Advertisement
E-Paper

‘গৌতম চট্টোপাধ্যায় থাকলে গানের দুর্দিন কেটে যেত! বাবা বিকল্প পথ আর গান বার করে ফেলতেন’

“অনেকেই জানেন না, বাবা নকশাল আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে গা-ঢাকা দেওয়ার জন্য চলে গিয়েছিলেন জবলপুর।”

বড় করে বাঁচতে জানতেন গায়ক-পরিচালক গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

বড় করে বাঁচতে জানতেন গায়ক-পরিচালক গৌতম চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

গৌরব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ ১৩:৩১
Share
Save

আমরা সাধারণত পছন্দের মানুষ বা প্রিয়জনের জন্মদিন মনে রাখি। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তবু মৃত্যুদিন মনে রাখতে চাই না। আমার বাবা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তাই। বাবার জন্মদিন মানেই চারিদিকে কত আয়োজন! তাঁর গান, তাঁর কাজ দিয়ে তাঁকে স্মরণ। ২০ জুন, মাত্র ৫০ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত। আমি তখন মাত্র ১৬! তার পর লম্বা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। বাবার দেখানো পথে হাঁটার চেষ্টা করে আমিও গানের দুনিয়ায়। বাবার সঙ্গে অহরহ তুলনা। আমার বক্তব্য, “অবশ্যই আমি বাবার মতো নই। তিনি কালজয়ী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আমি আমার মতো করে ভাল।”

এত কথা বলছি বটে। সত্যিই তো, কি গানের দুনিয়ায়, কি ব্যক্তিগত জীবনে— বাবার অভাব পূরণ হল কই?

এখন বাংলা গানের বড্ড দুর্দিন। এখনও আধুনিক গান তৈরি হয়। ছায়াছবিতেও গান থাকে। কিন্তু সে সব একদল বড় মাপের প্রযোজনা সংস্থার কুক্ষিগত। তারা ঠিক করেছে, শিল্পী বা ব্যান্ড টেলিভিশন বা রেডিয়োয় লক্ষ লক্ষ টাকা ঢালতে পারলে তবেই তাঁর বা তাদের গান দেখানো বা শোনানো হবে। একজন শিল্পী বা কোনও ব্যান্ডের সেই সামর্থ্য নেই। ফলে, নতুন আধুনিক গান তৈরি হয়েও শ্রোতা পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। এ সব যখন দেখি, তখন বাবাকে বড্ড মনে পড়ে। গৌতম চট্টোপাধ্যায় থাকলে বাংলা গানের এই দুর্দিন থাকতই না। বাবা ঠিক বিকল্প গান আর পথ— দুটোই বার করে ফেলতেন। যেমন করেছিলেন ১৯৭৫ সালে। ওই বছর বাবার হাত ধরে জন্ম নেয় প্রথম বাংলা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’।

যে কোনও জিনিসই যখন নতুন, তখন তার স্বীকৃতি আদায় করতে লড়াইয়ে নামতে হয়। বাবাকেও নামতে হয়েছে। বাবার হাত ধরে প্রথম বাংলা ব্যান্ডের গান শ্রোতাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছে। নতুন ধরনের গান। নতুন ধারার কথা, সুর, গায়কি। ব্যান্ডে কোনও একক গায়ক থাকবেন না, এটা বাবাই প্রথম শুরু করেছিলেন। প্রত্যেকে কিছু না কিছু বাদ্যযন্ত্র বাজাবেন আর গাইবেন। এই রীতি বাংলা গানের দুনিয়ায় তখন একদম নতুন। ফলে, সঙ্গীতপ্রেমীরা প্রথমে বিহ্বল, তার পরে উচ্ছ্বসিত। একটা সময়ের পরে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সম্পাদিত অনেক গান প্রকাশিত হয়েছে। মনে আছে, কলকাতা বইমেলায় একটি টেবিল ঘিরে বসতেন ব্যান্ডের সবাই। সেখানে ঘোষণা করা হত নতুন গানের নাম। গান শোনার ব্যবস্থাও থাকত সেখানে। এ ছাড়া, বাবা কাজ করেছেন বাউল, ফকিরদের সঙ্গেও। জন্ম দিয়েছেন ‘বাউল জ্যাজ়’-এর।

