কোন ছবি কত কম সময়ের মধ্যে কত বেশি ব্যবসা করতে পারছে তার উপর নির্ভর করে ছবির সাফল্য বা ব্যর্থতা। তাই ছবিনির্মাতা থেকে শুরু করে তারকা, দর্শক এবং ছবি বিশেষজ্ঞ-সহ আরও অনেকের নজর থাকে বক্স অফিস কালেকশনের দিকে। যদিও ছবি বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের দাবি, বক্স অফিস থেকে উপার্জনের ক্ষেত্রে নাকি কোটি কোটি টাকার হিসেব ভুল দেখিয়ে অনেক সময় ব্যর্থ ছবিকেও সফল দেখানো হয়। যদিও এ ক্ষেত্রে বলিউড অবশ্য অনেকটা এগিয়ে। যে সব ছবি নিয়ে বাড়তি উৎসাহ থাকে দর্শকমহলে সেই সব ছবি প্রথম দিন থেকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কে পৌঁছনো পর্যন্ত কত আয় করল সেই খতিয়ান প্রযোজনা সংস্থা নিজেরাই দিতে থাকেন।
তবে এ ক্ষেত্রে এখনও ততটা সাবালক হতে পারেনি টলিপাড়া। ছবির ব্যবসার খতিয়ান নিয়ে সব সময়ই ঢাক ঢাক গুড় গুড় প্রযোজক থেকে পরিবেশক মহলে। বছরের প্রথম মাসে একগুচ্ছ বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি সিনেমা চর্চায়। এই পাঁচটির মধ্যে প্রচারের নিরিখে অন্য ছবিগুলির থেকে এগিয়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ আর রুক্মিণী মৈত্র অভিনীত ‘বিনোদিনী: একটি নটীর উপাখ্যান’। পাল্লা ভারী কার দিকে?
১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৯টি বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, যার মধ্যে প্রচারের আলো ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে যে পাঁচটি সিনেমা, ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’, ‘বিনোদিনী: একটি নটীর উপাখ্যান’, ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’, ‘পাটালিগঞ্জের পুতুলখেলা’ ও ‘ফেলুবক্সী’। পরিবেশক থেকে হলমালিকেরা অবশ্য এক কথায় জানাচ্ছেন, জানুয়ারি মাসে যে দু’টি বাংলা সিনেমা ব্যবসার মুখে দেখেছে তা সৃজিতের কোর্টরুম ড্রামা ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’। অন্যটি রাম কমল মুখোপাধ্যায়ের ‘বিনোদিনী’। এই দুইয়ের মধ্যে এগিয়ে কে? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
দক্ষিণ কলকাতার নবীনা প্রেক্ষাগৃহে ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ ও ‘বিনোদিনী: একটি নটীর উপাখ্যান’ দু’টি ছবির প্রায় কাছাকাছি শো চলছে। হলমালিক নবীন চৌখানি এই দুই ছবির ব্যবসা প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আসলে ব্যবসার অঙ্কটা নিয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে এটা বলতে পারি ছবির গল্প ভাল হলে ছবি চলবে। দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে, এখন বুকিংয়ের দিক থেকে দুটো ছবিই দর্শক দেখছে। তবে সৃজিতের ছবি অন্যটার তুলনায় এগিয়ে। আমি বলব জানুয়ারি মাসটা বাংলা সিনেমার জন্য ভালই কেটেছে।’’
অন্য দিকে, ‘বিনোদিনী: একটি নটীর উপাখ্যান’ মুক্তির আগে স্টার থিয়েটারের নাম বদলে রাখা হয়েছিল বিনোদিনী থিয়েটার। সেখানে অবশ্য সৃজিতের ছবির থেকে রুক্মিণীর ‘বিনোদিনী’ যে এগিয়ে থাকবে তা প্রত্যাশিত ছিল হলমালিকের কাছে। স্টার সিনেমার তরফ থেকে জয়দীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রথম তিন দিন এই ছবি হাউসফুল ছিল। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে প্রায় ৫০ শতাংশ দর্শক দেখছেন। এর কারণ হয়তো ‘বিনোদিনী’ সিনেমা বিনোদিনী থিয়েটারে এসে দেখতেই দর্শক বেশি পছন্দ করছেন। সেই কারণে ‘বিনোদিনী’ আমাদের হলে ভাল ব্যবসা দিচ্ছে। অন্য দিকে, ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’, ‘বিনোদিনী’র মতো না হলেও খুব খারাপ করেনি।’’ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে এখনও ব্যবসা দিচ্ছে ২০২৪-এর শেষে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘খাদান’। সেই কারণে হল থেকে নামানো হয়নি এই ছবিকে। কিন্তু অঙ্কের হিসেব? হলমালিকেরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
