আড্ডা চলছিল বাগবাজার ঘাটে। রাস্তাঘাট, চায়ের দোকান, তাসের আড্ডার পাশের ফাঁকা জায়গাটাতেই গল্প শুরু করে দিলেন। পাশে বেশ কয়েকজন একটু গালমন্দ করেই নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। থামিয়ে দিলেন দেবদীপ। বললেন,‘‘দাদা একটা ইন্টারভিউ হচ্ছে। একটু আস্তে প্লিজ!’’
গানের সঙ্গে আলাপ:
সেই ক্লাস থ্রিতে। আমার কাকার একটা ডেক ছিল। তাতে ‘মোহরা’ ছবির গানগুলো বাজত। আমি শুনতাম। হেব্বি নাচতাম। আর কখনও কখনও গুনগুনও করতাম। কিন্তু মা-বাবা বরাবরই রবীন্দ্রসঙ্গীত, মান্না দে, কিশোর কুমার— এঁদের গান শুনতেন। কিন্তু, ওই গানগুলো তখন আমার খুব কঠিন মনে হত। মা মাঝে বেশ কয়েকবার হারমোনিয়াম নিয়ে বসানোর চেষ্টা করেছিল। আমার ঘুম পেয়ে যেত। ক্লাস সেভেনে একদিন দেখি নব্যেন্দু (প্রিয় বন্ধু) বেঞ্চ বাজিয়ে গাইছে ‘জোনাকিটা জ্বলছিল মিটিমিটি সন্ধের কাঁচা আঁধারে।’ অদ্ভুত লেগেছিল গানটা। এত সিম্পল কথা, গানও হতে পারে! সে দিন থেকেই শিলুদার(শিলাজিৎ মজুমদার) ডাই-হার্ট ফ্যান।
আরও পড়ুন, ‘কাস্টিং কাউচের শিকার হতে যাচ্ছিলাম আমিও’
শিলাজিতের শো:
ক্লাস নাইনে প্রথম দেখি শ্যাম পার্কে। তার পর থেকে ব্যাপারটা এরকম হয়ে গিয়েছিল যে, শিলুদার শো মানে আমি সেখানে যাবই। আমার মন্টি কার্লোর টি শার্ট ছিল একটা। শিলুদা ওটায় সই করে দিয়েছিল। আর এখন ওঁর সঙ্গেই স্টেজ শেয়ার করি। ভাল লাগে, খুব ভাল লাগে। শিলুদা যদি না কোনও দিন বাদ দেয়, ওর সঙ্গেই গান গেয়ে যেতে চাই।
ফার্স্ট অ্যালবাম:
‘স্বপ্ন রঙের মেয়েটা’ আমার ফার্স্ট বেসিক অ্যালবাম। ২০১৪ সালে রিলিজ করেছিল। আর সেই অ্যালবামের আদ্যোপান্তই আমার নিজের হাতে তৈরি করা। সিডিগুলো আমি নিজে বার্ন করেছি, এক দাদা কভারের ডিজাইন করে দিয়েছিলেন, স্টিকারগুলো সিডিতে নিজে লাগাতাম। তার পর নিজের হাতে করে মানুষজনের কাছে সিডি পৌঁছে দিয়েছি। পরে শ্রীনিবাস মিউজিক অ্যালবামটা রিলিজ করে।
কিন্তু, সেই অ্যালবাম রিলিজ করতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। এক নামজাদা মিউজিক কোম্পানির কাছে গিয়েছিলাম অ্যালবাম রিলিজের জন্য কথা বলতে। সেই কোম্পানির মালিক আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘তোমার বড় বড় চুল দাড়ি, হিপি লুক। নেশাভান নিশ্চয়ই করো। ভরসা পাচ্ছি না।’’ আমি তাঁর কাছে আমার গান নিয়ে গিয়েছিলাম, কত খরচা হতে পারে সেটা জানতে। আমাকে না চিনেই, অপরিচিত একটা লোক যে কী করে এমন কথা বলতে পারেন, ধারণার বাইরে। বেরিয়ে চলে আসি আর রিলিজের দায়িত্ব নিজেই নিই। তবে ‘স্বপ্ন রঙের মেয়েটা’ ইউটিউবে ১ হাজার ভিউয়ার করতে গিয়েই কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।
‘হয়নি আলাপ’:
বিরাট ঝড় উঠেছিল সে দিন। আমি তখন রাস্তায়। রবীন্দ্র সদন অবধি পৌঁছেছিলাম। কিন্তু যেখানে যাওয়ার কথা ছিল, যেতে পারিনি। কিছুদূর গিয়ে বাইকটা ঘোরাই। ওহ বাবা! ফেরার সময় দেখি গোটা ধর্মতলা জুড়ে বিরাট জ্যাম। বাইক নিয়ে নড়াচড়ার বিন্দুমাত্র জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। ঝড়ে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার পাঁপড়িগুলো দেখি আমার মাথার উপর ঝরে পড়ছে। যেই না জ্যামটা একটু কমতে শুরু করল, ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
চাঁদনি চক ছাড়িয়েছি আর একটা ফোন। ততক্ষণেআমি কাকভেজা। উপলদা ফোনের ওপারে। জানালেন, ‘হয়নি আলাপ’-এর ১ লক্ষ ভিউয়ার! ৯ এপ্রিল ভিডিয়োটা ইউটিউবে আপলোড করেছিলাম, আর ১৭ এপ্রিল ১ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দিনটা চিরকাল মনে থাকবে, আমার মনেও ঝড় উঠেছিল সে দিন।
গানের গুরু:
আমার গানের শিক্ষা অনেক পরে। টুয়েলভ পাশ করেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত নিয়ে ভর্তি হই। সরোদ শিখেছি ওখানেই। গিটারতো নিজে নিজেই শিখেছি। তবে গানে আমার প্রথম স্কুলিং শিলুদার বাড়িতে। একবার মনে আছে, হেব্বি মার খেয়েছিলাম শিলুদার হাতে। ও তখন পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে থাকত। ‘যা পাখি...’ গানটার সুরই ভুলিয়ে দিয়েছিলাম শিলুদাকে। মানে... আমি তো প্রতিভা, গায়ককে তাঁর গানের সুরই ভুলিয়ে দিচ্ছি। হেব্বি ঝাড় খেয়েছিলাম, মারও। আজ বুঝতে পারি, ওই বকুনিগুলোই এতদিন প্রোটিনের মতো কাজ করেছে।
বাইক দেবদীপের সর্বক্ষণের সঙ্গী।