বাবার দেখানো পথে হেঁটে আরও ব্যান্ড এসেছে তার পরে। গৌতম চট্টোপাধ্যায় কখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেননি। বাবা শুরু থেকে নিজের গান নিয়ে, নিজের কাজ নিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। নতুন কিছু সবার সামনে আনার আগে অনেকের দ্বিধা কাজ করে, কাজটা কতটা গৃহীত হবে ভেবে। বাবা জানতেন, তাঁর গান সঙ্গীত দুনিয়ার ধারা বদলে দেবে। ফলে, কোনও দিন প্রচারের জন্য লড়াইয়ে নামেননি। কোনও দিন নিজের কাজ নিয়ে দ্বিধায় ভোগেননি। বাবা আরও মনে করতেন, নতুন ঘরানা তৈরি হলে তাতে যত শিল্পী যোগ দেবেন ততই সেই ঘরানা সমৃদ্ধ হবে। সেই ঘরানার কথা বলতে গেলে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করতে হবেই। তাঁর কাজই তাঁকে মনে রাখতে বাধ্য করবে— বুঝেছিলেন বাবা।

খুব অল্প সময় বেঁচেছিলেন। খুব অল্প সময়ে অনেক কাজ করেছিলেন। বাবাকে কখনও কাজ ছাড়া বসে থাকতে দেখিনি। গান বাবার প্রাণ। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে তাঁর ব্যান্ডের দল ছিল। তখন তাঁরা ‘বিটলস’-সহ ইংরেজি গান গাইতেন। বলতে পারেন তারই বাংলা সংস্করণ ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। গান ছাড়াও বাবা ছবি পরিচালনা করেছেন। তাঁর প্রথম পরিচালনা ‘নাগমতী’। ছবিটি ১৯৮৩ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। এ ছাড়াও বাবা বানিয়েছিলেন, ‘সময়’, ‘লেটার টু মম’, ‘রংবীণ’। আর নানা স্বাদের ৫০টি তথ্যচিত্র। সঙ্গীত পরিচালনাও করেছেন একাধিক ছবির। অনেকেই জানেন না, বাবা নকশাল আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে গা-ঢাকা দেওয়ার জন্য চলে গিয়েছিলেন জবলপুর। সেখানে এক বছর তিনি মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েনটেটিভ-এর চাকরিও করেছেন। নিশ্চয়ই বাবার জীবন সংগ্রাম ছিল। কিন্তু কোনও দিন আমাদের কোনও কিছুর অভাব বুঝতে দেননি।

শুটিংয়ে ব্যস্ত গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

শুটিংয়ে ব্যস্ত গৌতম চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

কাজের বাইরে গৌতম চট্টোপাধ্যায় নিপাট ভালমানুষ বাবা। স্কুলে অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের বৈঠকে হয়তো যোগ দিতে পারতেন না। কিন্তু নিয়মিত পড়াতেন আমাকে। পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে আমাকে বা বোন আম্রপালিকে কড়া বকুনিও দিতেন। আবার এই বাবাই গরমে আম, শীতে কমলালেবু, ভাত-ডাল-চচ্চড়ি থেকে সুসি, পিৎজ়া পর্যন্ত খাইয়েছেন! বাবার দুটো সত্তা ছিল। একজন আন্তর্জাতিক। সেই সত্তা পাশ্চাত্য গান, ছবি, খাবার— সব পছন্দ করতেন। দ্বিতীয় সত্তা অন্তর থেকে বাঙালি। বাংলা গান, বাঙালি খানা, পোশাক ছাড়া চলতেই না তাঁর। বাবার সেই অভ্যাসগুলো আমাদের মধ্যেও ছড়িয়ে গিয়েছে। বাকি বাবাদের মতো আমার বাবাও হাত ভর্তি করে আমাদের জন্য খেলনা কিনে আনতেন।

বাবা আর মায়ের অটুট সম্পর্ক নিয়েও অনেকের কৌতূহল। বিনোদন দুনিয়ায় একটা কথা খুবই ঘোরে, শিল্পীদের নাকি একাধিক প্রেম। প্রেম না থাকলে নতুন সৃষ্টির তাগিদ আসে না! বাবাকে খুবই কম পেয়েছি। যতটুকু দেখেছি মনে হয়েছে, বাবা বোধহয় বিয়ের আগে তাঁর যাবতীয় প্রেম সেরে ফেলেছিলেন! তাই মায়ের পরে তাঁর জীবনে আর কেউ আসেননি। মাকে চোখে হারাতেন বাবা।

বাবার মৃত্যুদিন এলেই ১৯৯৯ সালের সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ে। ১৯ জুন বাবা ‘রংবীণ’ ছবির শুটিং, গান শেষ করে ফিরেছেন। এই ছবির বিষয় ‘কার্বি’ উপজাতি। পরের দিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় গিয়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। সেখানেই হঠাৎ হৃদ্‌রোগ। বাবা আর নেই! অত প্রাণবন্ত একটা মানুষ এ ভাবে বিনা নোটিসে চলে যেতে পারেন? আরও পরে উপলব্ধি হয়েছে, কাজের মানুষ কাজ করতে করতে করতেই এ ভাবে চলে যান।

Gautam Chattopadhyay Moheener Ghoraguli Gaurab Chattopadhyay Death Anniversary

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।