সবে দ্বিতীয় সপ্তাহে পা দিয়েছে সৃজিত আর রাম কমলের ছবি। তার মাঝে ৩১ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছে শাহিদ কপূর অভিনীত ‘দেবা’। এমনিতেই বড় তারকার ছবি এলেই নাকি বাংলা সিনেমার সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণ করেন হলমালিক থেকে পরিবেশকেরা। অতীতে এমন অভিযোগ করেছেন বাংলা ছবির একাধিক পরিচালক, নির্মাতারা।
এই প্রসঙ্গে হলমালিক ও পরিবেশক শতদীপ সাহা বলেন, ‘‘বাংলা সিনেমা তার মতো চলবে, হিন্দি সিনেমা চলবে নিজের মতো। এই দুইয়ের মধ্যে কোনও সংঘাত নেই।’’
শতদীপ জানান সৃজিত এবং রাম কমলের সিনেমা একসঙ্গে ভালই আয় করেছে তাই কাউকেই বিশেষ ভাবে এগিয়ে রাখতে চান না তিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে কি শো বাড়ানোর কথা ভাবছেন তিনি? শতদীপ বলেন, ‘‘ব্যবসা ভাল হলে শো বাড়ানো হবে, এখনই এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিইনি। তবে আমি খুশি, বাংলা সিনেমা দেখতে লোক হলে আসছেন। এই ধারাটা গত বছর থেকে শুরু হয়েছে। বাংলা সিনেমার হাল ফেরানোটা খুব দরকার ছিল।’’
এছাড়াও ৩১ তারিখ মুক্তি পেয়েছে আরও তিনটি বাংলা ছবি ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘অমরসঙ্গী’ ও ‘যদি এমন হতো’। হিন্দি ও বাংলা মিলিয়ে নতুন চারটি সিনেমার চাপে কি জায়গা ধরে রাখতে পারবে চর্চিত দুই ছবি? উত্তর মেলেনি। অন্য দিকে, শুক্রবার একটি জনপ্রিয় টিকিট বিক্রির অনলাইন সংস্থার ওয়েবসাইটে দেখা গিয়েছে, শহরের প্রেক্ষাগৃহগুলিতে এগিয়ে সৃজিতের ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’।
বলিপাড়ার অন্দরমহলে কান পাতলে শোনা যায়, কোনও ছবি তেমন ব্যবসা করতে না পারলে সেখানে কারসাজি করতে শুরু করেন পরিবেশকেরা। প্রেক্ষাগৃহে যে সময় সাধারণত দর্শকের ভিড় হয়, সে সময় ছাড়া খুব সকাল অথবা খুব রাতের দিকে (আর্লি মর্নিং এবং নাইট শো) শো টাইম রেখে দেন তাঁরা। সকাল এবং রাতের দিকে সাধারণত দর্শকসংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কম হয়। সেই সময়গুলিতেও দর্শকের ভিড় প্রেক্ষাগৃহে উপচে পড়ছে এমনটাই দাবি করেন পরিবেশক। এমনকি অনলাইন মাধ্যমে হাউসফুল দেখিয়ে টিকিট বুকিং বন্ধ করে রাখার ব্যবস্থাও করে রাখেন তাঁরা। যদিও টলিপাড়া অবশ্য এই প্রসঙ্গেও চুপ।
প্রিয়া সিনেমা হলের মালিক অরিজিৎ দত্ত অবশ্য জানান, মাসের শুরুতে বাংলা সিনেমার ব্যবসা তেমন ইতিবাচক নয়। যদিও মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলির মধ্যে ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’কে এগিয়ে রেখেছেন তিনি। অরিজিতের কথায়, ‘‘আমার এখানে গত বছরের শেষে মুক্তি পাওয়া প্রতিম ডি গুপ্তের ছবি ‘চালচিত্র’ খুব ভাল ব্যবসা দেয়। আর চলতি মাসে আমি সৃজিতকেই এগিয়ে রাখব।’’ যদিও ব্যবসার হিসেবনিকেশ নিয়ে কেউ টুঁ শব্দ করতে নারাজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হলমালিক জানান, যদি পরিবেশকেরা বলে থাকেন ‘বিনোদিনী’ ভাল ব্যবসা করেছে, সেটা ঠিক তথ্য নয়। কেউ নিজের ছবির পক্ষ নিচ্ছেন, আবার বাংলা সিনেমার অঙ্কের হিসেব নিয়ে রয়েছেন ধন্দে। তা হলে কি অঙ্ক মিলবে না? না কি প্রযোজকের ইচ্ছের বিরুদ্ধে নড়নচড়ন মানা!