Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সাহসী বিপথগামী কবিতা

অমিত রায়ের চরিত্রে রাহুল বসুকে নির্বাচনই পদ্যের ছন্দের বাঁধুনি ভেঙে ছবিটাকে গদ্য করে ফেলল। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যঅমিত রায়ের চরিত্রে রাহুল বসুকে নির্বাচনই পদ্যের ছন্দের বাঁধুনি ভেঙে ছবিটাকে গদ্য করে ফেলল। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

‘শেষের কবিতা’কে একটা সার্থক ছবি করার প্রধান বিপদগুলো‌ই রচনা করে গেছেন স্বয়ং রবি ঠাকুর।

এমন রঙিন, ধ্বনিমধুর ও চিত্তসুখকর করে লিখেছেন যে পড়তে পড়তে একটা সিনেমা দেখার স্বাদ আসে। তার পর প্রেম, বিবাহ, ভালবাসা নিয়ে এত সব তত্ত্ব, লেকচার, উদ্ধৃতি ছড়িয়ে দিয়েছেন পাতায় পাতায় যে উপন্যাসটা এক সময় ডিসকোর্সের চেহারাও নেয়। ডিসকোর্স, তবে একটা ঠাট্টার সুরে, এবং এক বিশেষ বাংলা বোলচালে। সেই রঙিন সংলাপ রুপোলি পর্দায় বেশ ক্লান্তিদায়ক হয়।

আর সর্বোপরি ‘শেষের কবিতা’য় রবি ঠাকুর নিজেকে নিয়েও প্রচুর আমোদ করেছেন। আমরা বইটা পড়তে পড়তে সেই সব জায়গায়ও খুব হাসি। সেই সব কথা ও দৃশ্য নাট্যায়িত ও চিত্রার্পিত করা খুব সহজ হয় না। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, কিছুটা সফল হয়েছেন, সবটা নন।

শীর্ষ রায়ের অসাধারণ চিত্রগ্রহণে টইটম্বুর ‘শেষের কবিতা’। দৃশ্যগুলোই কবিতার মতো। কিন্তু সেই সব দৃশ্যে অমিত ও লাবণ্যের সংলাপের আড়ম্বর ও কবিতার ফুলঝুরি সিনেমার পক্ষে বহন করা একটু কঠিন হয়ে পড়ে বৈকী।

রচয়িতা হিসেবে অমিত রায় চরিত্রটাকেও কি খুব ভালবেসেছেন রবীন্দ্রনাথ? ওঁর তৈরি লাবণ্য যে অমিতকে সহ্য করতে পেরেছে এই না কত! ‘শেষের কবিতা’র একটি গভীর পাঠ হল উপন্যাসটিকে অমিত-র ট্ট্রাজেডি হিসেবে দেখা। ছবি করতে হলেও এই প্রেক্ষিতটা আনা দরকার।

সুমন সেটার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু উপন্যাসটা এমন ভাবে সাজানো হয়েছে শেষের ওই কবিতা দিয়ে, যে শেষ কান্নাটা কাঁদে লাবণ্যই। তার একটু আগে প্রেম ও বিবাহ নিয়ে অমিত তার ব্যাখ্যা শুনিয়ে যায় সদ্য যুবা যতিশঙ্করকে। বলে বিবাহ সংজ্ঞা দিয়ে বলা যায় না, জীবন দিয়ে বলতে হয়।

‘শেষের কবিতা’র প্রেক্ষাপটে জীবন কথাটাও কম ধন্দের নয়। বেশ কিছু চরিত্র নিয়ে গড়া গল্প হলেও তাদের জীবনের কতটুকু, কী আমরা দেখতে পাই এই সামাজিক রূপকথা গোছের উপন্যাসে? বিদেশের পরিবেশ, শিলং পাহাড়ের অপরূপ নিসর্গ, অতি রম্য সেট, পরিধান ও সঙ্গীত আয়োজনে সুমন কাহিনির এই রূপকথার মেজাজটাই বাঁধতে চেয়েছেন। একটা নয়নাভিরাম ছায়াছবি আমরা পেলাম তাতে, যেখানে রূপের ছবি বেশি, মনের ছায়া কম।

‘শেষের কবিতা’কে সিনেমায় আনার দুরূহ কাজ হাতে নিয়েছেন সুমন। অমিত-র ভূমিকায় রাহুল বসুকে নিয়োগ করে একটা বড় ফাটকাও খেলেছেন। চলনে, বলনে এক অতিনাটকীয় বাচালতায় ঈষৎ অসহ্য অমিত চরিত্রটাকে পেশ করেছেন রাহুল বসু। রাহুল নিঃসন্দেহে বড় অ্যাক্টর কিন্তু ওঁকে অমিত রায় তৈরি করার মানে হল অমিত রায় চরিত্রটাকেই ভেঙে ফেলা। অমিত বিলেতে পড়া ছেলে ঠিকই, তবে সেই জমানার বাঙালি ছেলে যে প্রয়োজনে নিবারণ চক্রবর্তীর মতো কবি হয়ে ওঠে, আর রবি ঠাকুরের মস্ত ক্রিটিক। এই দুই প্রান্ত কোনও দিন রাহুল বসুতে মেলে না, কী অভিনয়ে, কী উপস্থিতিতে।
আগের দিনে যাকে ট্যাশ বলা হত অমিত সে ট্যাশ নয়। কিন্তু রাহুলের বাংলায় কিছুটা আপকান্ট্রি ফ্লেভার এসে গেল। তাই না? আসল কথা আমাদের মনের অমিত-র সঙ্গে রাহুল কিন্তু মিশল না। একটু বেমানান।

কঙ্কনা সেনশর্মা চমৎকার অভিনেত্রী। কিন্তু ওঁর লাবণ্য কঙ্কনাই থেকে গিয়েছে। লাবণ্য হয়নি। হয়তো বিশ্বাসযোগ্য সংলাপের অভাবে, হয়তো কবিতার ঘনঘটায়। ছবির দ্বিতীয় ভাগে বরং কেটির রোলে বেশ গোছানো অভিনয় স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের। অমিতকে আংটি ফিরিয়ে দেওয়ার দৃশ্যে ওঁর সংলাপ ও নীরব অশ্রুমোচন মন ছুঁয়ে যায়।

যোগমায়া চরিত্রে তুলিকা বসু খুবই সুন্দর। লিসি ও সিসির ভূমিকায় শ্রেয়সী মুখোপাধ্যায় ও চিত্রাঙ্গদা চক্রবর্তী প্রায় নিটোল। চেহারা ও বাচনে দিব্যি মানিয়ে গিয়েছে। যেমনটি কিনা শোভনলাল চরিত্রে দেবদূত ঘোষও। দেবজ্যোতি মিশ্রের আবহসঙ্গীতের ব্যবহার দারুণ, বিশেষ করে অনুভূতির মুহূর্তগুলোয় সরোদ, বিদেশি পটভূমিতে পাশ্চাত্য সুর। কিন্তু একক রবীন্দ্রসঙ্গীত দুটি হতাশ করেছে। পিরিয়ড ড্রামা বলে সেট ডিজাইন, কস্টিউম ডিজাইনের বড় ভূমিকা এই ছবিতে। আর সে আয়োজন ভারি অপূর্ব। দেব ও নীলের পরিধান পরিকল্পনা ‘শেষের কবিতা’র বড় আকর্ষণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE