাচ করতে বলায় মরিয়া হয়ে বললাম, আমার প্রেস কার্ডটা হারিয়ে ফেলেছি, তাই...। ভাবলাম ডুপ্লিকেট কার্ড করাতে করাতে অন্তত সাত-আট দিন তো রেহাই পাব, পরের কথা পরে দেখা যাবে। কিন্তু হা হতোস্মি, অসাধারণ তৎপরতা দেখিয়ে সহকর্মী রূপক (সাহা) নতুন কার্ড বার করে আনল পরের দিনই। বুঝলাম ম্যাচ করতেই হবে। তখন চাকরিটা ছেড়েই দিলাম। এর পর শুরু হয় আমার বেকার জীবন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ইংরেজি পড়ানোর ‘ব্যাচ’ বসিয়ে দিলাম। স্বখাত সলিলে সাঁতার কাটা আর কী।
মোহনবাগান সমর্থক হিসেবে পরবর্তী ক’বছরে বারবার মনে হয়েছে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি এবং অ্যাথলেটিক্স— সব মিলিয়ে দেখলে মোহনবাগান অনেক অনেক এগিয়ে। কিন্তু এ সব কথা কে শুনছে এই মুহূর্তে? কলকাতা লিগের একটা টু-ইন-ওয়ান জয় দিয়ে আই লিগ জয়কে ঢাকার অপচেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তা কি সম্ভব?
তা হলে একটা বার্তা দিতেই হয় ওঁদের উদ্দেশে: হেক্সা-হেপ্টা-অক্টো-ননা/ যত পারিস কে-লিগ নে না/ আই-লিগ একশো একা/ পারিস যদি জিতে দেখা!
মোহনবাগান সদস্য-সমর্থকরা মাঝে মাঝেই বলেন, বদলা চাই। এ ব্যাপারেও কিন্তু বাস্তবোচিত দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। তুমি কথায় কথায় ওদের কাছে ০-৫, ০-৪ হারবে, আর এক বার ৫-৩ করেই উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করবে? ০-৫, ০-৪ এর বদলা ৫-০ কী ৪-০ তেই হয়। পারলে, সুদসুদ্ধ একটা করে বেশি দিয়ে। ‘নিল’টা বজায় রাখতে হবে। ২০০৯-র আই লিগের ৫-৩ জয়টা (যাতে চিডি চারটে গোল করেছিল) কোনও ক্রমেই পঁচাত্তরের পাঁচ গোলের শাপমুক্তি নয়।
আর একটা কথা। মোহনবাগানকে ৫-০ বা ৪-০ জিততে ইস্টবেঙ্গল কোনও দিনই দেবে না। মোহনবাগান পুরো ব্রাজিলের বা জার্মানির দল নিয়ে খেললেও পারবে না। কলঙ্কিত পঁচাত্তরে যদি কোনও অধিকারবলে মাঠে থাকতাম— কর্মকর্তা, কোচ বা খেলোয়াড়— তা হলে যে কোনও ছুতোয় খেলাটা ভন্ডুল করতাম।
আরে বাবা, যখন বুঝছিস দিনটা তোদের নয়, দুটো কি তিনটে গোল খাওয়ার পর অ্যাকশন নাও! ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে যদি এতটুকু চিনে থাকি, এটা ঘটবেই।
একটা শুধু ভয় হচ্ছে। এই মওকায় ‘গোষ্ঠ পাল সরণি’টা না আবার ইস্টবেঙ্গল সরণি হয়ে যায়। গোষ্ঠবাবু তো শেষ অবধি ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে বসে থাকতেন। এখনকার মোহনবাগান মাঠে যেতে চাননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy